কুলিয়ার পাট, গয়েশপুর, কল্যাণী, নদিয়া
শ্যামল কুমার ঘোষ
শ্রীচৈতন্যদেব ও শ্রীনিত্যানন্দের স্মৃতিবিজড়িত কুলিয়ার পাট বৈষ্ণবদের একটি তীর্থস্থান । কল্যাণী রেলস্টেশন থেকে ২.৫ কি. মি. উত্তর-পূর্বে অবস্থিত । পৌষ মাসের কৃষ্ণা একাদশী তিথিতে শ্রীচৈতন্যদেব এই গ্রামের বৈষ্ণব-নিন্দুক পণ্ডিত দেবানন্দের অপরাধ ভঞ্জন করেন। তাই একে অপরাধভঞ্জনেরও পাট বলা হয় । কেউ কেউ একে দেবানন্দের পাটও বলে থাকেন । একটি সুন্দর মন্দিরে দারু নির্মিত গৌর-নিতাই বিগ্রহের নিত্য পূজা হয় । তা ছাড়া শ্রীকৃষ্ণ, রাধিকা ও অন্যান্য বিগ্রহও আছেন । পাশের একটি ঘরে শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত । দক্ষিণমুখী মন্দিরটি দেউল শ্রেণীর, একটি সমতল ছাদ দালানেন উপর খাঁজকাটা দেউল-শিখর স্থাপিত । সামনে নাটমন্দির । মন্দিরটি নির্মাণ করেন কলকাতা নিবাসী ধর্মপ্রাণ শ্রী গৌরচরণ মল্লিক । পরে কলকাতা নিবাসী শ্রী কানাইলাল ধর কঠিন রোগাক্রান্ত হয়ে শ্রীগৌরাঙ্গের শরণাগত হন এবং মহাপ্রভুর কৃপায় রোগমুক্ত হয়ে মন্দিরের উন্নতি সাধন, নাটমন্দির, দেবানন্দ স্বামী ও চাপাল-গোপালের দুটি সমাধি মন্দির ইত্যাদি নির্মাণ করে দেন । এখানকার একটি শিউলি গাছ কে 'বাঞ্ছাকল্পতরু ' বল়া হয় । এই গাছের নিচে ভক্তরা অপরাধ ভঞ্জনের প্রতীক অনুষ্ঠান পালন করে থাকেন । মন্দিরের পাশে কুলিয়া বিলের ঘাটটি খুব সুন্দর । নির্জন ও ছায়া-শীতল । বর্তমানে কলকাতার পিঞ্জরাপোল সোসাইটি ( ঠিকানা : ৩৪, আরমেনিয়ান স্ট্রীট, কলকাতা - ১ ) মন্দিরটির দেখাশোনার কাজে নিয়োজিত ।
কুলিয়ার পাট সম্পর্কে নানা কাহিনী প্রচলিত আছে । প্রথমটি, দেবানন্দ ছিলেন কুলিয়া গ্রামের অধিবাসী । জ্ঞানবান, তপস্বী, কিন্তু ভক্তিহীন মোক্ষাভিলাষী । শ্রীমদ্ ভাগবতের অধ্যাপনা করতেন । একদিন শ্রীচৈতন্যদেবের পার্শ্বচর শ্রীবাস পণ্ডিত ভাগবতের ব্যাখ্যা শোনবার জন্য তাঁর বাড়িতে আসেন । ভাগবতের পাঠ শুনতে শুনতে শ্রীবাস প্রেমাবিষ্ট হলেন । তিনি উচ্চৈস্বরে কাঁদতে লাগলেন । পাগলের পাগলামি মনে করে দেবানন্দ ও তাঁর ছাত্ররা শ্রীবাসকে মারতে মারতে বাড়ির বাইরে বার করে দেন । এই অপরাধে দেবানন্দ কুষ্ঠব্যাধিগ্রস্থ হন । মহাপ্রভুর কীর্তন-সঙ্গী বক্রেশ্বের পণ্ডিতের কৃপায় দেবানন্দের ভক্তিতত্ত্বে বিশ্বাস জন্মায় । তিনি বুঝতে পারেন মহাপ্রভু স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণের অবতার । শ্রীবাস পণ্ডিতের প্রতি তাঁর ব্যবহারের জন্য অনুশোচনা হয় । তখন এই কুলিয়া গ্রামের পাশ দিয়ে যমুনা নদী বয়ে যেত । দেবানন্দ এই নির্জন কুলিয়া গ্রামে এসে সাধন ভজনে ব্রতী হন । মহাপ্রভু কুলিয়া গ্রাম হয়ে কুমারহট্ট ( বর্তমান হালিসহর ) যাওয়ার সময় এখানে এলে দেবানন্দ মহাপ্রভুর চরণে তাঁর দুঃখের কথা নিবেদন করেন এবং একটা কুলোয় করে মুলো, পালং শাক, চাল ইত্যাদি দিয়ে সিধা দেন । মহাপ্রভু দেবানন্দকে যমুনায় স্নান করে আসতে বলেন । যমুনার জলে ডুব দেওয়া মাত্র দেবানন্দের দেহ থেকে কুষ্ঠব্যাধি নির্মূল হয় । ঐ সিধা রান্না করে মহাপ্রভু একাদশীর উপবাস ভঙ্গ করেন । তারপর যমুনার ধারে সারা রাত ধরে হরিনাম সংকীর্তন করেন । কয়েক বছর পরে ঐ তিথিতেই দেবানন্দ দেহত্যাগ করেন । পৌষ মাসের কৃষ্ণা একাদশীতে দেবানন্দের অপরাধ ভঞ্জন হয়েছিল বলে সেই থেকে ঐ তিথিতে দেবানন্দের সমাধির পাশে অপরাধ-ভঞ্জনের মেলা বসে । লোক-বিশ্বাস ওই দিন এখানে এসে গৌর-নিতাই বিগ্রহ দর্শন করে কুলিয়ার পাটে স্নান, পূজার্চ্চনা ও বনভোজন করলে সব পাপ ও অপরাধ ভঞ্জন হয় । যমুনা এখন আর প্রবাহিনী নয়, বদলে বিরাট 'কুলিয়ার বিলে' পরিণত হয়েছে । মন্দিরের পশ্চিমে দেবানন্দ গোস্বামী ও চাপাল গোপালের ছোট ছোট দুটি সমাধি মন্দির আছে ।
দ্বিতীয়টি, মহাপ্রভু শ্রীবাস পণ্ডিতের গৃহে ভক্তবৃন্দ ও পারিষদগণ সহ প্রতি রাত্রে হরিনাম সংকীর্তন করতেন । হরিনাম বিদ্বেষী লোকেরা সংকীর্তনের সময় গোলমাল করবে ভেবে বাড়ির দরজা বন্ধ রাখতেন । হরিনাম
বিদ্বেষী চপল প্রকৃতি গোপাল নামক এক ব্রাহ্মণ মহাপ্রভুর কীর্তনে
বাধা দিতে এসে দ্বার বন্ধ থাকার জন্য বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করতে
না পেরে " বহির্দ্বারের সম্মুখে জল ও গোময় লেপিত স্থানে
কদলী পত্রের উপর জবা-পুস্প, রক্তচন্দন, সিন্দুর, হরিদ্রা, আতপ তণ্ডুল
এবং তৎপার্শ্বে মদ্যভাণ্ড " রেখে যান । সকালে দরজা খোলার পর ভক্তবৃন্দ ও পারিষদগণ সহ মহাপ্রভু এই সব জিনিস দেখতে পান । এই
অপরাধে চাপাল গোপালের তিন দিন পরেই কুষ্ঠ ব্যাধি হয় । পরে মহাপ্রভু
নীলাচল হতে কুলিয়ায় এলে চাপাল গোপালের অপরাধ ভঞ্জন হয় । সেই থেকে কুলিয়া পাটের নাম "অপরাধভঞ্জনের পাট " নামে অভিহিত হয় ।
কুলিয়া
পাটে
যেতে
হলে
শিয়ালদহ
থেকে
সকালের
লালগোলা প্যাসেঞ্জার,
রানাঘাট,
শান্তিপুর,
গেদে,
কৃষ্ণনগর
বা
কল্যাণী সীমান্ত লোকালে
উঠুন ।
নামুন
কল্যাণী
স্টেশনে ।
স্টেশনের
পূর্ব
দিক
থেকে
রিকশা
পাবেন । ৪
নং
প্ল্যাটফর্মের
স্টেশন
ভবনের
পশিম
দিক
থেকে
কাষ্ঠডাঙ্গা গামী ম্যাজিক গাড়িও পাবেন ।
দুপুর
১২ টা
৩০ মিনিট
থেকে
বিকাল ৪ টা
পর্যন্ত
মন্দির
বন্ধ
থাকে ।
 |
কুলিয়া পাটের মন্দির |
 |
মন্দিরের শিখর |
 |
গর্ভগৃহের সামনের কাজ |
 |
দেবানন্দ গোস্বামী ও চাপাল গোপালের সমাধি মন্দির |
 |
বাঞ্ছাকল্পতরু |
 |
কুলিয়া বিলের ঘাট |
 |
গৌর-নিতাই ও অন্যান্য বিগ্রহ |
 |
গৌর-নিতাই বিগ্রহ |
 |
কৃষ্ণ ও রাধিকা বিগ্রহ
|
মন্দিরটি পরিদর্শনের তারিখ : ২৫.০৯.২০১৫
সহায়ক গ্রন্থাবলি :
১. পশ্চিমবঙ্গের পূজা-পার্বণ ও মেলা ( ৩ য় খণ্ড ) : অশোক মিত্র সম্পাদিত
২. পশ্চিমবঙ্গ ভ্রমণ ও দর্শণ : ভূপতিরঞ্জন দাস
৩. কুলিয়ার পাট : শ্রী পঞ্চানন ঘোষ
----------------------------------------------------------
রামায়ণের ৭টি খণ্ডের ৬৪ টি উপাখ্যান ও ১৮৫ টি টেরাকোটা ফলকের আলোকচিত্র সংবলিত আমার লেখা এবং 'রা প্রকাশন' কর্তৃক প্রকাশিত বই 'বাংলার টেরাকোটা মন্দিরে রামায়ণ' প্রকাশিত হয়েছে।
বইটি ডাক যোগে সংগ্রহ করতে হলে যোগাযোগ করুন : 9038130757 এই নম্বরে। কলকাতার কলেজস্ট্রিটের মোড়ে দুই মোহিনীমোহন কাঞ্জিলালের কাপড়ের দোকানের মাঝের রাস্তা ১৫, শ্যামাচরণ দে স্ট্রিটের উপর অবস্থিত বিদ্যাসাগর টাওয়ারের দু'তলায় 'রা প্রকাশনে'র দোকান। ওখান থেকে বইটি সংগ্রহ করতে পারেন। কোনও অসুবিধা হলে উপরোক্ত নম্বরে ফোন করতে পারেন।
--------------------------------------------------------