বৃহস্পতিবার, ৩১ মে, ২০১৮

Lakshmi Janardan Temple, Kulteghori, Hooghly, West Bengal

            
শ্রীশ্রী  লক্ষ্মী  জনার্দন  মন্দির,  গুপ্তপাড়া,  কুলতেঘরী,  হুগলি 

শ্যামল  কুমার  ঘোষ 


            হাওড়া-তারকেশ্বর  রেলপথে  হাওড়া  থেকে  তারকেশ্বর   ২১  তম  রেলস্টেশন।  শেওড়াফুলি  থেকে  দ্বাদশ  স্টেশন।  রেলপথে  হাওড়া  থেকে  দূরত্ব  ৫৭  কিমি।  তারকেশ্বর  থেকে  চার / পাঁচ  কিমি  দূরের  একটি  গ্রাম  কুলতেঘরী।  তারকেশ্বর  থেকে  বাসে  এখানে  যাওয়া  যায়।  গ্রামে  স্থানীয়  গুপ্ত  পরিবার  কর্তৃক  প্রতিষ্ঠিত  লক্ষ্মী  জনার্দনের  মন্দির  উল্লেখযোগ্য। 

               সামান্য  উঁচু  ভিত্তিবেদির  উপর  স্থাপিত,  ত্রিখিলান  প্রবেশপথবিশিষ্ট,  অলিন্দযুক্ত,  দক্ষিণমুখী  ও  বাংলা  আটচালা  শৈলীর  মন্দির।  মন্দিরের  গর্ভগৃহে  ঢোকার  একটিই  দরজা।  সামনের  ও  পূর্ব  দিকের  দেওয়াল  'টেরাকোটা  অলংকরণে  অলংকৃত।  গুপ্ত  পরিবার  থেকে  জানা  গেল,  মন্দিরটি  অনেকটা   বসে  গেছে।  আগে  মন্দিরে  ওঠার  সাত / আটটি  সিঁড়ি  ছিল।  এখন  মাত্র  দুটি  সিঁড়ি  আছে।  মন্দিরের  সামনের  দুটি  পূর্ণ  স্তম্ভে,  দেওয়াল  সংলগ্ন  দুটি  অর্ধ  স্তম্ভে,  তিনটি  খিলানের  উপরে  ও  বর্গাকার  কুলুঙ্গিতে  পোড়া-মাটির   প্রচুর  টেরাকোটা  অলংকরণ  আছে।  মন্দিরে  যে  প্রতিষ্ঠা-ফলক  আছে  তাতে  কয়েকটি  সাল   উল্লেখ  আছে।  প্রথমটি  অষ্পষ্ট।  দ্বিতীয়টি   ১৭১৪  শকাব্দ  ( ১৭৯২ খ্রিষ্টাব্দ )  বা  ১১৯৯  বঙ্গাব্দ।  তৃতীয়টি   ১৭৫৬   শকাব্দ  ( ১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দ )  বা  ১২৪১  বঙ্গাব্দ।  তাহলে  ধরে  নেওয়া  যায়  যে  মন্দিরটির  প্রতিষ্ঠা-কাল  দ্বিতীয়টি  বা  তার  আগের।  দ্বিতীয়  বা  তৃতীয়টি  সংস্কার -কাল।  আরও  দুটি  সাল  উল্লেখ  করা  আছে  তা  আরও  পরের  অর্থাৎ  সংস্কারের  সময়  লেখা  হয়েছে।  মন্দিরের  সামনের  দেওয়ালের  টেরাকোটার  বিষয় : রামরাবণের  যুদ্ধ,  কৃষ্ণের  বাল্যলীলা,  পর্তুগিজ  যুদ্ধজাহাজ,  বন্দুক  হাতে  সাহেব,  বকরাক্ষস  বধ,  পুতনা  বধ,  সপরিবারে  দুর্গা,  হরগৌরী,  দুই  সখীসহ  কৃষ্ণ,  রথে  অভিজাত  ব্যক্তি  এবং  কুলুঙ্গির  মধ্যে  বিভিন্ন  মূর্তি  ইত্যাদি।  পূর্ব  দিকের  দেওয়ালে  দু-একটি  মূর্তি,  বেশ  কয়েকটি  বড়  ফুল  ও  তিনটি  খিলানের  উপর  ফুলকারি  নকশা  আছে।  তিনটি খিলানের  নিচে  আছে  তিনটি  ভরাট  করা  দরজা।  গর্ভগৃহের  দরজার   খিলানের  উপর  আছে  ফুলকারি  নকশা।  গর্ভগৃহে  শ্রীশ্রী লক্ষ্মী  জনার্দন  ( শালগ্রাম  শিলা )  নিত্য  পূজিত।  এই  মন্দিরটি  আমি  নরেন্দ্রনাথ  ভট্টাচার্য  লিখিত  " হুগলী  জেলার  পুরাকীর্তি "  গ্রন্থে  পাই  নি।  Google  Map-এ  কয়েকজনের ( সুমন্ত্র,  শুভঙ্কর,  অর্ক  ও  শৈবাল )  দেওয়া  এই  মন্দিরের  ছবি  দেখে  এর  হদিশ  পাই।  তাঁদের  ধন্যবাদ।  মন্দিরটির  পরিদর্শন  তারিখ : ২৩.১০.২০১৭ 
             

লক্ষ্মী  জনার্দন  মন্দির 

মন্দিরের  সামনের  বিন্যাস 

মন্দিরের  সামনের  ত্রিখিলান  বিন্যাস 
       
  মাঝের  খিলানের  উপরের  কাজ 

মাঝের  খিলানের  উপরের  কাজ ( বড়  করে ) 

