শনিবার, ৭ নভেম্বর, ২০১৫

Raghabeswar Shib Temple, Dignagar, Nadia

        রাঘবেশ্বর  শিব  মন্দির,  দিগনগর, নদিয়া                     

 শ্যামল  কুমার  ঘোষ


              শিয়ালদহ-কৃষ্ণনগর  রেলপথে  কৃষ্ণনগর  শেষ  স্টেশন।  কলকাতা  থেকে  রেলপথে  দূরত্ব  ৯৯  কি মি।  কৃষ্ণনগর  থেকে  ১১  কি. মি.  দূরে  ৩৪  নং  জাতীয়  সড়কের  পশ্চিম  দিকের  একটি  গ্রাম  দিগনগর।  দিগনগরের  পূর্বের  নাম  ছিল  দীর্ঘিকানগর। 

              নদিয়ারাজ-প্রতিষ্ঠাতা  ভবানন্দ  মজুমদারের  পৌত্র (  কৃষ্ণচন্দ্রের  বৃদ্ধপ্রপিতামহ )  রাজা  রাঘব  রায় ( রাজত্বকাল  ১৬৩২ - ১৬৮৩  খ্রিষ্টাব্দ )  মাটিয়ারী  থেকে  রেউই-এ  ( বর্তমান  কৃষ্ণনগর )  রাজধানী  স্থানান্তরিত  করার  পর,  কৃষ্ণনগর  থেকে   শান্তিপুর  পর্যন্ত  একটি  রাস্তা  তৈরি  করেন  এবং  জনসাধারণের  জলকষ্ট  নিবারণের  জন্য  ২০  হাজার  টাকা  ব্যয়ে  বর্তমান  দিগনগরে  এক  বিশাল  দিঘি  খনন  করেন।  দিঘি  বা  দীর্ঘিকা  থেকে  স্থানের  নাম  হয়  দীর্ঘিকানগর।  দিঘির  পূর্ব  দিকে  রাজা  রাঘব  একটি  সুন্দর  অট্টালিকা  ও  কাছাকাছি  দুটি  মন্দির  নির্মাণ  করেন।  একটি  মন্দির  বর্তমানে  বিধ্বস্ত।  অপরটি  এখনও  মোটামুটি  ভাল  অবস্থায়  আছে।  এটি  নদিয়া  জেলার  টেরাকোটা  মন্দিরগুলির  মধ্যে  অন্যতম।  মন্দিরে   ব্ল্যাক  বেসল্টের  তৈরী  'রাঘবেশ্বর'  শিবলিঙ্গ  নিত্য  পূজিত।  মন্দিরটি  একটি  উঁচু  ভিত্তি  বেদির  উপর  স্থাপিত।  বাংলা  চারচালা  রীতিতে  তৈরী  মন্দিরটিতে  দক্ষিণ,  পূর্ব  ও  পশ্চিম  দিকে  মোট  তিনটি  দরজা।  দরজার  দুপাশে  দুটি  করে  ছোট  ছোট  থাম  এবং  একটি  করে  কারুকার্য  করা  খিলান। 


রাঘবেশ্বর  শিবমন্দির 

              মন্দিরের  পশ্চিমের  দেওয়ালে  বাঁকানো  কার্নিসের  নিচে  শ্লেট  পাথরে  উৎকীর্ণ  প্রতিষ্ঠা-লিপিটি  নিম্নরূপ : 


             
              শ্লোকটির  অর্থ  হল,  ১৫৯১  শকে  ( ১৬৬৯ খ্রীষ্টাব্দে )  পবিত্র  রত্নাকরসদৃশ,  দ্বিজশ্রেষ্ঠ,  ভূমিপালকের  প্রধান  ও  ধীরস্বভাব  শ্রীযুত  রাঘব  স্বচ্ছতরঙ্গমালা  ও  নির্মল  জলের  ধারা  সমুজ্জ্বল  দিঘি  খনন  করে  তার  তীরে  সুরম্য  মন্দিরে  শিবকে  প্রতিষ্ঠা  করেন।  এখানে  সোম = ১,  নব = ৯, ইষু ( বাণ )=৫  এবং  চন্দ্র = ১  ধরে  অঙ্কের  বামাগতি  নিয়মে  প্রতিষ্ঠাকাল  ১৫৯১  শকাব্দ ( ১৬৬৯  খ্রিষ্টাব্দ )।  
              
