মঙ্গলবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১

Adi Chitteshwari Durga Temple, Khagendra Chatterjee Road, Cossipore, Kolkata

 আদি চিত্তেশ্বরী দুর্গা মন্দির, খগেন্দ্র চ্যাটার্জী  রোড, কাশীপুর, কলকাতা 

                   শ্যামল কুমার ঘোষ

             আদি চিত্তেশ্বরী দুর্গা মন্দির কলকাতার কাশীপুর অঞ্চলে  খগেন্দ্র চ্যাটার্জী রোডে 'গান-অ্যান্ড-শেল' কারখানার গেটের পাশে  অবস্থিত। দেবীমূর্তিটি প্রাচীন হলেও মন্দিরটি অপেক্ষাকৃত নবীন।প্রাচীন চিত্রপুর বা চিৎপুর অঞ্চলে চিত্রেশ্বর বা চিত্তেশ্বর নামে এক  দুর্ধর্ষ ডাকাত বাস করত। লোকের কাছে সে 'চিতে ডাকাত' নামে  পরিচিত ছিল। বহু বছর আগে চিতে ডাকাত নিম কাঠের এক  দেবীমূর্তি তৈরি করে তান্ত্রিক মতে পূজা করতে থাকে। চিত্রেশ্বর  বা চিত্তেশ্বর ডাকাতের পূজিত দেবী বলে লোকমুখে দেবীর নাম হয়  'চিত্রেশ্বরী' বা 'চিত্তেশ্বরী'। কিংবদন্তি এই যে, কলকাতা চিৎপুর  রোডের নাম এই দেবীর নাম থেকেই হয়েছে।  

             চিতে ডাকাতের মৃত্যুর পর এই দেবী মূর্তির আর কোনো  খোঁজ পাওয়া যায় না। পরে, নৃসিংহ ব্রহ্মাচারী নামে এক তান্ত্রিক  সন্ন্যাসি দেবী মূর্তিটি উদ্ধার করে একটি কুঁড়েঘরে রেখে দেবীর পূজা  শুরু করেন। শ্রীচৈতন্যদেবের অন্তরঙ্গ পার্ষদ বাসুদেব ঘোষের  বংশধর বর্ধমান জেলার কুলাহ গ্রামের জমিদার মনোহর ঘোষ ও  তাঁর পত্নী শেওড়াফুলি রাজবংশের কন্যা এই চিত্তেশ্বরীর মন্দির স্থাপন  করে দেন এবং দেবীর নামে ভূসম্পত্তি দান করেন। নৃসিংহ ব্রম্ভচারী  সেবায়েত হিসাবে দেবীর সেবা করতে থাকেন। পরে নামজাদা  জমিদার গোবিন্দরাম মিত্র নতুন মন্দির করে দেন। এই ভাবে চলতে  থাকে। কয়েক প্রজন্ম পর সেবায়েত শ্যামসুন্দর ব্রহ্মচারী বিবাহ  করেন। তাঁর ছিল দুই কন্যা, যাদুমণি ও ক্ষেত্রমণি। যাদুমণির কোনো  সন্তান ছিল না। ক্ষেত্রমণির বিবাহ হয় হালিশহরের সাবর্ণ রায়চৌধুরী  পরিবারে। সেই বংশের বংশধর কাশীশ্বর রায়চৌধুরী বর্তমান সেবায়েত।        

            চিত্তেশ্বরী দেবীমূর্তি হল একক দশভুজা মহিষাসুরমর্দিনী  দুর্গামূর্তি। এখানে দুর্গার সঙ্গে তাঁর পুত্রকন্যারা অনুপস্থিত।  দেবীমূর্তির সঙ্গে একটি বাঘের মূর্তি আছে, যা সুন্দরবনের  ব্যাঘ্রদেবতা দক্ষিণরায়ের প্রতিভূ। এই ব্যাঘ্র মূর্তি মনে করিয়ে দেয় যে  এক সময় এই স্থান জঙ্গলাকীর্ণ ছিল এবং বাঘেরও উপদ্রব ছিল।  

            সামান্য উঁচু ভিত্তিবেদির উপর স্থাপিত, দক্ষিণমুখী মন্দিরটি  সমতল ছাদবিশিষ্ট একটি দালান। মন্দিরের মাঝের একটি ঘরে দেবী  চিত্তেশ্বরী প্রতিষ্ঠিত ও নিত্য পূজিত। বাঁ দিকের একটি ঘরে শিবলিঙ্গ  প্রতিষ্ঠিত ও নিত্য পূজিত। মন্দিরে কিছু পঙ্খের কাজ আছে। দুর্গা  পূজার সময় খুব ধুমধাম করে দেবীর পূজা অনুষ্ঠিত হয়। লোকশ্রুতি, চিতে ডাকাতের সময়ে দেবীর সামনে নরবলি দেওয়া হত। পরে  ছাগবলি চালু ছিল। তবে বর্তমান  মন্দিরে কোনো পশুবলি হয় না।  মন্দিরের সামনে চাঁদনি আকৃতির একটি নাটমন্দির আছে।  নাটমন্দিরের দক্ষিণের দেওয়ালে ও প্রবেশপথের উপরে দুটি  শ্বেতপাথরের প্রতিষ্ঠাফলক আছে। দুটি প্রতিষ্ঠাফলকেই মন্দিরটি ইং  ১৬১০ সালে প্রতিষ্ঠিত বলে উল্লেখ আছে। নাটমন্দিরের দেওয়ালে  নিবদ্ধ বোর্ডে লেখা লিপি :

