শ্রী শ্রী শ্যামচাঁদ  জিউ  মন্দির, বড়বাজার, শান্তিপুর, নদিয়া
   শ্যামল  কুমার  ঘোষ 
            শান্তিপুরের  বড়বাজারের  শ্যামচাঁদ  পাড়ায়  অবস্থিত  পাঁচ  খিলানবিশিষ্ট,  অলিন্দযুক্ত,  দক্ষিণমুখী,  বাংলা  আটচালা  শ্রেণীর  শ্যামচাঁদ  মন্দিরটি  পশ্চিমবঙ্গের  এ  শ্রেণীর  বৃহতম   মন্দিরগুলির  অন্যতম।  উঁচু  পাদপীঠের  উপর  নির্মিত  এ  মন্দিরের  দৈর্ঘ্য,  প্রস্ত,  ও  উচ্চতা  যথাক্রমে  ৫২ ফুট ( ১৫.৮ মি. ),  ৩৬ ফুট ( ১১ মি. )  ও  আনুমানিক  ৭০ ফুট ( ২১.৩ মি. )। 
             শান্তিপুর  কুঠিরপাড়া  নিবাসী  তন্তুবায়  বংশীয়  গোবিন্দ  দাস  খাঁ  অদ্বৈত  প্রভুর  সঙ্গে  শ্রীহট্ট  থেকে  শান্তিপুরে  এসে  বসতি  স্থাপন  করেছিলেন।  এই  বংশের  রামগোপাল  খাঁ  চৌধুরী  ১৬৪৮  শকাব্দে ( ১৭২৬  খ্রিস্টাব্দে )  শ্যামচাঁদ  মন্দির  প্রতিষ্ঠা  করেন।  ( আসলে  খাঁ  চৌধুরীরা  চার  ভাই  রামগোপাল,  রামজীবন,  রামচরণ  ও  রামভদ্র  এই  মন্দির  প্রতিষ্ঠা  করেন।  রামগোপাল  বড়ো  বলে  তাঁর  নাম  বলা  হয়।  বিগ্রহের  পাদ-পদ্মাসনে  উক্ত  চার  জনেরই  নাম  খোদিত  আছে। )  মন্দিরের  সামনের  পশ্চিম  প্রান্তীয়  খিলানের  নিচে  নিবদ্ধ  পাথরের  প্রতিষ্ঠা-ফলকের  পাঠ  নিম্নরূপ :
" শ্রীমতঃ শ্যামচন্দ্রস্য মন্দিরং পূর্ণতামিয়াত্ ।
বসুবেদার্ত্তুশুভ্রাংশু সংখ্যয়া গণিতে শকে ।। ১৬৪৮ "
অর্থাৎ, ১৬৪৮ শকে ( ১৭২৬ খ্রিস্টাব্দে ) শ্যামচাঁদের মন্দির সম্পূর্ণ হল। বসু = ৮, বেদ = ৪, ঋতু = ৬, শুভ্রাংশু = ১ ধরে অঙ্কের বামা গতি নিয়মানুসারে প্রতিষ্ঠাকাল ১৬৪৮ শকাব্দ। এই মন্দিরটির পাঁচটি 'চূড়া'। 'চূড়া' অর্থে এখানে 'রত্ন' বা 'শিখর' নয়। কলস, আমলক ( আমলকি ফলের মত চারিদিকে শলাকার মত খাঁজকাটা পাথরের বলয় ) ও চক্রের দ্বারা চূড়া নির্ধারিত হয়েছে।
মন্দিরটির টেরাকোটা-সজ্জা যৎসামান্য। খিলানগুলির উপরের চারিদিকে বাংলা আটচালা শ্রেণীর প্রতীক শিবালয় এবং তার মধ্যে শিবলিঙ্গ। উপরের কার্নিসের নিচে দুই প্রস্থে পোড়ামাটির ফুল এবং দু পাশের উপরে-নিচেও একই রকমের ফুল মন্দিরটির অঙ্গ সজ্জারূপে বিন্যস্ত হয়েছে। খিলানগুলির উপরের প্রস্থে পঙ্খের কাজ ছাড়া কোনো পোড়ামাটির কাজ নেই। শ্যামচাঁদের এই মন্দিরটির সঙ্গে নদিয়া জেলার কাঞ্চনপল্লীতে অবস্থিত কৃষ্ণরায়ের আটচালা মন্দিরটির আকার ও আয়তনের দিক থেকে অনেক সাদৃশ্য আছে। শ্যামচাঁদের এই মন্দিরটির অবস্থা এখনও বেশ ভালো। মন্দিরের গর্ভগৃহের দরজার কাঠের কাজও খুব সুন্দর। যদিও অযত্নে ও রঙের প্রলেপে তা অনেকটাই ম্লান।