বাঁ  দিকের  খিলানের  উপরের  কাজ 

ডান  দিকের  খিলানের  উপরের  কাজ 

মন্দিরের  একটি  পূর্ণ  স্তম্ভ    

মন্দিরের   আর   একটি  পূর্ণ  স্তম্ভ  

ভিত্তিবেদি  সংলগ্ন  'টেরাকোটা'র   কাজ - ১ 

ভিত্তিবেদি  সংলগ্ন  'টেরাকোটা'র   কাজ - ২ 

সপরিবারে দুর্গা  
ভিত্তিবেদি  সংলগ্ন  'টেরাকোটা'র   কাজ - ৩

ভিত্তিবেদি  সংলগ্ন  'টেরাকোটা'র   কাজ - ৩ক 

ভিত্তিবেদি  সংলগ্ন  'টেরাকোটা'র   কাজ - ৩খ 

হরগৌরী,  কৃষ্ণ  ও  অন্য  চিত্র 

হরগৌরী

দুই  গোপীসহ   কৃষ্ণ  

অভিবাদন 

যুদ্ধ  দৃশ্য -১

যুদ্ধ  দৃশ্য -২

কৃষ্ণের জন্ম 
শিশু কৃষ্ণের যমুনা নদী পার 
পুতনা  বধ 

বাঁকানো  কার্নিসের  নিচের  কাজ 


প্রতিষ্ঠাফলক 

কুলুঙ্গির  মধ্যের  কাজ - ১

কুলুঙ্গির  মধ্যের  কাজ - ২

কুলুঙ্গির  মধ্যের  কাজ - ৩
কুলুঙ্গির  মধ্যের  কাজ - ৪

কুলুঙ্গির  মধ্যের  কাজ - ৫

কুলুঙ্গির  মধ্যের  কাজ - ৬

কুলুঙ্গির  মধ্যের  কাজ - ৭

মন্দিরের  কোনাচ 

পূর্ব  দিকের  দেওয়ালে  খিলানের  উপরের  কাজ 
গর্ভগৃহের  দরজার  খিলানের  উপরের  কাজ   

            -------------------------------------------
            আমার  ইমেল :  shyamalfpb@gmail.com   প্রয়োজনে  যোগাযোগ  করতে  পারেন।

           --------------------------------------------                                                                                          

বুধবার, ৩০ মে, ২০১৮

Nilkantheshwari Temple,Gondalpara,Chandannagar,Hooghly,West Bengal


নীলকন্ঠেশ্বরী  মন্দির,  গোন্দলপাড়া, চন্দননগর, হুগলি 

শ্যামল  কুমার  ঘোষ 

            হাওড়া-ব্যাণ্ডেল  রেলপথে  চন্দননগর  ত্রয়োদশতম  রেলস্টেশন।  রেলপথে  হাওড়া  থেকে  দূরত্ব  ৩২.৬  কিমি।  চন্দননগর  নামটি  সম্ভবত  'চন্দ্র  নগর'  নাম  থেকে  এসেছে।  কেউ  কেউ  বলেন  যে  গঙ্গানদী  এখানে  চন্দ্রাকার  বলে  প্রথমে   'চন্দ্রনগর'  এবং  তার  থেকে  'চন্দননগর'  হয়েছে।  আবার  অনেকের  মতে  একসময়  এখানে  চন্দনকাঠের  বড়  বাণিজ্যকেন্দ্র  ছিল।  তা  থেকে  'চন্দননগর'  নামটির  উদ্ভব।  এক  সময়  শহরটি  ফরাসীদের  অধিকারে  থাকার  জন্য  নাম  হয়  'ফরাসডাঙা'।

            চন্দননগরের  গোন্দলপাড়ায়  নীলকন্ঠেশ্বরীর  মন্দির  ১৮৩৫  শকাব্দে,  ইং  ১৯১৩ সালের  ১০ ই  জুলাই  ( ১৩২০ বঙ্গাব্দের  ২৬ শে  আষাঢ় )  শিবনাথ  মুখোপাধ্যায়  ও  তাঁর  স্ত্রী  শরৎকুমারী  দেবী  প্রতিষ্ঠা  করেন।  উঁচু  ভিত্তিবেদির  উপর  স্থাপিত,  দক্ষিণমুখী,  সমতল  কার্নিসযুক্ত  পঞ্চশিখর  মন্দির।  বাংলায়  ইংরেজ  রাজত্ব  প্রতিষ্ঠিত  হওয়ার  পর  বাংলার  মন্দির  শিল্পে  ইউরোপীয়  প্রভাবের  সূত্রপাত  হয়  এবং  তার  ফলে  বাংলা  মন্দিরে  বক্র  চালের  পরিবর্তে  সমতল  ছাদের  সৃষ্টি  হয়।  গর্ভগৃহের  ছাদের  নিচের  দিকটি  গম্বুজাকৃতি।  দ্বিতলের  পঞ্চশিখরযুক্ত  কক্ষটি  গর্ভগৃহের  আবরণ  হিসাবে  নির্মিত।  উপরের  কক্ষের  দুপাশে  দুটি  চালামন্দির  স্থাপন  করা  হয়েছে।  এর  নিচে  দুটি  ছোট  ছোট  ঘর।  বাঁদিকের  ঘরে  বাণেশ্বর  নামক  কষ্টিপাথরের  শিবলিঙ্গ  নিত্য  পূজিত।  ডান  দিকের  ঘরটিতে  বর্তমানে  কোন  বিগ্রহ  নেই।  মন্দিরের  সামনে  উঠোন  ও  তিন  দিকে  চকমিলানো  অনেকগুলি  ঘর।  উঠোনে  কয়েকটি  গাছ।  চূড়াগুলি  যদি  না  থাকতো  তবে  মন্দিরের  পরিবর্তে  এটিকে  বাসভবন  বলে  মনে  হত।  মন্দিরটি  নির্মাণে  প্রায়  এক  লক্ষ  টাকা  ব্যয়  হয়।   

            মন্দিরের  গর্ভগৃহে  কষ্টিপাথরের  নীলকন্ঠেশ্বরী  কালীর  সুন্দর  মূর্তি  নিত্য  পূজিত। 

            মন্দিরটি  পরিদর্শনের  তারিখ :  ২৩.০৯.২০১৭       


নীলকন্ঠেশ্বরীর  মন্দির

মন্দিরের  শিখর - ১

মন্দিরের  শিখর - ২

নীলকন্ঠেশ্বরী  বিগ্রহ - ১

নীলকন্ঠেশ্বরী  বিগ্রহ - ২


 সহায়ক  গ্রন্থ :

                 ১)  হুগলি  জেলার  দেব  দেউল :  সুধীর  কুমার  মিত্র 

                                                                       ******
               পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য কালী মন্দির সম্বন্ধে জানতে নিচের লিংকে ক্লিক করুন / লিংকের উপর আঙুল দিয়ে টোকা দিন :  

          -------------------------------------------

            আমার  ইমেল :  shyamalfpb@gmail.com   প্রয়োজনে  যোগাযোগ  করতে  পারেন।

           --------------------------------------------


মঙ্গলবার, ২৯ মে, ২০১৮

Nabaratna Temple, Boraichanditala, Goswami Ghat,Chandannagar, Hooghly,West Bengal


নবরত্ন  মন্দির,  বোড়াইচণ্ডীতলা,  গোস্বামী ঘাট,  চন্দননগর,  হুগলি 

শ্যামল  কুমার  ঘোষ 


            হাওড়া-ব্যাণ্ডেল  রেলপথে  চন্দননগর  ত্রয়োদশতম  রেলস্টেশন।  রেলপথে  হাওড়া  থেকে  দূরত্ব  ৩২.৬  কিমি।  চন্দননগর  নামটি  সম্ভবত  'চন্দ্র  নগর'  নাম  থেকে  এসেছে।  কেউ  কেউ  বলেন  যে  গঙ্গানদী  এখানে  চন্দ্রাকার  বলে  প্রথমে   'চন্দ্রনগর'  এবং  তার  থেকে  'চন্দননগর'  হয়েছে।  আবার  অনেকের  মতে  একসময়  এখানে  চন্দনকাঠের  বড়  বাণিজ্যকেন্দ্র  ছিল।  তা  থেকে  'চন্দননগর'  নামটির  উদ্ভব।  এক  সময়  শহরটি  ফরাসীদের  অধিকারে  থাকার  জন্য  নাম  হয়  'ফরাসডাঙা'।

            অষ্টাদশ  শতকের  শেষ  ভাগে  চন্দননগরের  বোড়াইচণ্ডীতলায়  দেবীচরণ  সরকার  নামে  এক  বিশিষ্ট  কায়স্থ  বাস  করতেন।  সেই  সময়  চন্দননগরে  প্রায়  দেড়  হাজার  তাঁতির  বাস  ছিল।  তাঁদের  তৈরি  লুঙ্গি  বিদেশে  চালান  দিয়ে  তিনি  প্রচুর  ধন  উপার্জন  করেন।  দানে  তিনি  মুক্ত  হস্ত  ছিলেন।  দেবীচরণের  মৃত্যুর  পর  তাঁর  ছোট  ভাই  বিশ্বনাথ  সরকারও  অপুত্রক  অবস্থায়  অকালে  মারা  যান।  স্বামীর  মৃত্যুর  পর  বিশ্বনাথের  স্ত্রী  গৌরমণি  সরকার  ১৮০৮  খ্রীষ্টাব্দে  ( ১৭৩০  শকাব্দে )  তাঁর  সমস্ত  সম্পত্তি  দেবসেবায়  নিয়োজিত  করেন।  তিনি  গোস্বামী  ঘাটে  গঙ্গা-তীরে  ভবতারিণী  কালীর  মন্দির  ও  দু-পাশে  ছটি  করে  বারটি  শিবমন্দির  স্থাপন  করেন।  এই  সব  দেবগৃহ  নির্মাণে  তাঁর  এক  লক্ষ  টাকা  এবং  মন্দির  প্রতিষ্ঠার  জন্য  আরও  পঞ্চাশ  হাজার  টাকা  ব্যয়  হয়।  এছাড়া  বিগ্রহের  সেবাপূজার  জন্য  তিনি  এক  লক্ষ  টাকা  গচ্ছিত  রাখেন।  গৌরমণি  'সরকার  বংশ'-এ  কনিষ্ঠা  বধূ  ছিলেন  বলে  তিনি  সকলের  কাছে  'কনে  বৌ'  নামে  পরিচিত  ছিলেন।  তাই  সেকালে  এই  মন্দির  জন  সাধারণের  কাছে   'কনে  বৌয়ের  মন্দির'  বলে  পরিচিত  ছিল।

            এই  দানশীলা  মহিলা  অকালে  পারলোকগমন  করলে  এই  মন্দির  সরকার  পরিবারের  এক  কুলাঙ্গার  রাখালদাস  সরকারের  হাতে  আসে।  রাখালদাস  ছিলেন  নাস্তিক।  মদ্যপান  ছাড়াও  লম্পট  বলে  তাঁর  কুখ্যাতি  ছিল।  ভবতারিণী  কালীর  দুটি  হাত  ভেঙে  গেলে  তিনি  দেবীকে  গঙ্গায়  বিসর্জন  দেন।  তারপর  মন্দিরের  শিবগুলি  লোপাট  হয়ে  যায়।  রাখাল  সরকার  ঠাকুরের  দেবোত্তর  সম্পত্তি  নাড়ুয়া  নিবাসী  জনৈক  থাকচন্দ্র  সিংহ  রায়  কে  বিক্রি  করে  দেন।  তাঁর  কাছ  থেকে  ঠাকুরের  জমি  কেনেন  রাজেন্দ্রনাথ  গঙ্গোপাধ্যায়।  ১৮১৮  খ্রীষ্টাব্দে  গঙ্গার  গতি  পরিবর্তনের  ফলে  একটি  শিবমন্দির  ভেঙে  যায়।  এইভাবে  অনেকবার  মন্দিরের  সম্পত্তির  হাত  বদল  হয়।  কিন্তু  আর্থিক  ক্ষতি,  সাংসারিক  বিপর্যয়,  আন্তীয়  বিয়োগ  প্রভৃতির  কারণে  কেউই  এই  সম্পত্তি  ভোগ  করতে  পারেন  নি।  ১৯১৫  খ্রীষ্টাব্দে  ব্রজেন্দ্রনাথ  গোস্বামী  মন্দিরের  জমিতে  একটি  টালিখোলা  করেন।  কিন্তু  তিনিও  অকৃতকার্য  হন।  তারপর  সিদ্ধেশ্বর  কুমার  মন্দিরগুলি  কেনেন।   তিনি  নবরত্ন  মন্দির  সংলগ্ন  তিনটি  মন্দির  বাদে  বাকি  শিবমন্দিরগুলি  ভেঙে  ফেলে  তার  ইঁট  দিয়ে  সুরকি  প্রস্তুত  করেন।  কিন্তু  মন্দিরের  সুরকি  কেউ  না  কেনায়  হারানচন্দ্র  ঘোষ  মাত্র  একশ  টাকায়  সমস্ত  কিনে  নেন।  তারপর  নবরত্ন  ও  অবশিষ্ট  শিবমন্দিরগুলি  ভেঙে  ফেলতে  মনস্ত  করলে  এক  সাধু  ব্যথিত  চিত্তে  তাকে  মন্দির  ভাঙতে  নিষেধ  করেন।  হারান  সাধুকে  বলেন,  'আপনার  যখন  এত  দরদ  তখন  আপনি  কিনে  নিন।'  তেজদীপ্ত  সাধু  ভিক্ষালব্ধ  অর্থে  মন্দিরগুলি  কিনে  নেন  এবং  মন্দিরগুলি  রক্ষা  করেন।  এই  সাধুর  নাম  শ্রীমৎ  নৃসিংহদাস  বাবাজী।       

