নবকৈলাস মন্দির ( ১০৮ শিব মন্দির ), অম্বিকা কালনা, পূর্ব বর্ধমান
শ্যামল কুমার ঘোষ
অম্বিকা কালনার রাজবাড়ি মন্দির চত্বরের দক্ষিণ দিকের প্রবেশ-দ্বারের রাস্তার বিপরীত দিকে ১০৮ শিব মন্দিরের প্রবেশ-দ্বার। যদিও মন্দিরগুলি ১০৮ শিবমন্দির নামেই পরিচিত তবে প্রতিষ্ঠা লিপি অনুযায়ী এটি ১০৯ টি শিব মন্দির এবং এর নাম 'নবকৈলাস মন্দির'। উত্তর দিকের মূল প্রবেশদ্বারের ( সম্ভবত এই প্রবেশদ্বারের বিপরীতে দক্ষিণ দিকে আর একটি প্রবেশদ্বার ছিল। পরে বন্ধ করা হয়েছে। কারণ ওখানেও একটি প্রতিষ্ঠালিপি আছে। ) উপরের পাথরের প্রতিষ্ঠালিপিতে বলা হয়েছে :
শাকে চন্দ্রশিবাক্ষিসপ্তি কুমিতে শ্রী
তেজচন্দ্রাভিধো রাজা সূর্য্য ইবাস্থি
রার্পিতচলচ্চণ্ডপ্রতাপানলঃ
শম্ভো র্ধাম পরং নবাধিকশতশ্রী
মন্দিরৈ র্মণ্ডলং প্রাকার্ষীম্মহদা
ম্বিকাখ্যনগরে কৈলাশমেতং নবং
এর অর্থ হল, চন্দ্র = ১, শিবাক্ষি = ৩, সপ্ত =৭, কু =১।
অঙ্কের বামাগতি নিয়মানুসারে, ১৭৩১ শকাব্দে ( ১৮০৯ খ্রীষ্টাব্দে ) অম্বিকা নামক নগরে শ্রীতেজশ্চন্দ্র নামে রাজা একশ নয়টি শ্রীমন্দিরমণ্ডল শিবালয় নবকৈলাস রূপে তৈরি করলেন। রাজা তেজশ্চন্দ্র যেন স্বয়ং সূর্য। সূর্যের মধ্যে স্থির আছে ভয়ঙ্কর বহ্নি। রাজা তেজশ্চন্দ্রের মধ্যেও প্রতাপানাল প্রচণ্ড, কিন্তু সচল।
কালনার ১০৯ টি শিব মন্দিরের মধ্যে ১০৮ টি শিব মন্দির, দুটি এককেন্দ্রিক বৃত্তে অবস্থিত। বাইরের বৃত্তে ৭৪ টি এবং ভিতরের বৃত্তে ৩৪ টি। আর বৃত্তের বহির্দেশে একটি। এককেন্দ্রিক বৃত্তদ্বয়ের কেন্দ্রে রয়েছে একটি বড় ইঁদারা। এটিকে শূন্য অর্থাৎ নিরাকার ব্রহ্মস্বরূপ পরম শিবের প্রতীক বলে অনেকে মনে করেন। আসলে হয়তো এই ইঁদারাটি তৈরি করা হয়েছিল মন্দিরের পূজার কাজে ব্যবহৃত জলের চাহিদা মেটাতে।
ভিতরের বৃত্তের পূর্ব ও পশ্চিমের দুটি প্রবেশদ্বার আটচালা মন্দিরাকৃতি। বাইরের বৃত্তের দক্ষিণ ও উত্তরের দুটি প্রবেশদ্বারও আটচালা মান্দিরাকৃতি। আগেই উল্লেখ করেছি যে দক্ষিণদিকের প্রবেশদ্বারটি বর্তমানে বন্ধ আছে।
এখানে বাইরের বৃত্তের শিবলিঙ্গগুলি একটি কৃষ্ণবর্ণের, পরেরটি শুভ্রবর্ণের, পর্যায়ক্রমে। আর ভিতরের বৃত্তের শিবলিঙ্গগুলি সবই শুভ্রবর্ণের। বৃত্তের বহির্দেশে, পশ্চিমদিকে যে ১০৯ সংখ্যক শিবমন্দিরটি রয়েছে তার শিবলিঙ্গটি কৃষ্ণবর্ণের। মন্দিরের শুভ্রবর্ণের শিবলিঙ্গগুলি ভগবান সদাশিবের প্রতীক এবং কৃষ্ণবর্ণের শিবলিঙ্গগুলি রুদ্রের প্রতীক। প্রথম বৃত্তে ভক্ত পর্যায়ক্রমে দেখেন ভগবান রুদ্র ও সদাশিব মূর্তি। শেষে ভক্ত বৈকুন্ঠের অন্তর্গত তমোগুণ সম্বন্ধরোহিত শিবলোকে পৌঁছে যান এবং সর্বত্রই সদাশিবের মূর্তি প্রত্যক্ষ করেন।