              এই  মন্দিরে  টেরাকোটা  অলংকরণগুলির  আধিক্য  পশ্চিম  দেওয়ালে  ( উল্লেখ  করা  যেতে  পারে  যে  মন্দিরের  পশ্চিম  দিকে  রাস্তা ), তারপর  দক্ষিণ  দেওয়ালে।  পূর্ব  দিকের  দেওয়ালে  কিছু  ফুল  ছাড়া  অন্য  টেরাকোটা  নেই  এবং  দেওয়ালের  খিলানটিও  বর্তমানে  ভগ্ন।  উত্তর  দিকের  দেওয়াল  পলস্তারা  আবৃত।  ভিত্তিবেদি-সংলগ্ন  দুটি  অনুভূমিক  সারির  নিচের  সারিতে  টেরাকোটায়  জমিদার  বা  রাজার  শিবিকারোহণে  যাত্রা  এবং  সামনে-পিছনে  ঘোড়সওয়ার  ও  লোকলস্কর,  অশ্বারোহী  শিকারী,  খোল-করতাল  সহযোগে  হরিনাম  সংকীর্তন,  হাতির  পিঠে  সওয়ার,  মিথুনদৃশ্য,  গড়গড়ায়  তামাক  সেবন  প্রভৃতি  সমাজচিত্র   উৎকীর্ণ  আছে । উপরের  সারিতে  একটানা  হংস পংক্তির  দৃশ্য।  পশ্চিম  দিকের  প্রবেশ  পথের  খিলানের  ওপরের  চারপাশে  আটচালা  প্রতীক   শিবালয়  ও  তারমধ্যে  শিবলিঙ্গ।  লক্ষণীয়  হল,  দক্ষিণদিকের  দেওয়ালে  দ্বারপথের  খিলানের  ওপরের   চারপাশে   আটচালা  প্রতীক  মন্দিরের  মধ্যে  মাত্র  দুটি  শিবলিঙ্গ  বাকি  সব  মুসলমান  যোদ্ধা।  প্রবেশ  পথের  উপরে  ও  দুপাশে  কুলঙ্গিতে  নিবদ্ধ  দুই  সারি  মূর্তির  মধ্যে  দশাবতার,  কৃষ্ণলীলার  বিভিন্ন  দৃশ্য  যথা  কৃষ্ণরাধিকা, বস্ত্রহরণ,  কালীয়দমন  প্রভৃতিই  প্রধান।  এছাড়া  রাম, বলরাম,  বৃষবাহন  শিব,  প্রহরী,  সৈনিক,  সন্ন্যাসী  প্রভৃতি  মূর্তির  সমারোহ।  একটি  ফলকে  ডানপায়ের  ওপর  বাঁ  পা  রেখে  দণ্ডায়মান  এক  নারীমূর্তি।  তার  পাশে  একটি  হরিণশিশু।  যার  পোশাকি  নাম  'শালভঞ্জিকা'।  এ  মন্দিরে  বিশেষত্ব  হল,  প্রচুর  উৎকৃষ্ট  নকশি  কাজ,  যা  নদিয়ার  খুব  কম  মন্দিরেই  দেখা  যায়।  মন্দিরের  পোড়ামাটির  মূর্তিগুলির  সুক্ষ্ম  কাজ  এই  শতকে  নির্মিত  ভাস্কর্যকলার  বৈশিষ্ট  বহন  করে।  আরেকটি  উল্লেখযোগ্য  হল,  প্রবেশপথের  নিচে  চৌকাঠ  হিসাবে  মোটা  ও  ভারী  কাল  পাথরের  ব্যবহার।  বর্তমানে  মন্দিরটি  পশ্চিমবঙ্গ  সরকার  কর্তৃক  সংরক্ষিত। 

              দিগনগরে  রবীন্দ্রনাথের  দিদি  থাকতেন।  তাঁর  বড়  বোন  সৌদামিনীর  সঙ্গে  এখানকার  যাদবচন্দ্র  গঙ্গোপাধ্যায়ের  পুত্র  সারদাপ্রসাদের  বিবাহ  হয়।  রবীন্দ্রনাথ  এখানে  কয়েকবার  এসেছিলেন।