            " শ্রীশ্রী ঁজয়চন্ডী চিত্তেশ্বরী 

       শ্রীশ্রী ঁচিত্তেশ্বরী মাতা পশ্চিমবঙ্গের প্রাচীন স্থাপিত চিতে  ডাকাতের আরাধ্য  দূর্গা দেবী। বহুবছর আগে চিতে ডাকাত গঙ্গার  জলে ভেসে আসা নিম কাঠ দিয়ে দশভুজা চিত্তেশ্বরীর মূর্ত্তি এই স্থানে স্থাপন করে পূজো শুরু করেন। কালক্রমে চিতে ডাকাতের মৃত্যুর  পর দূর্গা গভীর জঙ্গলে পড়ে রইলেন। পরবর্ত্তী কালে নৃসিংহ  ব্রহ্মচারী নামে এক তান্ত্রিক সাধু ইং ১৫৮৬ খ্রিস্টাব্দে দেবী চিত্তেশ্বরীর  স্বপ্নাদেশ পেয়ে  যথাস্থানে পুনরায় জঙ্গলে দেবীকে স্থাপন করে পূজো শুরু  করেন। উক্ত স্থানের তৎকালীন জমিদার মনোহর ঘোষ ইং ১৬১০  খ্ৰীষ্টাব্দে চিত্তেশ্বরীর এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করে দেন। চিৎপুর রোড  এই চিত্তেশ্বরী দেবীর নাম থেকে খ্যাত হয়েছে। চিত্তেশ্বরী দূর্গার এই দারু  বিগ্রহ পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম প্রাচীন পুরাকীর্ত্তি। বর্তমান সেবায়েত  শ্রী কাশীশ্বর।"              

              তারাপদ সাঁতরার লেখা কলকাতার মন্দির মসজিদ গ্রন্থ  থেকে পাই,  লেখক যখন এই মন্দিরটি পরিদর্শন করেন তখন  তিনি নাটমন্দিরের দেওয়ালে নিবদ্ধ বোর্ডে নিম্নলিখিত উৎকীর্ণ  লিপি  দেখতে পান :

             "৩৮৮ বৎসর পূর্ব্বে শ্রীচৈতন্যদেবের অন্তরঙ্গ পার্ষদ অগ্রদ্বীপের ও ঘোষপাড়ার বাসুদেব ঘোষের বংশধর বর্দ্ধমান ও  মুর্শিদাবাদ জেলার সীমানায় কুলাই গ্রামের জমিদার মনোহর ঘোষ ও  তাহার পত্নী সেওড়াফুলী রাজার কন্যা উভয়ে ইং ১৫৮৬ সালে এই  চিত্তেশ্বরী দেবীর মন্দির স্থাপন করিয়া কিছু ভূসম্পত্তিসহ তদীয়  সেবাইত মহন্ত নৃসিংহ ব্রহ্মচারিকে দান করেন। চিতুডাকাত এই  দেবীকে পূজা করিতেন। কলিকাতা চিৎপুর  রোড এই চিত্তেশ্বরী  দেবীর নাম হইতে আখ্যাত। উপস্থিত সেবিকা -  বিল্বমাতা  ব্রহ্মচারিণী।  ইং ১৯৭৪। "  

            রাধারমণ মিত্র তাঁর কলিকাতা - দর্পণ ( প্রথম পর্ব ) গ্রন্থে  লিখেছেন :

      " মনোহর ঘোষ ওরফে মহাদেব ঘোষ চিত্তেশ্বরী দেবীর প্রতিষ্ঠা  করেন। প্রতিষ্ঠার তারিখ ম্যাককাচ্চন সাহেব ১৫৮৬ বলে উল্লেখ  করেছেন। এ তারিখ তিনি কোথা থেকে পেলেন? মন্দিরের মাথায়  লেখা আছে ১৬১০ খ্রীষ্টাব্দ। এই তারিখই ঠিক বলে মনে হয়। মনোহর  ঘোষ ছিলেন হুগলি জেলার আখনার বাসিন্দা। ইনি ছিলেন প্রথমে  রাজা টোডরমলের গোমস্তা, পরে হন মুহুরি। শেষে সুবর্ণরেখা  নদীতীরে বাস করেন। মোগল-পাঠান যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে সুবর্ণরেখা  ত্যাগ ক'রে চিৎপুরে এসে বাস করেন। সেই সময়ে চিত্তেশ্বরী দেবীর  প্রতিষ্ঠা করেন।" 

