রাধাগোবিন্দ ও অন্যান্য মন্দির, গুড়বাড়ি, জেরুল, চোপা এবং মৌবেশিয়া, হুগলি
শ্যামল কুমার ঘোষ
হাওড়া-বর্ধমান কর্ড লাইনে গুড়াপ একটি রেলস্টেশন। হাওড়া থেকে গুড়াপ ১৮ তম রেলস্টেশন। রেলপথে হাওড়া থেকে দূরত্ব ৫৭.৪ কিমি। গুড়াপ-দশঘরা বাস রাস্তায় মৌবেশিয়া বা মৌবেশ একটি গ্রাম। গুড়াপ থেকে দূরত্ব ৬ কিমি। মৌবেশ মোড় থেকে মৌবেশ, চোপা, গুড়বাড়ি ও জেরুল, এই চারটি গ্রামের মন্দিরগুলি আজ আমরা দেখব। মৌবেশ মোড় থেকে যে দিকে মৌবেশ গ্রাম তার বিপরীত দিকের রাস্তার ২ কিমি দূরের গ্ৰাম গুড়বাড়ি। এই রাস্তা ধরে এগুলে কিছুটা দূরে ডান দিকে একটি রাস্তা চলে গেছে। এই রাস্তায় কিছুটা গেলে পড়বে চোপা গ্রাম। এখন চোপা গ্রামে না গিয়ে সোজা চলুন গুড়বাড়ি।
গুড়বাড়ি
গুড়বাড়ি গ্রামে শ্রীশ্রী রাধাগোবিন্দ জিউর বিরাট মন্দির ও দোলমঞ্চ খুবই দর্শনীয়। ১৭১১ শকাব্দে ( ১৭৮৯ খ্রীষ্টাব্দে ) রামনারায়ণ চৌধুরী এই দুটি প্রতিষ্ঠা করেন। বীরভূম জেলার কেন্দুবিল্বের নিকট সেনপাহাড়ি গ্রাম থেকে এঁরা এখানে এসেছিলেন। এই বংশের নিধিরাম রায় সম্রাট আকবরের কাছ থেকে চৌধুরী উপাধি পান। তিনি চার-পাঁচটি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। তিনি প্রভূত সম্পত্তি রেখে যান। রায়চৌধুরীদের দুটি বাড়িতে দুটি মন্দির। বড় বাড়িতে রামনারায়ণ প্রতিষ্ঠিত রাধাগোবিন্দ ও ছোট বাড়িতে ইন্দ্রনারায়ণ প্রতিষ্ঠিত লক্ষ্মীনারায়ণের মন্দির। 'টেকনো ইণ্ডিয়া'র সত্তম রায়চৌধুরী ছোট বাড়ির বংশধর। তিনি লক্ষ্মীনারায়ণের মন্দির নতুন করে নির্মাণ করে দিয়েছেন। আমার পরিদর্শনের সময় মন্দির বন্ধ থাকায় ছবি তোলা সম্ভব হয় নি।
রাধাগোবিন্দের মন্দির পাঁচ খিলান বিশিষ্ট একটি দালান। মন্দিরটি উঁচু ভিত্তিবেদির উপর স্থাপিত। মন্দিরের উপরে একটি শিখর আছে। মন্দিরে ওঠার দুদিকে দুটি সিঁড়ি। গর্ভগৃহের সামনে একটি একটি ঢাকা বারান্দা এবং তার সামনে আছে একটি রোয়াক। গর্ভগৃহে ঢোকার একটিই দরজা। গর্ভগৃহের সামনের দেওয়ালে একটি প্রতিষ্ঠাফলক আছে। গর্ভগৃহে গোবিন্দ ও রাধিকা বিগ্রহ নিত্য পূজিত। ১৪০২ সালের ৯ ই ফাল্গুন রাধাগোবিন্দ মন্দির ও বিগ্রহের ভার 'ওঙ্কার সেবক সঙ্গে'র হাতে অর্পণ করা হয়। ১৪০৬ সালে 'ওঙ্কার সেবক সঙ্গে'র পক্ষ থেকে মন্দিরটি সংস্কার করা হয়।
রাধাগোবিন্দ মন্দির, গুড়বাড়ি |
মন্দিরের শিখরদেশ |
মন্দিরের প্রতিষ্ঠাফলক |
রাধাগোবিন্দ-রাধিকা বিগ্রহ ও অন্যান্য চিত্র |
রাধাগোবিন্দ ও রাধিকা বিগ্রহ |
এই দালানবাড়ির বাইরে আছে দুটি আটচালা শিবমন্দির। একটি শিবমন্দিরের সংস্কার করার সময় 'টেরাকোটা' অপসারিত হয়েছে। অপরটি এখনও ভগ্নাবস্থায়। মন্দিরের সামনের দেওয়ালে সামান্য টেরাকোটার অলংকার বর্তমান। গর্ভগৃহে কাল পাথরের শিবলিঙ্গ নিত্য পূজিত।
শিবমন্দির |
খিলানের উপরের কাজ |