            উঁচু  ভিত্তিবেদির  উপর  প্রতিষ্ঠিত  বিশালাকায়  মন্দিরটি  সোজা  কার্নিসযুক্ত  নবরত্ন  শৈলীর।  বাংলায়  ইংরেজ  রাজত্ব  প্রতিষ্ঠিত  হওয়ার  পর  বাংলার  মন্দির  শিল্পে  ইউরোপীয়  প্রভাবের  সূত্রপাত  হয়  এবং  তার  ফলে  বাংলা  মন্দিরে  বক্র  চালের  পরিবর্তে  সমতল  ছাদের  সৃষ্টি  হয়।  এছাড়া  মন্দিরকে  সৌন্দর্যমণ্ডিত  করার  জন্য  মন্দিরের  সামনে  স্থাপন  করা  হয়  বড়  বড়  বিদেশী  স্তম্ভ।  এ  মন্দিরের  ক্ষেত্রেও  তা  করা  হয়েছে।  মন্দিরের  সামনে  মন্দির  লাগোয়া  একটি  নাটমন্দির  নির্মাণ  করা  হয়েছে।  এটি  হয়তো  পরবর্তী  কালে  সংযোজিত।  ছয়টি  সিঁড়ি  দিয়ে  ওঠবার  পর  মন্দির  প্রবেশের  তিনটি  দরজা।  মন্দিরের  সামনে  সিঁড়ির  দু'  ধারে  দুটি  রেখ-দেউল  মন্দিরটির  সৌন্দর্য  বৃদ্ধিতে  সহায়তা  করেছে।  এগুলি  অবশ্য  পরবর্তীকালে  সংযোজিত  হয়েছে।           
           
              বাবাজী  নৃসিংহজীর  কাছ  থেকে  এই  মন্দির  প্রবর্তক  সংঘের  প্রতিষ্ঠাতা  মতিলাল  রায়ের  হাতে  আসে।  জাতি-তপস্যার  মহাতীর্থরূপে  'শ্রীমন্দির'  গড়ে  তোলার  সংকল্প  নেন  মতিলাল। কোন  বিগ্রহ  প্রতিষ্ঠা  না  করে  মহাশিল্পী  আচার্য  অবনীন্দ্রনাথ  ঠাকুর  শব্দ-ব্রহ্ম  'মহাপ্রণব' -  রজত  কলসের  গায়ে  সুবর্ণের  বিগ্রহ  ওঁ-কার  স্থাপনের  পরিকল্পনা  করেন।  ১৯২৩  খ্রীষ্টাব্দে  পুণ্য  অক্ষয়  তৃতীয়ার  দিন  দেশনায়ক  বিপিনচন্দ্র  পালের  সভাপতিত্বে  এবং  নেতাজি  সুভাষচন্দ্র  বসুর  উপস্থিতিতে  মন্দিরটি   জাতীয়  মন্দিরে  পরিণত  হয়  এবং  জাতির  উদ্দেশ্যে  সমর্পিত  হয়।  ১৯৩৭  খ্রীষ্টাব্দে  মন্দির  থেকে  সর্বস্বীকৃত  প্রতীকটি  চুরি  যায়।  শিল্পী  সুন্দর  শর্মা  সংঘের  প্রতীকের  যে  রূপ  দেন  সেটি  ১৯৩৮  খ্রীষ্টাব্দে  অক্ষয়  তৃতীয়ার  দিন  জাতীয়  মন্দিরে  স্থাপন  করা  হয়।  ১৯৪৩  খ্রীষ্টাব্দে  ৬ ই  মে,  অক্ষয়  তৃতীয়ার  দিন  এই  শ্রীমন্দিরে  'তৃবৃৎ  লিঙ্গ  সংযুক্ত'  প্রণব  প্রতিষ্ঠা  করা  হয়। এটিও  নির্মাণ  করেছিলেন  শিল্পী  সুন্দর  শর্মা। বেদান্তের  বাণী  অনুযায়ী  অনল ( অগ্নি  বা  তেজ ),  জল ( অপ্ )  ও  ক্ষিতি  নিয়ে  তৃবৃৎকরণ।   তেজের  সৃষ্টিশক্তি,  ক্ষিতির  স্থিতিশক্তি  এবং  অপে  বিশ্বের  লয় -  এই  তিন  শক্তি  নিয়েই  প্রণব।  এখানে  উল্লেখ্য,  জন্মবিপ্লবী  ও  প্রবর্তক  সংঘের  প্রতিষ্ঠাতা  ছিলেন  মতিলাল  রায়।  তাঁর  জন্ম  ৬ই  জানুয়ারি,  ১৮৮২।  ঈশ্বর  গুপ্ত  সম্পাদিত  'প্রভাকর'  পত্রিকায়  তিনি  কবিতা  লিখতেন। তিনি  নাটকও  রচনা  করেছিলেন।  এক  সময়  নবদ্বীপে  যাত্রাদল  গঠন  করে  তিনি  বহু  অর্থ  ও  খ্যাতি  অর্জন  করেন।  'সীতা  হরণ',  'নিমাই  সন্ন্যাস'  ইত্যাদি  গীতিনাট্য  রচনা  করেন।  প্রবর্তক  সংঘের  সংগঠনের  কাজে  তিনি  অসামান্য  প্রতিভার  পরিচয়  দেন।  এক  সময়  তাঁর  সংঘ  ছিল  বিপ্লবীদের  আশ্রয়স্থল।  ১০ই  এপ্রিল,  ১৯৫৯  এই  দেশনায়কের  মৃত্যু  হয়। 