মন্দির প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে খাঁ'রা এখানে এক বিরাট অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। মন্দির প্রতিষ্ঠার সময় যে বিরাট মহাযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয় তাতে কাশী-কাঞ্চী-দ্রাবিড়-মথুরা, অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গ প্রভৃতি স্থান থেকে পণ্ডিতমণ্ডলী আহূত হন এবং এ জন্য ৮/৯ লক্ষ টাকা ব্যয় হয়। মন্দির নির্মাণে ব্যয় হয় দু লক্ষ টাকা এবং এক লক্ষ মুদ্রা নজরানা নিয়ে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পিতা নদিয়ারাজ রঘুরাম রায় ( রাজত্বকাল ১৭১৫-২৮ খ্রিস্টাব্দ ) সভাগৃহের প্রধানতম স্থানে উপবেসন করেন। শ্যামচাঁদের মূর্তিটি কষ্টিপাথরে নির্মিত। আদি রাধিকা মূর্তিটি ছিল স্বর্ণ নির্মিত। এখানে উল্লেখ্য, সেই সময়ের সমাজ রানি রাসমণির মতো রামগোপালকেও নিজের নামে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করতে দেয়নি। শ্রী শ্রী শ্যামচাঁদ বিগ্রহ নদিয়ারাজের নামে এবং রাধিকা বিগ্রহ গুরু রাধাবল্লভ গোস্বামীর ( উড়িয়া গোস্বামী বাড়ির আদি পুরুষ ) নামে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার সময় যে সমস্ত ব্রাহ্মণপণ্ডিতগণ আগমণ করেন তারমধ্যে গুপ্তিপাড়ার শ্রী শ্রী বৃন্দাবন চন্দ্র মঠের শ্রীপাদ সমকানন্দ পণ্ডিতমণ্ডলীসহ উপস্থিত ছিলেন।
শ্রী শ্রী শ্যামচাঁদ বিগ্রহ প্রতিদিন পূজিত হন। খাঁচৌধুরীদের পারিবারিক বিগ্রহ রাধাকান্তও এখানে উপাসিত। মন্দির প্রাঙ্গণে ঢুকতে বাঁ দিকে একটি ছোট মন্দিরে একটি শিবলিঙ্গ এবং অপর একটি ছোট মন্দিরে শ্রীগৌরাঙ্গ, শ্রীনিত্যানন্দ ও শ্রীঅদ্বৈতের মূর্তি আছে। মন্দিরের ডান দিকে একটি ছোট্ট ঘরে মাধবেন্দ্রপুরীর মূর্তি আছে। মন্দিরের সামনে একটি বড়ো নাটমন্দির আছে। মন্দির প্রাঙ্গণ পাঁচিল দিয়ে ঘেরা।
১৩৫৭ বঙ্গাব্দে শান্তিপুরের সাহেব পাড়ার শ্রীমতী হরিমতি দাসী শ্যামচাঁদের সাবেক সিংহাসনটির সংস্কার ও ধাতুমণ্ডিত করে দেন। রামগোপাল খাঁর পুত্র রাজকৃষ্ণ খাঁর পত্নী গোবিন্দমণি দাসী বাল্যবিধবা হওয়ায় নিঃসন্তান ছিলেন। তিনি তাঁর ভাইপো হরিদাস প্রামাণিককে উইল করে শ্যামচাঁদ মন্দিরের সেবায়ত নিযুক্ত করে যান। বর্তমানে 'শ্রী শ্রী রাধাশ্যামচাঁদ মন্দির পরিচালন কমিটি' কর্তৃক বিগ্রহের সেবাকার্য পরিচালনা করা হয়। পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক মন্দিরটি সংরক্ষিত। মন্দিরটি সকাল ৬ টা ৩০ মিনিটে খোলে এবং রাত্রি ৮ টা ৩০ মিনিটে বন্ধ হয়। নিত্যভোগের সময় দুপুর ১২ টা ৩০ মিনিট। দক্ষিণার বিনিময়ে অন্নভোগের রসিদ সংগ্রহের সময় ৮ টা ৩০ মিনিট থেকে ৯ টা ৩০ মিনিট।
রাস পূর্ণিমা উপলক্ষে এই মন্দিরে চার দিন ব্যাপী ভক্তবৃন্দ দ্বারা হরিনাম সংকীর্তন হয় কিন্তু ভাঙ্গারাসের শোভাযাত্রায় এই বিগ্রহ অংশ নেন না। দোল পূর্ণিমার পরদিন অর্থাৎ, প্রতিপদে হয় শ্যামচাঁদের দোল। সেদিন শ্যামচাঁদ মন্দিরে হয় বিশেষ পূজা, ভোগ। চলে নাম সংকীর্তন। সন্ধ্যায় শ্যামচাঁদ জিউ নগর ভ্রমণে বেরিয়ে গুরু-গৃহ উড়িয়া গোস্বামী বাড়িতে যান। তাঁর নগর পরিক্রমা দেখতে রাস্তার দু'দিকে ভিড় উপচে পড়ে। উড়িয়া গোস্বামী বাড়ি পৌঁছে শ্যামচাঁদ জিউ 'ডালিধরা' অনুষ্ঠানে যোগ দেন। সেখানে সব বারোয়ারি পূজা কমিটি শ্যামচাঁদকে ডালি নিবেদন করে। সেই ডালিতে থাকে পাঁচ রকমের ফল, পৈতে সহ নানা সামগ্রী।
![]()  | 
| শ্রীশ্রী শ্যামচাঁদ  মন্দির ( বাঁ  দিক থেকে তোলা ) | 
![]()  | 
| শ্রীশ্রী শ্যামচাঁদ মন্দির ( ডান দিক থেকে তোলা ) | 
![]()  | 
| শ্রীশ্রী শ্যামচাঁদ  মন্দির ( সামনে  থেকে তোলা ) | 
![]()  | 
| মন্দিরের শিখর-দেশ | 
![]()  | 
| মন্দিরের পাঁচটি খিলান | 
![]()  | 
| মন্দিরের টেরাকোটার কাজ | 
![]()  | 
| মন্দিরের টেরাকোটা ও পঙ্খের কাজ | 
![]()  | 
| মন্দিরের একটি থাম | 
![]()  | 
| মন্দিরের একটি খিলানের উপরের কাজ | 
![]()  | 
| মন্দিরের প্রতিষ্ঠা-ফলক | 
![]()  | 
| গর্ভগৃহের সামনের খিলানের কাজ | 
![]()  | 
| গর্ভগৃহের কাঠের দরজার কাজ | 
![]()  | 
| শ্রীশ্রী শ্যামচাঁদ ও অন্যান্য বিগ্রহ | 
![]()  | 
| শ্রীশ্রী শ্যামচাঁদ ও রাধিকা বিগ্রহ | 
![]()  | 
| শ্রীশ্রী রাধাকান্ত ও রাধারানি বিগ্রহ | 
![]()  | 
| শ্রীপাদ মাধবেন্দ্রপুরীর মূর্তি | 
![]()  | 
| মন্দিরের শিবলিঙ্গ | 
![]()  | 
| শ্রীগৌরাঙ্গ,  শ্রীনিত্যানন্দ  ও  শ্রীঅদ্বৈতের  মূর্তি | 
            শান্তিপুরের  শ্রী শ্যামচাঁদ  মন্দিরে  যেতে  হলে  শিয়ালদহ  থেকে  শান্তিপুর  লোকাল  ধরুন ।  রেলপথে  শান্তিপুরের  দূরত্ব  ৯৩  কি. মি. ;  ট্রেনে  সময়  লাগে  আড়াই  ঘন্টা ।  স্টেশন  থেকে  রিকশায়  বা  টোটোতে  পৌঁছে  যান  বড়বাজারে  অবস্থিত   শ্রী শ্যামচাঁদ  মন্দির ।
            মন্দিরটি  পরিদর্শনের  তারিখ :  ২০.০২.২০১৬
সহায়ক গ্রন্থাবলি :
১. নদিয়া জেলার পুরাকীর্তি : মোহিত রায় ( তথ্য-সংকলন ও গ্রন্থনা )
২. বাংলার মন্দির স্থাপত্য ও ভাস্কর্য : প্রণব রায়
৩. শান্তিপুর-পরিচয় ( ১ম ভাগ ) : কালীকৃষ্ণ ভট্টাচার্য
--------------------------------
রামায়ণের ৭টি খণ্ডের ৬৪ টি উপাখ্যান ও ১৮৫ টি টেরাকোটা ফলকের আলোকচিত্র সংবলিত আমার লেখা এবং 'রা প্রকাশন' কর্তৃক প্রকাশিত বই 'বাংলার টেরাকোটা মন্দিরে রামায়ণ' প্রকাশিত হয়েছে। বইটির মুদ্রিত মূল্য - ৫৯৯ টাকা।
বইটি ডাক যোগে সংগ্রহ করতে হলে যোগাযোগ করুন : 9038130757 এই নম্বরে।কলকাতার কলেজস্ট্রিটের মোড়ে দুই মোহিনীমোহন কাঞ্জিলালের কাপড়ের দোকানের মাঝের রাস্তা ১৫, শ্যামাচরণ দে স্ট্রিটের উপর অবস্থিত বিদ্যাসাগর টাওয়ারের দু'তলায় 'রা প্রকাশনে'র দোকান। ওখান থেকে বইটি সংগ্রহ করতে পারেন। কোনও অসুবিধা হলে উপরোক্ত নম্বরে ফোন করতে পারেন।
            প্রকাশনীতে বইটি সেরা বইয়ের সম্মান স্বর্ণকলম ২০২৫ পেয়েছে ।



















Khub bhalo laglo
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
মুছুন