            প্রতিষ্ঠাকালের হেরফের সম্পর্কে তারাপদ সাঁতরার লেখা  কলকাতার মন্দির মসজিদ গ্রন্থে দেবাশিস বসু সম্পাদিত প্রাণকৃষ্ণ  দত্ত : 'কলিকাতার ইতিবৃত্ত ও অন্যান্য রচনা ' গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি  দিয়েছেন,  " ... সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে,নৃসিংহের পর  তাঁর শিষ্য রামনৃসিংহ ব্রহ্মচারী ও প্রশিষ্য ক্ষেত্র ব্রহ্মচারী চিত্তেশ্বরীর  মোহন্ত হন। ঘটনাচক্রে বিবাহ করতে বাধ্য হন ক্ষেত্র ব্রহ্মচারী। তাঁর  দুই কন্যা। জ্যেষ্ঠা যাদুমণির বিবাহ হয় এক অশীতিপর বৃদ্ধের সঙ্গে।  কনিষ্ঠা ক্ষেত্রমণি বড়িশার সাবর্ণ-বংশীয় আনন্দমোহন রায়চোধুরীর  সঙ্গে পরিণীতা হন। বর্তমান সেবায়েত শ্রীরবীন্দ্রকুমার রায়চৌধুরী  আনন্দমোহনের প্রপৌত্র। কাজেই এই চিত্তেশ্বরী মন্দিরের ইতিহাস  মাত্র সাত প্রজন্মের। " 

            শেষে শ্রী সাঁতরা  তাঁর লেখা পূর্বোক্ত গ্রন্থে এই মন্দিরের  প্রাচীনত্ব নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।

             কী ভাবে যাবেন?

            কলকাতার শ্যামবাজার থেকে বি. টি. রোড গামী যে কোন  বাসে উঠে চিড়িয়া মোড়ে নামুন। সেখান থেকে অটোতে উঠে বিবি  বাজারে নামুন। সেখান থেকে একটু দূরেই মন্দির। চিড়িয়া মোড়  থেকে খগেন্দ্র চ্যাটার্জী রোড ধরে হেঁটেও মন্দির যেতে পারেন। ট্রেনে  দমদম স্টেশনে নেমে অটোতে চিড়িয়া মোড় এসে মন্দিরে যেতে  পারেন। বর্তমান সেবায়েত কাশীশ্বর রায়চৌধুরীর ফোন নম্বর :  ৬২৮৯২৪৯৪৮৬, প্রয়োজনে তাঁকে ফোন করতে পারেন।

            মন্দিরটি পরিদর্শনের তারিখ :  ২৪.০৯.২০২১   

আদি চিত্তেশ্বরী মা - ১

আদি চিত্তেশ্বরী মন্দিরের প্রবেশ পথ

আদি চিত্তেশ্বরী মন্দির, কাশীপুর

মন্দিরের সামনের নাটমন্দির ( বাইরে থেকে )

মন্দিরের সামনের নাটমন্দির ( ভিতর থেকে )

নাটমন্দিরের দক্ষিণের দেওয়ালে লাগানো প্রতিষ্ঠাফলক

আদি চিত্তেশ্বরী মা - ২

আদি চিত্তেশ্বরী মা - ৩

শিবলিঙ্গ

              কলকাতার অন্যান্য মন্দির সম্বন্ধে জানতে নিচের লিংকে ক্লিক করুন / লিংকের উপর আঙুল দিয়ে টোকা দিন : 

                        কলকাতার  মন্দির 

----------------------------------------------------------

রামায়ণের ৭টি খণ্ডের ৬৪ টি উপাখ্যান ও ১৮৫ টি টেরাকোটা ফলকের আলোকচিত্র সংবলিত আমার লেখা এবং 'রা প্রকাশন' কর্তৃক প্রকাশিত বই 'বাংলার টেরাকোটা মন্দিরে রামায়ণ' প্রকাশিত হয়েছে।


 বইটি ডাক যোগে সংগ্রহ করতে হলে যোগাযোগ করুন :  9038130757 এই নম্বরে। 

কলকাতার কলেজস্ট্রিটের মোড়ে দুই মোহিনীমোহন কাঞ্জিলালের কাপড়ের দোকানের মাঝের রাস্তা ১৫, শ্যামাচরণ দে স্ট্রিটের উপর অবস্থিত বিদ্যাসাগর টাওয়ারের দু'তলায় 'রা প্রকাশনে'র দোকান। ওখান থেকে বইটি সংগ্রহ করতে পারেন। কোনও অসুবিধা হলে উপরোক্ত নম্বরে ফোন করতে পারেন।

--------------------------------------------------------

1 টি মন্তব্য:

  1. পশ্চিমবঙ্গে একটি পৌরাণিক ও আদি চিত্তেস্বরী দূর্গা মন্দির,এটা স্থাপিত দেবী জার বারোমাস দুবেলা পুজো হয়।

    উত্তরমুছুন