              দিগনগরে  যেতে  হলে  শিয়ালদহ  থেকে  লালগোলা  প্যাসেঞ্জার  বা  কৃষ্ণনগর  লোকালে  উঠুন।  নামুন  কৃষ্ণনগরে।  স্টেশন  থেকে  বাসে  বা  রিকশায়  বাসস্ট্যাণ্ডে  পৌঁছান।  সেখান  থেকে  শান্তিপুরগামী  বাসে  পৌঁছে  যান  দিগনগরে।  স্টপেজ  থেকে  পশ্চিম  দিকে  কিছুটা  হাঁটলে  পৌঁছে  যাবেন  মন্দিরে।



রাঘবেশ্বর  শিবমন্দিরের  মাঝের  অংশ 

শিবমন্দিরের  শিখর  দেশ 

পশ্চিম  দিকের  দরজার  খিলানের  উপরের  কাজ

দক্ষিণ  দিকের  দরজা

দক্ষিণ  দিকের  দরজার  খিলানের  উপরের  কাজ 

রাঘবেশ্বর  শিবমন্দিরের  প্রতিষ্ঠাফলক

ভিত্তিবেদি-সংলগ্ন  টেরাকোটায়  সমাজচিত্র - ১

ভিত্তিবেদি-সংলগ্ন  টেরাকোটায়  সমাজচিত্র - ২

ভিত্তিবেদি-সংলগ্ন  টেরাকোটায়  সমাজচিত্র - ৩

ভিত্তিবেদি-সংলগ্ন  টেরাকোটায়  সমাজচিত্র - ৪

মন্দিরের  একদিকের  কোনাচ 

কোনাচের  টেরাকোটার  অলংকরণ 

কুলুঙ্গিতে  নিবদ্ধ  টেরাকোটার  অলংকরণ - ১ 

কুলুঙ্গিতে  নিবদ্ধ  টেরাকোটার  অলংকরণ - ২

কুলুঙ্গিতে  নিবদ্ধ  টেরাকোটার  অলংকরণ - ৩

কুলুঙ্গিতে  নিবদ্ধ  টেরাকোটার  অলংকরণ - ৪

কুলুঙ্গিতে  নিবদ্ধ  টেরাকোটার  অলংকরণ - ৫

কুলুঙ্গিতে  নিবদ্ধ  টেরাকোটার  অলংকরণ - ৬

কুলুঙ্গিতে  নিবদ্ধ  টেরাকোটার  অলংকরণ - ৭

কুলুঙ্গিতে  নিবদ্ধ  টেরাকোটার  অলংকরণ - ৮

কুলুঙ্গিতে  নিবদ্ধ  টেরাকোটার  অলংকরণ - ৯

কুলুঙ্গিতে  নিবদ্ধ  টেরাকোটার  অলংকরণ - ১০

কুলুঙ্গিতে  নিবদ্ধ  টেরাকোটার  অলংকরণ - ১১

রাঘবেশ্বর  শিবলিঙ্গ 


 সহায়ক  গ্রন্থাবলি  :
        ১.  বাংলার  মন্দির  স্থাপত্য  ও  ভাস্কর্য  :  প্রণব  রায় 
        ২.  নদিয়া  জেলার  পুরাকীর্তি মোহিত  রায়  (তথ্য-সংকলন  ও  গ্রন্থনা )

             -------------------------------------------
            আমার  ইমেল :  shyamalfpb@gmail.com   প্রয়োজনে  যোগাযোগ  করতে  পারেন।

           -----------------------------------------                               

২টি মন্তব্য:

  1. এখানে যাওয়ার আরও একটা পথ আছে, শিয়ালদহ থেকে শান্তিপুর লোকালে শান্তিপুর পৌঁছে, রেলগেট থেকে কৃষ্ণনগর গামী বাসে দিগনগর। ১৫ মিনিটের পথ।

    উত্তরমুছুন
  2. প্রত্যেককে দিগনগরে আসার আমন্ত্রণ রইলো ।

    উত্তরমুছুন