বৃত্তের মধ্যের মন্দিরগুলি আটচালা। চারচালের উপরে ক্ষুদ্রাকৃতি আরেকটি চারচালা। মন্দিরগুলি অল্প উঁচু ভিত্তি বেদির উপর স্থাপিত এবং পরস্পর সংলগ্ন। মন্দির গুলিতে টেরাকোটার কোন কাজ নেই। ১০৯ সংখ্যক মন্দিরটি উঁচু ভিত্তিবেদির উপর প্রতিষ্ঠিত পঞ্চরত্ন মন্দির। এর ছাদের চারকোণে চারটি চূড়া এবং মাঝখানে অপেক্ষাকৃত বড় একটি চূড়া। বারান্দায় ওঠার জন্য আছে আটটি সিঁড়ি। বর্তমানে এর নাম জলেশ্বর মন্দির। শ্রী যজ্ঞেশ্বর চৌধুরী বলেছেন যে জপমালায় যেরূপ ১০৮ টি বীজ গাঁথা থাকে এবং মধ্যস্থলে ঈষৎ বড় আকারের একটি বীজ মেরুস্বরূপ থাকে সেই রকম এই শিবক্ষেত্র নির্মাণের সময় উক্ত বিধান মানা হয়েছিল।
জলেশ্বর শিবমন্দিরের মত আরেকটি 'পঞ্চরত্ন' মন্দির রয়েছে মূল মন্দির বৃত্তের বাইরে পূর্ব দিকে। এর নাম রত্নেশ্বর মন্দির। অনেকে মনে করেন যে দেবী ভাগবতের ১১০ টির অনুসরণে এখানে ১০৮ + ২ = ১১০ টি শিবলিঙ্গের প্রতিষ্ঠা। তাঁরা মনে করেন যে প্রতিষ্ঠালিপিতে 'নবাধিক শত' বলতে ১০৯-এর অধিক বলা হয়েছে।
নবকৈলাস মন্দিরের প্রবেশদ্বার দিয়ে ঢুকলে বাঁ দিকে যে মন্দিরটি আছে তার শিবলিঙ্গ শুভ্র এবং শিবের সঙ্গে আছে শ্বেতপাথরের নন্দী। সমস্ত মন্দিরের শিবলিঙ্গগুলি নিত্য পূজিত। দর্শনার্থীদের মধ্যে অনেকেই প্রতিটি শিবলিঙ্গের মাথ্যায় জল ঢালেন এবং এটাই রীতি।
সহায়ক গ্রন্থাবলি :
১) কালনা মহকুমার প্রত্নতত্ত্ব ও ধর্মীয় সংস্কৃতির ইতিবৃত্ত : বিবেকানন্দ দাস
২) বাংলার মন্দির স্থাপত্য ও ভাস্কর্য : প্রণব রায়
শ্যামল কুমার ঘোষ
অম্বিকা কালনার রাজবাড়ি মন্দির চত্বরের দক্ষিণ দিকের প্রবেশ-দ্বারের রাস্তার বিপরীত দিকে ১০৮ শিব মন্দিরের প্রবেশ-দ্বার। যদিও মন্দিরগুলি ১০৮ শিবমন্দির নামেই পরিচিত তবে প্রতিষ্ঠা লিপি অনুযায়ী এটি ১০৯ টি শিব মন্দির এবং এর নাম 'নবকৈলাস মন্দির'। উত্তর দিকের মূল প্রবেশদ্বারের ( সম্ভবত এই প্রবেশদ্বারের বিপরীতে দক্ষিণ দিকে আর একটি প্রবেশদ্বার ছিল। পরে বন্ধ করা হয়েছে। কারণ ওখানেও একটি প্রতিষ্ঠালিপি আছে। ) উপরের পাথরের প্রতিষ্ঠালিপিতে বলা হয়েছে :
শাকে চন্দ্রশিবাক্ষিসপ্তি কুমিতে শ্রী
তেজচন্দ্রাভিধো রাজা সূর্য্য ইবাস্থি
রার্পিতচলচ্চণ্ডপ্রতাপানলঃ
শম্ভো র্ধাম পরং নবাধিকশতশ্রী
মন্দিরৈ র্মণ্ডলং প্রাকার্ষীম্মহদা
ম্বিকাখ্যনগরে কৈলাশমেতং নবং
এর অর্থ হল, চন্দ্র = ১, শিবাক্ষি = ৩, সপ্ত =৭, কু =১।
অঙ্কের বামাগতি নিয়মানুসারে, ১৭৩১ শকাব্দে ( ১৮০৯ খ্রীষ্টাব্দে ) অম্বিকা নামক নগরে শ্রীতেজশ্চন্দ্র নামে রাজা একশ নয়টি শ্রীমন্দিরমণ্ডল শিবালয় নবকৈলাস রূপে তৈরি করলেন। রাজা তেজশ্চন্দ্র যেন স্বয়ং সূর্য। সূর্যের মধ্যে স্থির আছে ভয়ঙ্কর বহ্নি। রাজা তেজশ্চন্দ্রের মধ্যেও প্রতাপানাল প্রচণ্ড, কিন্তু সচল।
কালনার ১০৯ টি শিব মন্দিরের মধ্যে ১০৮ টি শিব মন্দির, দুটি এককেন্দ্রিক বৃত্তে অবস্থিত। বাইরের বৃত্তে ৭৪ টি এবং ভিতরের বৃত্তে ৩৪ টি। আর বৃত্তের বহির্দেশে একটি। এককেন্দ্রিক বৃত্তদ্বয়ের কেন্দ্রে রয়েছে একটি বড় ইঁদারা। এটিকে শূন্য অর্থাৎ নিরাকার ব্রহ্মস্বরূপ পরম শিবের প্রতীক বলে অনেকে মনে করেন। আসলে হয়তো এই ইঁদারাটি তৈরি করা হয়েছিল মন্দিরের পূজার কাজে ব্যবহৃত জলের চাহিদা মেটাতে।
ভিতরের বৃত্তের পূর্ব ও পশ্চিমের দুটি প্রবেশদ্বার আটচালা মন্দিরাকৃতি। বাইরের বৃত্তের দক্ষিণ ও উত্তরের দুটি প্রবেশদ্বারও আটচালা মান্দিরাকৃতি। আগেই উল্লেখ করেছি যে দক্ষিণদিকের প্রবেশদ্বারটি বর্তমানে বন্ধ আছে।
এখানে বাইরের বৃত্তের শিবলিঙ্গগুলি একটি কৃষ্ণবর্ণের, পরেরটি শুভ্রবর্ণের, পর্যায়ক্রমে। আর ভিতরের বৃত্তের শিবলিঙ্গগুলি সবই শুভ্রবর্ণের। বৃত্তের বহির্দেশে, পশ্চিমদিকে যে ১০৯ সংখ্যক শিবমন্দিরটি রয়েছে তার শিবলিঙ্গটি কৃষ্ণবর্ণের। মন্দিরের শুভ্রবর্ণের শিবলিঙ্গগুলি ভগবান সদাশিবের প্রতীক এবং কৃষ্ণবর্ণের শিবলিঙ্গগুলি রুদ্রের প্রতীক। প্রথম বৃত্তে ভক্ত পর্যায়ক্রমে দেখেন ভগবান রুদ্র ও সদাশিব মূর্তি। শেষে ভক্ত বৈকুন্ঠের অন্তর্গত তমোগুণ সম্বন্ধরোহিত শিবলোকে পৌঁছে যান এবং সর্বত্রই সদাশিবের মূর্তি প্রত্যক্ষ করেন।
বৃত্তের মধ্যের মন্দিরগুলি আটচালা। চারচালের উপরে ক্ষুদ্রাকৃতি আরেকটি চারচালা। মন্দিরগুলি অল্প উঁচু ভিত্তি বেদির উপর স্থাপিত এবং পরস্পর সংলগ্ন। মন্দির গুলিতে টেরাকোটার কোন কাজ নেই। ১০৯ সংখ্যক মন্দিরটি উঁচু ভিত্তিবেদির উপর প্রতিষ্ঠিত পঞ্চরত্ন মন্দির। এর ছাদের চারকোণে চারটি চূড়া এবং মাঝখানে অপেক্ষাকৃত বড় একটি চূড়া। বারান্দায় ওঠার জন্য আছে আটটি সিঁড়ি। বর্তমানে এর নাম জলেশ্বর মন্দির। শ্রী যজ্ঞেশ্বর চৌধুরী বলেছেন যে জপমালায় যেরূপ ১০৮ টি বীজ গাঁথা থাকে এবং মধ্যস্থলে ঈষৎ বড় আকারের একটি বীজ মেরুস্বরূপ থাকে সেই রকম এই শিবক্ষেত্র নির্মাণের সময় উক্ত বিধান মানা হয়েছিল।
জলেশ্বর শিবমন্দিরের মত আরেকটি 'পঞ্চরত্ন' মন্দির রয়েছে মূল মন্দির বৃত্তের বাইরে পূর্ব দিকে। এর নাম রত্নেশ্বর মন্দির। অনেকে মনে করেন যে দেবী ভাগবতের ১১০ টির অনুসরণে এখানে ১০৮ + ২ = ১১০ টি শিবলিঙ্গের প্রতিষ্ঠা। তাঁরা মনে করেন যে প্রতিষ্ঠালিপিতে 'নবাধিক শত' বলতে ১০৯-এর অধিক বলা হয়েছে।
নবকৈলাস মন্দিরের প্রবেশদ্বার দিয়ে ঢুকলে বাঁ দিকে যে মন্দিরটি আছে তার শিবলিঙ্গ শুভ্র এবং শিবের সঙ্গে আছে শ্বেতপাথরের নন্দী। সমস্ত মন্দিরের শিবলিঙ্গগুলি নিত্য পূজিত। দর্শনার্থীদের মধ্যে অনেকেই প্রতিটি শিবলিঙ্গের মাথ্যায় জল ঢালেন এবং এটাই রীতি।
নবকৈলাস ( ১০৮ শিবমন্দির ) - ১ |
নবকৈলাস ( ১০৮ শিবমন্দির ) - ২ |
নবকৈলাস ( ১০৮ শিবমন্দির ) - ৩ |
দক্ষিণ দিকের বন্ধ প্রবেশদ্বার |
ভিতরের বৃত্তের প্রবেশদ্বার |
বৃত্তদ্বয়ের কেদ্রের ইঁদারা |
মন্দিরে রাতের আলোকসজ্জা |
উত্তর দিকের প্রতিষ্ঠালিপি |
দক্ষিণ দিকের প্রতিষ্ঠালিপি |
শুভ্রবর্ণের শিবলিঙ্গের একটি |
কৃষ্ণবর্ণের শিবলিঙ্গের একটি |
প্রবেশদ্বারের বাঁ দিকের মন্দিরের শিবলিঙ্গ |
জলেশ্বর শিবমন্দির |
জলেশ্বর শিবমন্দিরের সামনের বিন্যাস |
রত্নেশ্বর শিবমন্দির |
রত্নেশ্বর শিবমন্দিরের সামনের বিন্যাস |
অম্বিকা কালনার এই মন্দিরে যেতে হলে শিয়ালদহ থেকে সকাল ৮ টা ৬ মিনিটের কাটোয়া লোকাল বা হাওড়া থেকে কাটোয়া লোকাল ধরুন। ব্যাণ্ডেল থেকেও অম্বিকা কালনা যাওয়ার গাড়ি পাবেন। স্টেশন থেকে রিকশা বা টোটোতে মন্দিরে পৌঁছে যান। নদিয়া জেলার শান্তিপুর থেকেও গঙ্গা পেরিয়ে কালনায় যেতে পারেন। মন্দিরটি পরিদর্শনের তারিখ : ০২.০৭.২০১৬
|
সহায়ক গ্রন্থাবলি :
১) কালনা মহকুমার প্রত্নতত্ত্ব ও ধর্মীয় সংস্কৃতির ইতিবৃত্ত : বিবেকানন্দ দাস
২) বাংলার মন্দির স্থাপত্য ও ভাস্কর্য : প্রণব রায়
******
বাঃ অনেক তথ্য জানলাম।ধন্যবাদ।
উত্তরমুছুনআপনাকেও ধন্যবাদ।
মুছুন