পাশেই রাধাগোবিন্দের দোলমঞ্চ। এই দোলমঞ্চ সম্বন্ধে অন্যত্র আলোচনা করেছি। রাধাগোবিন্দের দোলমঞ্চ সম্বন্ধে জানতে নিচের লিংকে ক্লিক করুন :
রাধাগোবিন্দের দোলমঞ্চ, গুড়বাড়ি
জেরুল
গুড়বাড়ি থেকে আরও ১ কিমি দূরে জেরুল গ্রাম। এই গ্রামে ঊনিশ শতকে নির্মিত স্থানীয় বন্দোপাধ্যায় বংশ প্রতিষ্ঠিত একটি আটচালা শিবমন্দির আছে। উঁচু ভিত্তিবেদির উপর স্থাপিত, দক্ষিণমুখী মন্দিরটির সামনের দেওয়ালে সামান্য টেরাকোটা অলংকরণ আছে। কিন্তু সংস্কারের সময় রঙের প্রলেপে সেই 'টেরাকোটা'র অনেকটাই আজ ম্লান। গর্ভগৃহে কাল পাথরের শিবলিঙ্গ নিত্য পূজিত।
শিবমন্দির, জেরুল |
মন্দিরের সামনের বিন্যাস |
খিলানের উপরের কাজ |
ভিত্তিবেদি সংলগ্ন 'টেরাকোটা'র কাজ |
এবার ফিরতি পথে চলুন যাই চোপা গ্রামে।
চোপা
এই গ্রামের ব্রাহ্মণ পাড়ায় স্থানীয় মুখোপাধ্যায় বংশের প্রতিষ্ঠিত ঢাকেশ্বরী মন্দির ও দুটি শিবমন্দির আছে। এছাড়া পাশেই দু-তিনটি ভগ্ন শিবমন্দির আছে।
আরও এগুলে স্থানীয় স্কুলের কাছে মজুমদার বংশের রামদেব প্রতিষ্ঠিত গোপীনাথের মন্দির আছে। গোপীনাথ মন্দিরের কাছে মজুমদারদের প্রতিষ্ঠিত একটি আটচালা শিবমন্দির বর্তমান। কয়েকবার সংস্কৃত মন্দিরটির খিলানের উপরে 'টেরাকোটা'র কাজ বর্তমান। গর্ভগৃহে কাল পাথরের শিবলিঙ্গ নিত্য পূজিত।
আটচালা শিবমন্দির |
খিলানের উপরের কাজ |
এই মন্দির থেকে আরও খানিকটা এগুলে বাঁশঝাড়ের মধ্যে মজুমদারদের দুটি পরিত্যক্ত পঞ্চরত্ন মন্দির চোখে পড়বে। এর একটিতে এখনও 'টেরাকোটা'র কাজ বর্তমান।
|
মন্দিরের খিলানের উপরের কাজ |
মন্দিরের এক দিকের কোনাচ |
মন্দিরের অপর দিকের কোনাচ |
চোপা গ্রাম থেকে এবার ফিরে চুলুন মৌবেশ মোড়ে। সেখান থেকে বাঁ দিকের রাস্তা ধরে একটু এগুলেই মৌবেশিয়া বা মৌবেশ গ্রাম।
মৌবেশিয়া / মৌবেশ
এই গ্রামে ঘোষবংশ প্রতিষ্ঠিত ঊনবিংশ শতাব্দির মধ্যভাগে নির্মিত একটি আটচালা শিবমন্দির আছে। উঁচু ভিত্তিবেদির উপর স্থাপিত মন্দিরটি পশ্চিমমুখী। মন্দিরটির সামনের দেওয়ালে খিলানের উপর 'টেরাকোটা' অলংকরণ আছে। কিন্তু সংস্কারের সময় রঙের প্রলেপে সেই 'টেরাকোটা' অনেকটাই ম্লান। গর্ভগৃহে কাল পাথরের শিবলিঙ্গ নিত্য পূজিত।
শিবমন্দির, মৌবেশ |
মন্দিরের সামনের বিন্যাস |
খিলানের উপরের কাজ |
শিবলিঙ্গ |
উপরোক্ত মন্দিরগুলিতে যেতে হলে হাওড়া থেকে কর্ড লাইনের বর্ধমান লোকাল ধরুন। নামুন গুড়াপ স্টেশনে। স্টেশন থেকে দশঘরা গামী ট্রেকারে উঠুন। নামুন মৌবেশিয়া বা মৌবেশ। সেখান থেকে টোটো বা রিকশায় মন্দিরগুলো দেখে নিন।
সহায়ক গ্রন্থাবলী :
১) হুগলি জেলার পুরাকীর্তি : নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য
২) হুগলি জেলার দেব দেউল : সুধীর কুমার মিত্র
-------------------------------------------
আমার ইমেল : shyamalfpb@gmail.com প্রয়োজনে যোগাযোগ করতে পারেন।
--------------------------------------------
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন