নবরত্ন মন্দির, বোড়াইচণ্ডীতলা, গোস্বামী ঘাট, চন্দননগর, হুগলি
শ্যামল কুমার ঘোষ
হাওড়া-ব্যাণ্ডেল রেলপথে চন্দননগর ত্রয়োদশতম রেলস্টেশন। রেলপথে হাওড়া থেকে দূরত্ব ৩২.৬ কিমি। চন্দননগর নামটি সম্ভবত 'চন্দ্র নগর' নাম থেকে এসেছে। কেউ কেউ বলেন যে গঙ্গানদী এখানে চন্দ্রাকার বলে প্রথমে 'চন্দ্রনগর' এবং তার থেকে 'চন্দননগর' হয়েছে। আবার অনেকের মতে একসময় এখানে চন্দনকাঠের বড় বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল। তা থেকে 'চন্দননগর' নামটির উদ্ভব। এক সময় শহরটি ফরাসীদের অধিকারে থাকার জন্য নাম হয় 'ফরাসডাঙা'।
অষ্টাদশ শতকের শেষ ভাগে চন্দননগরের বোড়াইচণ্ডীতলায় দেবীচরণ সরকার নামে এক বিশিষ্ট কায়স্থ বাস করতেন। সেই সময় চন্দননগরে প্রায় দেড় হাজার তাঁতির বাস ছিল। তাঁদের তৈরি লুঙ্গি বিদেশে চালান দিয়ে তিনি প্রচুর ধন উপার্জন করেন। দানে তিনি মুক্ত হস্ত ছিলেন। দেবীচরণের মৃত্যুর পর তাঁর ছোট ভাই বিশ্বনাথ সরকারও অপুত্রক অবস্থায় অকালে মারা যান। স্বামীর মৃত্যুর পর বিশ্বনাথের স্ত্রী গৌরমণি সরকার ১৮০৮ খ্রীষ্টাব্দে ( ১৭৩০ শকাব্দে ) তাঁর সমস্ত সম্পত্তি দেবসেবায় নিয়োজিত করেন। তিনি গোস্বামী ঘাটে গঙ্গা-তীরে ভবতারিণী কালীর মন্দির ও দু-পাশে ছটি করে বারটি শিবমন্দির স্থাপন করেন। এই সব দেবগৃহ নির্মাণে তাঁর এক লক্ষ টাকা এবং মন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য আরও পঞ্চাশ হাজার টাকা ব্যয় হয়। এছাড়া বিগ্রহের সেবাপূজার জন্য তিনি এক লক্ষ টাকা গচ্ছিত রাখেন। গৌরমণি 'সরকার বংশ'-এ কনিষ্ঠা বধূ ছিলেন বলে তিনি সকলের কাছে 'কনে বৌ' নামে পরিচিত ছিলেন। তাই সেকালে এই মন্দির জন সাধারণের কাছে 'কনে বৌয়ের মন্দির' বলে পরিচিত ছিল।
এই দানশীলা মহিলা অকালে পারলোকগমন করলে এই মন্দির সরকার পরিবারের এক কুলাঙ্গার রাখালদাস সরকারের হাতে আসে। রাখালদাস ছিলেন নাস্তিক। মদ্যপান ছাড়াও লম্পট বলে তাঁর কুখ্যাতি ছিল। ভবতারিণী কালীর দুটি হাত ভেঙে গেলে তিনি দেবীকে গঙ্গায় বিসর্জন দেন। তারপর মন্দিরের শিবগুলি লোপাট হয়ে যায়। রাখাল সরকার ঠাকুরের দেবোত্তর সম্পত্তি নাড়ুয়া নিবাসী জনৈক থাকচন্দ্র সিংহ রায় কে বিক্রি করে দেন। তাঁর কাছ থেকে ঠাকুরের জমি কেনেন রাজেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। ১৮১৮ খ্রীষ্টাব্দে গঙ্গার গতি পরিবর্তনের ফলে একটি শিবমন্দির ভেঙে যায়। এইভাবে অনেকবার মন্দিরের সম্পত্তির হাত বদল হয়। কিন্তু আর্থিক ক্ষতি, সাংসারিক বিপর্যয়, আন্তীয় বিয়োগ প্রভৃতির কারণে কেউই এই সম্পত্তি ভোগ করতে পারেন নি। ১৯১৫ খ্রীষ্টাব্দে ব্রজেন্দ্রনাথ গোস্বামী মন্দিরের জমিতে একটি টালিখোলা করেন। কিন্তু তিনিও অকৃতকার্য হন। তারপর সিদ্ধেশ্বর কুমার মন্দিরগুলি কেনেন। তিনি নবরত্ন মন্দির সংলগ্ন তিনটি মন্দির বাদে বাকি শিবমন্দিরগুলি ভেঙে ফেলে তার ইঁট দিয়ে সুরকি প্রস্তুত করেন। কিন্তু মন্দিরের সুরকি কেউ না কেনায় হারানচন্দ্র ঘোষ মাত্র একশ টাকায় সমস্ত কিনে নেন। তারপর নবরত্ন ও অবশিষ্ট শিবমন্দিরগুলি ভেঙে ফেলতে মনস্ত করলে এক সাধু ব্যথিত চিত্তে তাকে মন্দির ভাঙতে নিষেধ করেন। হারান সাধুকে বলেন, 'আপনার যখন এত দরদ তখন আপনি কিনে নিন।' তেজদীপ্ত সাধু ভিক্ষালব্ধ অর্থে মন্দিরগুলি কিনে নেন এবং মন্দিরগুলি রক্ষা করেন। এই সাধুর নাম শ্রীমৎ নৃসিংহদাস বাবাজী।
উঁচু ভিত্তিবেদির উপর প্রতিষ্ঠিত বিশালাকায় মন্দিরটি সোজা কার্নিসযুক্ত নবরত্ন শৈলীর। বাংলায় ইংরেজ রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বাংলার মন্দির শিল্পে ইউরোপীয় প্রভাবের সূত্রপাত হয় এবং তার ফলে বাংলা মন্দিরে বক্র চালের পরিবর্তে সমতল ছাদের সৃষ্টি হয়। এছাড়া মন্দিরকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করার জন্য মন্দিরের সামনে স্থাপন করা হয় বড় বড় বিদেশী স্তম্ভ। এ মন্দিরের ক্ষেত্রেও তা করা হয়েছে। মন্দিরের সামনে মন্দির লাগোয়া একটি নাটমন্দির নির্মাণ করা হয়েছে। এটি হয়তো পরবর্তী কালে সংযোজিত। ছয়টি সিঁড়ি দিয়ে ওঠবার পর মন্দির প্রবেশের তিনটি দরজা। মন্দিরের সামনে সিঁড়ির দু' ধারে দুটি রেখ-দেউল মন্দিরটির সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে। এগুলি অবশ্য পরবর্তীকালে সংযোজিত হয়েছে।
বাবাজী নৃসিংহজীর কাছ থেকে এই মন্দির প্রবর্তক সংঘের প্রতিষ্ঠাতা মতিলাল রায়ের হাতে আসে। জাতি-তপস্যার মহাতীর্থরূপে 'শ্রীমন্দির' গড়ে তোলার সংকল্প নেন মতিলাল। কোন বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা না করে মহাশিল্পী আচার্য অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর শব্দ-ব্রহ্ম 'মহাপ্রণব' - রজত কলসের গায়ে সুবর্ণের বিগ্রহ ওঁ-কার স্থাপনের পরিকল্পনা করেন। ১৯২৩ খ্রীষ্টাব্দে পুণ্য অক্ষয় তৃতীয়ার দিন দেশনায়ক বিপিনচন্দ্র পালের সভাপতিত্বে এবং নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর উপস্থিতিতে মন্দিরটি জাতীয় মন্দিরে পরিণত হয় এবং জাতির উদ্দেশ্যে সমর্পিত হয়। ১৯৩৭ খ্রীষ্টাব্দে মন্দির থেকে সর্বস্বীকৃত প্রতীকটি চুরি যায়। শিল্পী সুন্দর শর্মা সংঘের প্রতীকের যে রূপ দেন সেটি ১৯৩৮ খ্রীষ্টাব্দে অক্ষয় তৃতীয়ার দিন জাতীয় মন্দিরে স্থাপন করা হয়। ১৯৪৩ খ্রীষ্টাব্দে ৬ ই মে, অক্ষয় তৃতীয়ার দিন এই শ্রীমন্দিরে 'তৃবৃৎ লিঙ্গ সংযুক্ত' প্রণব প্রতিষ্ঠা করা হয়। এটিও নির্মাণ করেছিলেন শিল্পী সুন্দর শর্মা। বেদান্তের বাণী অনুযায়ী অনল ( অগ্নি বা তেজ ), জল ( অপ্ ) ও ক্ষিতি নিয়ে তৃবৃৎকরণ। তেজের সৃষ্টিশক্তি, ক্ষিতির স্থিতিশক্তি এবং অপে বিশ্বের লয় - এই তিন শক্তি নিয়েই প্রণব। এখানে উল্লেখ্য, জন্মবিপ্লবী ও প্রবর্তক সংঘের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মতিলাল রায়। তাঁর জন্ম ৬ই জানুয়ারি, ১৮৮২। ঈশ্বর গুপ্ত সম্পাদিত 'প্রভাকর' পত্রিকায় তিনি কবিতা লিখতেন। তিনি নাটকও রচনা করেছিলেন। এক সময় নবদ্বীপে যাত্রাদল গঠন করে তিনি বহু অর্থ ও খ্যাতি অর্জন করেন। 'সীতা হরণ', 'নিমাই সন্ন্যাস' ইত্যাদি গীতিনাট্য রচনা করেন। প্রবর্তক সংঘের সংগঠনের কাজে তিনি অসামান্য প্রতিভার পরিচয় দেন। এক সময় তাঁর সংঘ ছিল বিপ্লবীদের আশ্রয়স্থল। ১০ই এপ্রিল, ১৯৫৯ এই দেশনায়কের মৃত্যু হয়।
বর্তমানে মন্দির চৌহদ্দির মধ্যে প্রবর্তক সংঘ পরিচালিত দুঃস্থ ও অনাথ শিশুদের জন্য একটি ছাত্রাবাস আছে।
মন্দিরটি পরিদর্শনের তারিখ : ১৪.০৯.২০১৭
|
নবরত্ন মন্দির |
|
মন্দিরের শিখর |
|
গর্ভ গৃহের চিত্র, দু পাশে সংঘ গুরু ও গুরু-মাতার মূর্তি |
|
সংঘ গুরু মতিলাল রায় |
তথ্য সূত্র :
১) হুগলি জেলার দেব দেউল : সুধীর কুমার মিত্র
২) মৃত্যুঞ্জয়ী : তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক প্রকাশিত
৩) প্রবর্তক সংঘের লেখা ফ্লেক্স
-------------------------------------------
আমার ইমেল : shyamalfpb@gmail.com প্রয়োজনে যোগাযোগ করতে পারেন।
--------------------------------------------