বাশুলী / বিশালাক্ষী ও অন্যান্য মন্দির, চণ্ডীদাস নানুর, বীরভূম
শ্যামল কুমার ঘোষ
বীরভূম জেলার নানুর থানার মধ্যে অবস্থিত নানুর পদাবলী রচয়িতা চণ্ডীদাসের স্মৃতিধন্য স্থানরূপে পরিগণিত হয়ে বর্তমানে চণ্ডীদাস-নানুর নামে পরিচিত। বাংলাদেশে প্রাপ্ত বিভিন্ন পুঁথির ভণিতায় আমরা দু-তিন জন চণ্ডীদাসের উল্লেখ পাই। যথা, বড়ু, দ্বিজ এবং দীন - এঁদের প্রত্যেকের নামের সঙ্গে 'চণ্ডীদাস' শব্দ যুক্ত।
'শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' রচয়িতা 'বড়ু চণ্ডীদাস' নামে যে একজন কবি ছিলেন এবং তাঁর জন্ম বাঁকুড়া জেলার ছাতনা, এ বিষয়ে পণ্ডিতেরা মোটামুটি স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। তবে এই 'বড়ু চণ্ডীদাস' বাঙালীর অন্তরে বাসা বাঁধতে পারেন নি। দীন চণ্ডীদাসও তাই।
নানুরে যে এক চণ্ডীদাস বাস করতেন তা তিনি নিজেই লিখে গেছেন -
নানুরের মাঠে গ্রামের নিকটে
বাসুলী আছ'য়ে যথা।
তাহার আদেশে কহে চণ্ডীদাস
সুখ যে পাইবে কোথা।।
বিনয় ঘোষ লিখেছেন, "চণ্ডীদাস, অর্থাৎ দ্বিজ চণ্ডীদাস কোন ধারাবাহিক কৃষ্ণলীলার বই কিছু রচনা করে করেন নি। তিনি রচনা করেছেন সুমধুর সুললিত গীতিকাব্যের মালা, যা স্বপ্নভঙ্গ-নির্ঝরের উচ্ছ্বসিত ধারার মতন বাঙালীর মনপ্রাণ উদ্বেল করে তুলেছে। বাংলার গীতিকাব্যের লীলায়িত ধারার যিনি অন্যতম প্রবর্তক, বাংলার অমর পদাবলীর স্রষ্টা সেই চণ্ডীদাসের কথা আমরা বলছি। এই চণ্ডীদাস বীরভূম জেলার নানুরেরই অধিবাসী ছিলেন বলে আমার মনে হয়। চণ্ডীদাস-নানুর তাঁরই লীলাক্ষেত্র।"
পদাবলী স্রষ্টা যে এককালে এই নানুরে বসবাস করেছিলেন এ বিষয়ে পন্ডিতেরা এখন একমত। চণ্ডীদাসের রজকিনী প্রেম কাহিনী, চণ্ডীদাসের সাধন-ভজন কাহিনী ও চণ্ডীদাসের মৃত্যু কাহিনী ইত্যাদি সম্বন্ধে অনেক প্রবাদ-কিংবদন্তি প্রচলিত আছে নানুর ও কীর্ণাহারে।
হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় তাঁর রচিত 'কেতুগ্রামের কবি ও শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ' শীর্ষক এক প্রবন্ধে বর্ধমান জেলার কেতুগ্রামই যে চণ্ডীদাসের জন্মস্থান এবং সেখান থেকে কবি নানুরে এসে বসবাস করেন সে সম্বন্ধে যুক্তিতর্ক দ্বারা মত প্রকাশ করেছেন। কথিত আছে, গ্রামের নিচ জাতীয়া এক বিধবাকে বিয়ে করার ফলে জনসাধারণের মধ্যে অসন্তোষের সৃষ্টি হলে চণ্ডীদাস স্ব-পূজিতা বিশালাক্ষী