            বর্তমানে  মন্দির  চৌহদ্দির  মধ্যে  প্রবর্তক  সংঘ  পরিচালিত  দুঃস্থ  ও  অনাথ  শিশুদের  জন্য  একটি  ছাত্রাবাস  আছে। 

          মন্দিরটি  পরিদর্শনের  তারিখ :  ১৪.০৯.২০১৭ 


নবরত্ন  মন্দির 

মন্দিরের  শিখর
   
গর্ভ  গৃহের  চিত্র, 
দু  পাশে  সংঘ  গুরু  ও  গুরু-মাতার  মূর্তি 

সংঘ  গুরু  মতিলাল  রায় 


     তথ্য  সূত্র :
                  ১)  হুগলি  জেলার  দেব  দেউল :  সুধীর  কুমার  মিত্র 
                  ২)  মৃত্যুঞ্জয়ী :  তথ্য  ও  সংস্কৃতি  বিভাগ,  পশ্চিমবঙ্গ  সরকার  কর্তৃক  প্রকাশিত 
                  ৩)  প্রবর্তক  সংঘের  লেখা  ফ্লেক্স 

          -------------------------------------------

            আমার  ইমেল :  shyamalfpb@gmail.com   প্রয়োজনে  যোগাযোগ  করতে  পারেন।

           --------------------------------------------


মঙ্গলবার, ২২ মে, ২০১৮

Baba Buroraj Temple, Jamalpur, Purbasthali, Purba bardhaman, West Bengal


বাবা  বুড়োরাজ  মন্দির,  জামালপুর,  পূর্ব  বর্ধমান

শ্যামল  কুমার  ঘোষ  


          " বুড়োশিবের  'বুড়ো'  আর  ধর্মরাজের  'রাজ',  দু'য়ে  মিলে  'বুড়োরাজ'।  সাধারণত  'নাথ'  বা  'ঈশ্বর'  যোগ  করেই  শিবের  নামকরণ  হয়  এদেশে,  'রাজ'  দিয়ে  হয়  না।  জামালপুরে  হয়েছে,  কারণ  সেখানে  দুই  দেবতা  মিলিত  হয়ে  সর্বজনপূজ্য  লোকদেবতায়  পরিণত  হয়েছেন।" - বিনয়  ঘোষ।

             হাওড়া-কাটোয়া  বা  শিয়ালদহ-কাটোয়া  রেলপথে  পাটুলি  একটি  স্টেশন।  হাওড়া  থেকে  দূরত্ব  ১২৭  কিমি। পাটুলি  স্টেশন  থেকে  ৭  কিমি  দূরের  একটি  গ্রাম  জামালপুর।  পাটুলি  স্টেশন  থেকে  ট্রেকারে  বা  টোটোতে  এই  গ্রামে  যাওয়া  যায়।  পাটুলির  আগের  স্টেশন  বেলেরহাট।  সেখান  থেকেও  টোটোতে  এই  গ্রামে  যাওয়া  যায়।  জামালপুরের   গ্রামদেবতা  'বুড়োরাজ'  এই  অঞ্চলে  খুবই  প্রসিদ্ধ।  আর  শুধু  এই  অঞ্চলে  কেন,  ভাগীরথীর  দুই  তীরের  এক  বিস্তীর্ণ  অঞ্চলের  আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার  তিনি  প্রাণের  দেবতা।  এই  অঞ্চলের  অনেকেই  সন্তানের  অন্নপ্রাশনে  শিশুর  মুখে  অন্ন  তুলে  দেওয়ার  আগে  বুড়ারাজের  প্রসাদ  খাওয়ান।  

            মহামহোপাধ্যায়  হরপ্রসাদ  শাস্ত্রীর  মতে  ধর্মরাজ  হলেন   বুদ্ধদেবের  প্রতিভূ।  তাঁর  মতে  বৌদ্ধদের  ত্রিরত্ন  ( বুদ্ধ,  ধৰ্ম  ও  সংঘ )  মতবাদ  থেকে  ধর্মপূজার  উৎপত্তি।  আবার  অনেকের  মতে  সূর্য  পূজা  থেকে  ধর্ম  পূজার  উদ্ভব  হয়েছে।  পৌরাণিক  বিবরণে  যমকে  ধর্মরাজ  বলা  হয়েছে।  সে  যাই  হোক,  ধর্মরাজ  বা  ধর্মঠাকুর  রাঢ়ের  তথাকথিত  নিম্নশ্রেণিভুক্ত  সমাজের  ( বাউড়ি,  বাগদি,  হাড়ি,  ডোম  ইত্যাদি )  গ্রামদেবতা।  ধর্মঠাকুরের  অধিকাংশ  সেবায়েত-পুরোহিতও  ডোম,  বাগদি  ইত্যাদি  অব্রাহ্মণ  জাতির  মধ্যে  সীমাবদ্ধ।                  

            বাবা  বুড়োরাজের  আবির্ভাব  সম্বন্ধে  একটি  কিংবদন্তি  প্রচলিত  আছে।  জামালপুরের  পাশের  গ্রাম  নিমদহ।  এই  নিমদহে  তখন  অনেক  সচ্ছল  গোপের  বাস  ছিল।  এই  সচ্ছল  গোপদের  মধ্যে  যদু  ঘোষ  ছিলেন  অন্যতম।  তাঁর  শতাধিক  গরু-মোষ  ছিল।  এদের  মধ্যে  অনেক  গুলি  ছিল  বেশ  দুধালো।  গাইগুলোর  মধ্যে  শ্যামলী  ছিল  সবার  উপরে।  রাখালরা  গরু-মোষ  গুলোকে  রোজ  নিমদহের  আশপাশের  মাঠে  ও  বনে-জঙ্গলে  চরাতে  নিয়ে  যেত।  বেশ  কিছু  দিন  থেকে  দেখা  গেল,  শ্যামলীর  দুধ  কর্পূরের  মত  উবে  যাচ্ছে।  রাখালদের  উপর  যদু  ঘোষের  সন্দেহ  গিয়ে  পড়ল।  ফলে  রাখালদের  চাকরি  গেল।  কিন্তু  তাতেও  শ্যামলীর  দুধ  চুরি  বন্ধ  হল  না।  শেষে  যদু  একদিন  গরুর  অনুসরণ  করে  দেখলেন,  জামালপুরের  জঙ্গলের  দিকে  শ্যামলী  ছুটে  চলেছে।  জঙ্গলের  এক  জায়গায়  গিয়ে  শ্যামলী  স্থির  হয়ে  দাঁড়াল  আর  তার  বাঁট  থেকে  ফোয়ারার  মত  দুধ  ঝরে  পড়তে  লাগল।

            যদু  বিস্ময়বিমূঢ়  হয়ে  গ্রামের  ব্রাহ্মণঠাকুর  মধুসূদন  চট্টোপাধ্যায়ের  কাছে  ছুটলেন।  যদুর  কাছ  থেকে  সব  কথা  শুনে  চাটুজ্যে  মশায়  জঙ্গলে  গিয়ে  দেখলেন,  সব  দুধ  একটি  পাথরের  মাথায়  গিয়ে  জমছে।  সব  দেখে  ব্রাহ্মণঠাকুর  বাড়িতে  ফিরলেন।  সেই  রাতেই  তিনি  স্বপ্ন  দেখলেন।  স্বপ্নে   কে  যেন  বলছে,  "আমি  এখানে  আছি।  আমার  পূজা  কর।  কিন্তু  আমার  পূজায়  কোন  আড়ম্বর  থাকবে  না।  গরীবের  কুঁড়ের  মতই  হবে  আমার  মন্দির।" 

            জঙ্গল  পরিষ্কার  করে  বুড়োরাজের  পুজোর  ব্যবস্থা  হল।  গ্রামের  বাগদিরা  ঘর  তৈরি  করে  দিলেন।  চাটুয্যে  মশায়  পুজো  করেন,  আর  যদু  অদূরে  হাত  জোড়  করে  বসে  থাকেন।  পুজোর  পর  চাটুয্যে  মশায়  বলেন,  ' যদু,  তোর  পুজোই  আগে  করলাম,  ভগবান  তোকেই  আগে  কৃপা  করেছেন  কিনা !'  যেহেতু  যদুর  বাড়ি  ছিল  নিমদহ  গ্রামে  সেজন্য  আজও  নিমদেহের  পুজো  বুড়োরাজের  কাছে  সবার  আগে  নিবেদন  করা  হয়।

            এই  কাহিনী  জামালপুরের  বিশেষত্ব  নয়।  পশ্চিমবঙ্গের  প্রায়  সব  অনাদিলিঙ্গ  শিবের  উৎপত্তি  প্রসঙ্গে  এই  একই  কিংবদন্তি  শোনা  যায়।  জামালপুরের  বিশেষত্ব  হল,  বৈশাখী  পূর্ণিমায়  বুড়োরাজের  পূজা  ও  গাজন  হয়।  শিবের  গাজন  হয়  চৈত্র  সংক্রান্তিতে।  বৈশাখী  পূর্ণিমায়  ধর্মরাজের  গাজন  হয়।  তাহলে  বুড়োরাজ  শিব,  না  ধর্মরাজ ?  এর  উত্তরে  বলতে  হয়  বুড়োরাজ  একাধারে  যেমন  ধর্মরাজ,  আবার  তিনি  শিবও  বটে।  বুড়োরাজের  পূজা  ও  আচার-অনুষ্ঠান  দেখে  মনে  হয়  অনেক  আগে  এখানে  ধর্মরাজের  পূজার  প্রচলন  ছিল।  কোন  কারণে  পূজা  বন্ধ  হয়ে  যায়।  পরে  শিবলিঙ্গের  মাধ্যমে  পূজার  প্রকাশ  ঘটে  যার  বহিরঙ্গের  রূপটি  শিবের  হলেও  আচার-অনুষ্ঠান  ধর্মরাজের।  বিনয়  ঘোষের  কথায়  বলতে  হয়,  "ধর্মরাজ  থেকে  বুড়োশিবে  রূপান্তরিত  হবার  মধ্যপথে  সংস্কার  ও  প্রথার  টানে,  আপোষ  করে  রয়েছেন  বুড়োরাজ।  ব্রাহ্মণ  পুরোহিতের  দূরদর্শিতা  ও  হিন্দুধর্মের  অন্তর্নিহিত  উদারতার  জন্যই  এই  আপোষ  সম্ভব  হয়েছে।"  এই  আপোষের  বড়  উদাহরণ  হল :   বুড়োরাজের  মূল  নৈবিদ্য  মাঝখান  দিয়ে  দাগ  কেটে  ২ ভাগ  করা  হয়।  তার  ১  ভাগ  শিবকে  ও  অপর  ভাগ  ধর্মরাজকে  নিবেদন  করা  হয়।  

            পূর্বমুখী  বুড়োরাজের  মন্দিরটি  ইঁট-পাথরের  মন্দির  নয়।  মন্দিরের   চাল  খড়ের  চারচালা  ও  মেঝে  মাটির।  পাকা  মন্দির  করা  দেবতার  নিষেধ  বলে  কথিত।  জনশ্রুতি,  পূর্বে  ঘরের  চাল  ছাওয়ার  কিছুদিন  পর  নাকি  মাথাটি  ফাঁক  হয়ে  যেত।  মন্দিরের  সামনে  চাঁদনি  আকৃতির  নাটমন্দির।  বহুকাল  আগে  পাটুলির  জমিদার  চারুচন্দ্র  সাহা  রোগ  মুক্তির  পর  এই  নাটমন্দিরটি  নির্মাণ  করে  দিয়েছিলেন।  পরে  অবশ্য  কয়েক  বার  সংস্কার  করা  হয়। 

            প্রতি  বৎসর  বৈশাখ,  জ্যৈষ্ঠ  ও  মাঘ  মাসের  পূর্ণিমা  তিথিতে  বুড়োরাজের  বিশেষ  উৎসব  ও  মেলা  উপলক্ষে  প্রচুর  লোকের  সমাবেশ  হয়।  এর  মধ্যে  বৈশাখী  পূর্ণিমায়  লোক  সমাগম  হয়  বেশি।  বৈশাখ  মাসের  মেলাটি  পূর্বে  এক  মাস  ধরে  চলত।  বর্তমানে  সব  মেলার  মত  এ  মেলারও  স্থায়িত্ব  কমেছে।  এখনও  নিমদহ  থেকে  পুজো  এলে  তবে  অন্যের  পুজো  হয়।  এখন  যদু  ঘোষের  বংশের  আর  কেউ  বেঁচে  নেই।  গ্রামবাসীরাই  এখন  পুজো  পাঠান।  চারিদিকে  হাজার  হাজার  লোক  লাঠি-রামদা-টাঙি  হাতে  পাঁঠা  নিয়ে  মেলায়  হাজির  হয়।  অধিকাংশই  হল  গোপ  ও  বাগদি।  বলিষ্ঠ  চেহারা।  মন্দির  ছাড়াও  সমগ্র  অঞ্চলটিতে  ঘট  স্থাপন  করে  বুড়োরাজের  পূজা  করা  হয়।  পাঁঠা  বলির  সংকেত  পেলেই  যে  যেখানে  থাকে  বলি  দিতে  শুরু  হয়।  এখন  মন্দিরের  পিছনের  মাঠেই  বলি  হয়।  সাধারণত  মন্দিরের  সামনে  বলি  হয়  না।  শিবের  নামেও  বলি  উৎসর্গ  করা  হয়  না।  আগে  পাঁঠা  কাড়াকাড়ি  হত।  খুন-জখমও  হত।  তাই  মানতকারীরা  দলবদ্ধ  ভাবে  সশস্ত্র  হয়ে  আসতেন।  এখনও  সেই  রেওয়াজ  চলে  আসছে। পাঁঠা  কাড়াকাড়ি  আজ  বর্বরতা  বলে  মনে  হলেও  একটা  সময়  সেটা  বীরত্বের  খেলা  বলে  গণ্য  হত।  যে  দলপতি  বেশি  পাঁঠা  কেড়ে  ফিরতে  পারতেন  গ্রামে  তাঁকে বিজয়ীর  সম্মান  দেওয়া  হত।  মনে  রাখতে  হবে,  তখন  এঁরা  জমিদার-সামন্তদের  অধীনে  লাঠিয়াল-সৈনিকের  কাজ  করতেন।  পাঁঠা  কাড়াকাড়ি  উপলক্ষে  লাঠিখেলা  হত  এবং  সেটা  ধর্মরাজের  উৎসবের  একটা  প্রধান  অঙ্গ।  এখনও  মন্দিরের  সামনে  কিছু  কিছু  লাঠি  খেলা  হয়। 

             বাবা  বুড়োরাজের  প্রথম  সেবায়ত-পূজক  মধুসূদন  চট্টোপাধ্যায়ের  শেষ  বংশধর  হারাধন  চট্টোপাধ্যায়ের  কোন  পুত্র  সন্তান  ছিল  না।  তাঁর  একমাত্র  কন্যার  বিয়ে  হয়  নদিয়া  জেলার  ধর্মদা  গ্রামের  গুপিনাথ  বন্দ্যোপাধ্যায়ের  সঙ্গে।  এঁদের  বাড়ির  মন্দিরে  আজও  গোপীনাথ  পূজিত  হন।  এই  গুপিনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের  বংশধরগণ  বাবা  বুড়োরাজের  বর্তমান  সেবায়ত-পুরোহিত।  ধর্মদা  গ্রামের  গোপীনাথ  মন্দিরের  কথা  জানতে  লিংকে  ক্লিক  করুন :  গোপীনাথ  মন্দির, ধর্মদা, নদিয়া  

            মৃণাল  কান্তি  বন্দ্যোপাধ্যায়  তাঁর  গ্রন্থে   বুড়োরাজের  বিভিন্ন  ব্রত  পালনের  নিয়মগুলি  বর্ণনা  করেছেন।  শিব  ও  ধর্মরাজের  উপাসনায়  সোমবার  হল  উৎকৃষ্ট  বার।  ফল  বা  হবিষ্যান্ন  আহার  করে  বারমাসে  বারটি  শুক্লপক্ষের  সোমবার  পালন  করতে  হয়।  কঠিন  ব্যাধি  থেকে  মুক্তিলাভের  জন্য  অনেকে  বাবার  পুকুরে  স্নান  করে,  আহার-নিদ্রা  ত্যাগ  করে,  কাপড়ে  মুখ  ঢেকে  বাবার  মন্দিরের  সামনে  পড়ে  থাকেন।  একে  হত্যদান  বা  হত্যেদান  বলে।  এই  ভাবে  একাগ্র  চিত্তে  বাবাকে  ডাকলে  ভক্ত  প্রত্যাদেশ  পান।  আবার  সন্তান  বা  অন্য  কিছুর  কামনায়  ভক্তরা  মন্দিরের  পাশের  অশ্বত্থ  গাছের  ডালে  নুড়ি  বেঁধে  দেন।  কামনা   পূর্ণ  হলে  বাবার  পুজো  দিয়ে  নুড়ি  খুলে  দিয়ে  যান।  অনেকে  মনস্কামনায়  বাবার  মাথায়  ফুল  চড়ান।  বাবার  মাথা  থেকে  ফুল  পড়লে  মনস্কামনা  সম্পর্কে  নিশ্চিত  আদেশ  জানা  যায়।  কঠিন  ব্যাধি  থেকে  মুক্তির  জন্য  অনেকে  দন্ডি  কাটার  মানসিক  করেন।  রোগমুক্তির  পর  বাবার  পুকুরে  স্নান  করে  ভিজা  কাপড়ে  মন্দির  পর্যন্ত  দন্ডি  কাটেন।  শিবরাত্রিতে  মন্দিরে  সারারাত  পূজাপাঠ  ও  ভক্ত  সমাগম  হয়।  শিবরাত্রি  পালনকারী  আগেরদিন  নিরামিষ  খাবেন।  রাতে  চার  প্রহরে  চারবার  বা  একবারেই  চারবার  পুজো  করবেন।  প্রথম  প্রহরে  দুধ,  দ্বিতীয়  প্রহরে  দই,  তৃতীয়  প্রহরে  ঘি  ও  চতুর্থ  প্রহরে  মধু  দিয়ে  স্নান  করিয়ে  যথাবিহিত  নিয়মে  পুজো  করতে  হয়।  পরের  দিন  ব্রাহ্মণকে  খাইয়ে  পারণ  করতে  হয়। 

