হংসেশ্বরী কালী মন্দির, বাঁশবেড়িয়া ,হুগলি
শ্যামল কুমার ঘোষ
ব্যাণ্ডেল-কাটোয়া রেলপথে বাঁশবেড়িয়া একটি রেলস্টেশন। প্রাচীন সপ্তগ্রামের অন্যতম বংশবাটির বর্তমান নাম বাঁশবেড়িয়া। ব্যাণ্ডেল থেকে দূরত্ব ৪ কি. মি.। এখানে আছে দুটি বিখ্যাত মন্দির, অনন্ত বাসুদেব ও হংসেশ্বরী। এখানে হংসেশ্বরী মন্দির নিয়ে আলোচনা করব।
রাজা রামেশ্বরের দ্বারা বংশবাটী রাজবংশের উদ্ভব ও শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। রামেশ্বরের ছিল তিন পুত্র। জ্যেষ্ঠ পুত্র রাজা রঘুদেব বংশবাটিতে থেকে যান। অপর দুই পুত্র জমিদারির ভাগ নিয়ে অন্যত্র বাস করতে মনস্থ করেন। রাজা রঘুদেব বর্গীদের হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য রাজবাড়ির চারিদিকে একটি খাল খনন করান। তাঁর একমাত্র পুত্র গোবিন্দদেবের পুত্র রাজা নৃসিংহদেব পিতার মৃত্যুর তিন মাস পর জন্মগ্রহণ করেন। গোবিন্দদেব নিঃসন্তান অবস্থায় মারা গেছেন এই অজুহাতে তাঁর সমস্ত সম্পত্তি নবাব আলিবর্দী অন্য জমিদারদের বন্দোবস্ত করে দেন। রাজা নৃসিংহদেব সেজন্য শৈশবে খুবই আর্থিক দুরবস্থার মধ্যে পড়েন। পলাশীর যুদ্ধে সিরাজদ্দৌলার পরাজয়ের পর বাংলায় 'কম্পানী'র শাসন কায়েম হলে রাজা নৃসিংহদেব ওয়ারেন হেস্টিংসকে তাঁর পৈত্রিক সম্পত্তি ফিরিয়ে দেওয়ার আবেদন করেন। হেস্টিংস নৃসিংহদেবকে তাঁর পিতার সম্পত্তির ২৪ পরগণা অংশ ফিরিয়ে দেন। তারপর ১৭৫৯ খ্রিস্টাব্দে লর্ড কর্ণওয়ালিসের নিকট প্রার্থণা করে আরও তিনটি পরগণা লাভ করেন।
১৭৯১ খ্রিস্টাব্দে তিনি কাশীতে যান এবং সেখানে সাধু-সন্ন্যাসীদের সাহায্যে তান্ত্রিকমতে যোগশাস্ত্রে বিশেষ পারদর্শিতা লাভ করেন। সেই সময় ভূকৈলাসের রাজা জয়নারায়ণ ঘোষাল কাশীতে বাস করছিলেন। নৃসিংহদেব কাশীখণ্ডের সংস্কৃত থেকে বাংলা অনুবাদ করতে রাজা জয়নারায়ণ ঘোষালকে সাহায্য করেছিলেন।
কাশী যাওয়ার আগে ১৭৮৯ সালে বাঁশবেড়িয়ায় তিনি স্বয়ম্ভবা মহিষমর্দিনী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে মন্দিরটি আর নেই। তবে মায়ের বিগ্রহটি হংসেশ্বরী মন্দিরের গর্ভগৃহের বাঁ দিকের ঘরে রক্ষিত আছে।
১৭৯৯ সালে তিনি কাশী থেকে ফিরে আসেন। লর্ড কর্ণওয়ালিস তাঁকে অন্যান্য সম্পত্তি পুনরুদ্ধারের জন্য বিলেতে কোর্ট-অফ-ডাইরেক্টরগণের কাছে আবেদন করতে পরামর্শ দেন। কিন্তু কাশী থেকে ফিরে আসার পর তিনি সম্পূর্ণ বদলে যান। সম্পত্তি পুনরুদ্ধারের জন্য বিলেতে বিপুল টাকা ব্যয় না করে সেই টাকায় হংসেশ্বরী মন্দির প্রতিষ্ঠা করতে মনস্থ করেন।
হংসেশ্বরী মন্দিরের অনুরূপ মন্দির বাংলায় আর নেই। এর স্থাপত্য অনবদ্য। তান্ত্রিক রাজা নৃসিংহ দেব ১৮০২ খ্রিস্টাব্দে মন্দিরের নির্মাণ শুরু করেন। তাঁর অকাল প্রয়াণে মন্দির নির্মাণের কাজ সাময়িক ভাবে বন্ধ হয়ে যায়। পরে তাঁর পত্নী রানী শঙ্করী পুনরায় মন্দির নির্মাণ শুরু করেন এবং ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দে নির্মাণ শেষ করেন। খরচ হয়েছিল ৫ লক্ষ টাকা। মন্দিরের গায়ে লাগানো একটি ফলকে এই শ্লোকটি খোদাই করা আছে :
শাকাব্দে রস-বহ্নি-মৈত্রগণিতে শ্রীমন্দিরং মন্দিরং
মোক্ষদ্বার-চতুর্দশেশ্বর-সমং হংসেশ্বরী-রাজিতং
ভূপালেন নৃসিংহদেবকৃতিনারব্ধং তদাজ্ঞানুগা
তৎপত্নী গুরুপাদপদ্মনিরতা শ্রীশঙ্করী নির্মমে ।।
শকাব্দা ১৭৩৬ ।
নরদেহে ষটচক্রভেদের ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না, বজ্রাক্ষ ও চিত্রিনী নামে যে পাঁচটি নাড়ী আছে, সেরূপ এই মন্দিরে উহাদের প্রতীক পাঁচটি তলা এবং হংসেশ্বরী স্বয়ং কুলকুণ্ডলিনী রূপে অবস্থিতা। হংসেশ্বরী দেবীর মূর্তি নিমকাঠ দ্বারা প্রস্তুত। দেবীর বর্ণ নীল। পঞ্চমুণ্ডির বেদির ওপর স্থাপিত সহস্রদল পদ্মের ওপর শবরূপে শায়িত শিবের নাভি থেকে ওঠা দীর্ঘ মৃণালসহ ফোটা পদ্মের ওপর দেবী হংসেশ্বরী বাঁ পা মুড়ে এবং ডান পা ঝুলিয়ে বসে আছেন। মন্দিরে বিভিন্ন কক্ষে শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত আছে। বর্তমানে মন্দিরটি ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ, কলকাতা মণ্ডল দ্বারা সংরক্ষিত। মন্দিরের উপর তলে ওঠা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ।
মন্দিরটি খোলা থাকে সকল ৬ টা থেকে দুপুর ১২ টা ৩০ মি. এবং বিকাল ৪ টা থেকে ৬ টা ৩০ মি. পর্যন্ত। মন্দিরে নিত্য পূজা ছাড়াও বিভিন্ন উৎসবে বিশেষ পূজা অনুষ্ঠিত হয়। অন্নভোগপ্রসাদের জন্য সকাল ১০ টার মধ্যে দক্ষিণার বিনিময়ে কুপন সংগ্রহ করতে হবে। অন্নভোগ বিতরণ শুরু হয় ১২ টা ৪৫ মি. থেকে।
বাঁশবেড়িয়াতে যেতে হলে শিয়ালদহ থেকে সকালে ৮ টা ১২ মিনিটে কাটোয়া লোকাল বা হাওড়া থেকে সকালে ৭ টা ৫৩ মিনিটে বা তার আগের কাটোয়া লোকাল ধরুন। ব্যাণ্ডেল থেকেও বাঁশবেড়িয়া যাওয়ার গাড়ি পাবেন। স্টেশন থেকে মন্দির যেতে রিকশা পাবেন।
মন্দিরটি পরিদর্শনের তারিখ : ০৯.০৯.২০১৫
হংসেশ্বরী মন্দির, বাঁশবেড়িয়া |
মন্দিরের সামনে বাঁধানো প্রশস্ত চত্বর, দূরে বাসুদেব মন্দির |
গর্ভগৃহের সামনে দরজার উপরের দেওয়ালের কাজ |
মন্দিরের সামনে খিলানে পাথরের উপর কাজ |
প্রতিষ্ঠাফলক |
মূল চূড়ার পাথরের ঘর |
পদ্মকোরকাকৃতি মূল চূড়া |
হংসেশ্বরী দেবী বিগ্রহ - ১ |
হংসেশ্বরী দেবী বিগ্রহ - ২ |
মহিষমর্দিনী মূর্তি |
সহায়ক গ্রন্থাবলি :
১. হুগলী জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ ( ২ য় খণ্ড ) : সুধীর কুমার মিত্র
২. পশ্চিমবঙ্গের পূজা-পার্বণ ও মেলা ( ২ য় খণ্ড ) : অশোক মিত্র সম্পাদিত
********
এই মন্দির চত্বরে আর একটি মন্দির সম্বন্ধে জানতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুন :
অনন্ত বাসুদেব মন্দির
পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য কালী মন্দির সম্বন্ধে জানতে নিচের লিংকে ক্লিক করুন / লিংকের উপর আঙুল দিয়ে টোকা দিন :
-------------------------------------------
আমার ইমেল : shyamalfpb@gmail.com প্রয়োজনে যোগাযোগ করতে পারেন।
--------------------------------------------
অসাধারণ পোস্ট। সাথে আরেকটি তথ্য প্রতি বছর দ্বীপান্বিতা উৎসবে তান্ত্রিক মতে পুজো হয়। মাকে আলাদা করে রুপার জিহ্বা ও গয়না দিয়ে একদিনের জন্য সাজানো হয়।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
মুছুনloved your blog. God Bless.
উত্তরমুছুনধন্যবাদ।
মুছুননারায়ন সান্যালের "হংসেশ্বরী" বইটি পড়ার অনুরোধ রইলো।
উত্তরমুছুন