দেবীকে নিয়ে কেতুগ্রাম থেকে নানুরে এসে বসবাস করেন। দুর্গাপূজার সময় নানুরে বিশালাক্ষী দেবীর চারদিন ব্যাপী পূজা হয়। এই পূজায় মহানবমী পূজার দিন কেতুগ্রামের তিলিদের পূজাই এখনও সর্বাগ্রে নেওয়া হয়। এর থেকেই বোঝা যায় যে কেতুগ্রামের সঙ্গে নানুরের প্রাচীন সম্পর্ক আছে। জনশ্রুতি, গ্রামের নীচ জাতীয়া এক বিধবাকে বিবাহ করবার ফলে গ্রামে জনসাধারণের মধ্যে অসন্তোষের সৃষ্টি হলে চণ্ডীদাস স্ব-পূজিতা বিশালাক্ষী দেবীকে নিয়ে কেতুগ্রাম থেকে নানুরে এসে এক বন্ধুর গৃহে আশ্রয় নেন।
নানুরে চণ্ডীদাসের বাস্তুভিটা ( বর্তমানে ঢিবি ) সংলগ্ন যে সকল মন্দির আছে তার মধ্যে পূর্বমুখী ৪ টি, পশ্চিমমুখী ২ টি, উত্তরমুখী ৭ টি, দক্ষিণমুখী ১ টি মোট ১৪ টি শিব মন্দির, একটি বাশুলী মন্দির, ১ টি দুর্গা দালান ও আর একটি পরিত্যক্ত দালান আছে।
বাশুলী মন্দিরের বিপরীতে অবস্থিত ২ টি উত্তরমুখী আটচালা মন্দির একই ভিত্তিবেদির উপর স্থাপিত। মন্দির ২ টির সামনের দেওয়ালে টেরাকোটার অলঙ্করণ আছে। টেরাকোটার বিষয় : হরগৌরী, সিদ্ধিঘোঁটা, সপরিবারে দুর্গা, গরুড়বাহন বিষ্ণু, কালী, বামন অবতার, বলরাম, কূর্ম অবতার, বরাহ অবতার, কৃষ্ণ লীলা ইত্যাদি।
এই দুটি মন্দিরের সামনে দাঁড়ালে ডান দিকে পড়বে ৪ টি মন্দির। একই ভিত্তিবেদির উপর স্থাপিত, পূর্বমুখী মন্দিরগুলি চারচালা শৈলীর। মন্দির গুলির সামনের দেওয়ালে সুন্দর পঙ্খের কাজ আছে। এ ছাড়া মন্দির চত্বরের পশ্চিম দিকে আছে উঁচু ভিত্তিবেদির স্থাপিত, ইঁটের তৈরি একটি চারচালা শৈলীর মন্দির। মন্দিরটির সামনের দেওয়ালেও সুন্দর পঙ্খের কাজ আছে। চত্বরে অবস্থিত বাকি মন্দিরগুলিতে কোন কাজ নেই। ১৪ টি মন্দিরের গর্ভগৃহে শিবলিঙ্গ বর্তমান।
ইঁটের তৈরি বাশুলী মন্দিরটি সাধারণ সমতল ছাদবিশিষ্ট দালান মন্দির। গর্ভগৃহে বাশুলী দেবীর বিগ্রহ নিত্য পূজিত। পূর্বের কষ্টিপাথরের মূর্তিটি ২০০১ খ্রীষ্টাব্দে চুরি হয়ে গেছে। বাশুলী বা বিশালাক্ষী দেবী ছিলেন চণ্ডীদাসের আরাধ্যা।
চণ্ডীদাস-নানুরের এই স্থানটি যেখানে বাসুলী মন্দিরাদি আছে এবং কবির ধর্ম সাধনার সঙ্গে বিজড়িত উচ্চ ঢিবিটি ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক সমীক্ষার সংরক্ষণাধীনে আছে।
|
উত্তরমুখী দুটি আটচালা মন্দির |
|
বাঁ দিকের আটচালা মন্দির |
|
বাঁ দিকের মন্দিরের সামনের বিন্যাস |
|
মন্দিরের খিলানের উপরের কাজ |