            শিবের  গাজনের  ন্যায়  বুড়োরাজের  গাজন  চৈত্র  মাসে  হয়  না,  বৈশাখী  পূর্ণিমায়  বুড়োরাজের  গাজন  হয়।  জাতি-ধৰ্ম-নির্বিশেষে  যে  কেউ  সন্ন্যাসী  হতে  পারেন।  মূল  সন্ন্যাসীকে  এক  মাস  ধরে  হবিষ্যান্ন  খেতে  হয়।  অন্যান্যেরা  পূর্ণিমার  পাঁচদিন  বা  সাতদিন  আগে  কামায়।  কামানের  দিন  একবেলা  নিরামিষ  আহার  ও  পরদিন  উত্তরীয়  পরিধান  উপলক্ষে  হবিষ্যান্ন  খান।  ত্রয়োদশীতে  সারাদিন  উপবাস  করে  পুজোর  পর  রাতে  ফলাহার  গ্রহণ।  এদিন  গাজন  বের  হয়।  চতুর্দ্দশীর  দিন  সারাদিন  উপবাস  থেকে  সন্ধ্যায়  বাণ  ফোঁড়ানর  পর  তরল  খাদ্য  গ্রহণ  করা  যায়।  পূর্ণিমার  দিন  নিরামিষ  খেতে  হয়।  প্রতিপদের  দিন  সেবায়েত  ও  মূলসন্ন্যাসী  উত্তরীয়  খুলে  দেওয়ার  পর  বাবার  মাখায়  সন্ন্যাসীদের  মঙ্গলকামনায়,  মূল  সন্ন্যাসীর  উপস্থিতিতে  ফুল  চাপান  হয়।  বাবার  মাথা  থেকে  ফুল  পড়লে  সন্ন্যাসীদের  ক্রিয়ার  পরিসমাপ্তি  ঘটে।     

            যাত্রী,  ভক্ত  ও  মানসিকদাতারা  অনেকেই  বুড়োরাজের  কাছে  আসেন  প্রধানত  রোগমুক্তির  আশায়।  লোকের  বিশ্বাস  যক্ষা,  মৃগী,  বাত,  অম্লশূল  ইত্যাদি  যে  কোন  কঠিন  ব্যাধি  বুড়োরাজের  কৃপায়  সেরে  যায়।  তাঁদের  আরও  বিশ্বাস,  বহু  ক্ষেত্রে  চিকিৎসকগণ  রোগ  সারাতে  অপারগ  হলেও  বাবার  কৃপায়  রোগমুক্তি  ঘটে। 

            শেষে  বিনয়  ঘোষের  কথায়  বলি, " ব্রাহ্মণরা  যখন  ধর্মরাজকে  হিন্দু দেবতামণ্ডলীর  মধ্যে  গ্রহণ  করেছেন,  তখন  বিরোধের  পথে  না  গিয়ে  আপোষের  পথে  অগ্রসর  হয়েছেন। বুড়োরাজ  তার  উজ্জ্বল  দৃষ্টান্ত।  একই  পাত্রে  নৈবিদ্য  গ্রহণ  করছেন  শিব  ও  ধর্মরাজ।  কোন  দীনতা  নেই,  সংকীর্ণতা  নেই।  নৈবিদ্যর  মধ্যে  একটি  দাগই  উভয়  দেবতার  কাছে  গ্রহণযোগ্য  করার  পক্ষে  যথেষ্ট।  শিবের  কাছে  বলিদান  হয়  না।  অবশ্য  শিবের  কাছে  শক্তি  থাকেন  এবং  শক্তির  কাছে  বলিদানের  বিধি  আছে।  কিন্তু  শূয়োর  বলি  নয়।  বুড়োরাজের  মন্দিরের  একপাশে  হাড়িরা  শূয়োর  বলি  দেয়,  কোন  বাধা  নেই।  'বুড়োরাজে'র  জয়ধ্বনি  করেই  গোপ  ও  ব্যঘ্রক্ষত্রিয়রা  হাজার  হাজার পাঁঠাবলি  দেয়,  তাতেও  কোন  বাধা  নেই।  গ্রাম-গ্রামান্তরের  মুসলমানরাও  পাঁঠা  মানত  করে,  কোন  সংস্কার  নেই।  সর্বসংস্কারমুক্ত  উদারতার  প্রতীক  ' বুড়োরাজ '  বাংলার  নিজস্ব  মানবধর্মের  প্রতিমূর্তি। "  

           ( এই  প্রবন্ধ  রচনায়  বাবা  বুড়োরাজের  একজন  সেবায়েত  অশোক  ব্যানার্জী  আমাকে  কিছু  কিছু  তথ্য  দিয়ে  সাহায্য  করেছেন।  তাঁকে  ধন্যবাদ। ) 

            মন্দিরটি  পরিদর্শনের  তারিখ :  ২৮.০১.২০১৮                
                                                           
বুড়োরাজ  মন্দিরের  তোরণদ্বার 

তোরণদ্বারের  সামনের  দিক 

বুড়োরাজের  মন্দির

বাবা  বুড়োরাজের  ভোগ  নিবেদন 
বাবা  বুড়োরাজ 

মনস্কামনায়  নুড়ি  বাঁধা 
           
সহায়ক  গ্রন্থাবলী :
  ১)  পশ্চিমবঙ্গের  সংস্কৃতি : বিনয়  ঘোষ 
  ২)  বর্ধমান :  ইতিহাস  ও  সংস্কৃতি ( ৩ য়  খন্ড ) :  যজ্ঞেশ্বর  চৌধুরী 
 ৩)  শিব  মাহাত্ম  ও  শ্রীশ্রীবুড়োরাজ  কথামৃত : মৃনাল  কান্তি  বন্দোপাধ্যায় ( নির্মল )

                                                      

           -------------------------------------------

            আমার  ইমেল :  shyamalfpb@gmail.com   প্রয়োজনে  যোগাযোগ  করতে  পারেন।

           --------------------------------------------