|
কুলুঙ্গির মধ্যে কাজ - ১ ( হরগৌরী, সিদ্ধিঘোঁটা ও অন্য চিত্র ) |
|
কুলুঙ্গির মধ্যে কাজ - ২ ( হরগৌরী ও অন্য চিত্র ) |
|
কুলুঙ্গির মধ্যে কাজ - ৩ ( সপরিবারে দুর্গা ) |
|
কুলুঙ্গির মধ্যে কাজ - ৪ ( কালী ও গরুড়বাহন বিষ্ণু ) |
|
কুলুঙ্গির মধ্যে কাজ - ৫ |
|
কুলুঙ্গির মধ্যে কাজ - ৬ ( গরুড়বাহন বিষ্ণু ও কল্কি অবতার ) |
|
কুলুঙ্গির মধ্যে কাজ - ৭ |
|
কুলুঙ্গির মধ্যে কাজ - ৮ |
|
কুলুঙ্গির মধ্যে কাজ - ৯ ( বামন অবতার ও বলরাম ) |
|
কুলুঙ্গির মধ্যে কাজ - ১০ ( বরাহ অবতার ও কূর্ম অবতার ) |
|
কুলুঙ্গির মধ্যে কাজ - ১১ ( দধি মন্থন কালে মন্থন পাত্রে কৃষ্ণের হস্ত প্রবেশ ও অন্য চিত্র ) |
|
কুলুঙ্গির মধ্যে কাজ - ১২ ( কৃষ্ণ লীলা ) |
|
ডান দিকের আটচালা মন্দির |
|
মন্দিরের খিলানের উপরের কাজ |
|
মন্দিরের কোনাচ |
|
কুলুঙ্গির মধ্যে কাজ - ১ |
|
কুলুঙ্গির মধ্যে কাজ - ২ |
|
কুলুঙ্গির মধ্যে কাজ - ৩ |
|
চারটি পূর্বমুখী চারচালা মন্দির ( ডান দিকে ) |
|
প্রথম মন্দিরের খিলানের উপরের পঙ্খের কাজ |
|
দ্বিতীয় মন্দিরের খিলানের উপরের পঙ্খের কাজ
|
|
তৃতীয় মন্দিরের খিলানের উপরের পঙ্খের কাজ
|
|
চতুর্থ মন্দিরের খিলানের উপরের পঙ্খের কাজ
|
|
সিংহাসানে উপবিষ্ট রামসীতা |
|
পঙ্খের নকশা - ১ |
|
পঙ্খের নকশা - ২ |
|
পঙ্খের নকশা - ৩ |
|
পশ্চিমমুখী ১টি চারচালা মন্দির ( বাঁ দিকে ) |
|
মন্দিরের সামনের বিন্যাস |
|
খিলানের উপরের পঙ্খের কাজ |
|
বাঁ দিকে, দক্ষিণমুখী বিশালাক্ষী মন্দির ডান দিকে, ৪ টি পূর্বমুখী চারচালা মন্দির |
|
বিশালাক্ষী মন্দির |
|
৫ টি উত্তরমুখী চারচালা মন্দির, ডান পাশে ঢিবি |
|
বাশুলী দেবীর বর্তমান বিগ্রহ |
|
ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ কর্তৃক মন্দির চত্বরে লাগানো বোর্ড
কী ভাবে যাবেন : কলকাতা থেকে ট্রেনে বোলপুর-শান্তিনিকেতন। বোলপুরের জামবুনি বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসে নানুর। বাসস্ট্যান্ডের কাছেই মন্দির। |
সহায়ক গ্রন্থাবলী : ১) বীরভূম জেলার পুরাকীর্তি : দেবকুমার চক্রবর্তী ২) পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি : বিনয় ঘোষ ------------------------------ আমার ইমেল : shyamalfpb@gmail.com প্রয়োজনে যোগাযোগ করতে পারেন।
|
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন