কৃষ্ণচন্দ্র মন্দির, রাজবাড়ি মন্দির চত্বর, অম্বিকা কালনা, পূর্ব বর্ধমান
শ্যামল কুমার ঘোষ
অম্বিকা কালনার রাজবাড়ি মন্দির চত্বরের পূর্ব দিকে অবস্থিত কৃষ্ণচন্দ্র মন্দির। ১৬৭৩ শকাব্দে ( ১৭৫১ খ্রিস্টাব্দে ) বর্ধমানরাজ ত্রিলোকচন্দ্রের মাতা লক্ষ্মীকুমারী এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। উঁচু ভিত্তিবেদির উপর স্থাপিত, দক্ষিণমুখী, তিনতলবিশিষ্ট মন্দিরটি পঁচিশরত্ন মন্দির।
মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রধান সিংহাসনে রয়েছেন কৃষ্ণচন্দ্র ও রাধার বিগ্রহ। উচ্চতা যথাক্রমে ২ ফুট ৬ ইঞ্চি ( ৭৬ সেমি ) ও ২ ফুট ( ৬১ সেমি )। সঙ্গে রয়েছেন চার সখি। মূর্তিগুলি সবই দারু নির্মিত।
মন্দিরের প্রথম তলের ছাদ ধনুরাকৃতি হয়ে যে কোণের সৃষ্টি করেছে তার চারটি কোণে পর্দার আকারে খানিকটা উঁচু করে দেওয়াল তোলা। সেই দেওয়ালে আছে চুন-সুরকির বড় আকৃতির হাতি ও সিংহের মূর্তি।
ঐ পর্দা-দেওয়ালের উপরেই উঁচু করা কোণগুলিতে আছে ৩ টি করে চারকোণে মোট ১২ টি চূড়া। অর্থাৎ প্রথম তলের ছাদে আছে মোট ১২ টি চূড়া। এর পর বেড় কমিয়ে খানিকটা উপরে অষ্টকোণাকৃতি ২য় তল সৃষ্টি করা হয়েছে। তার ছাদের আটকোণে আছে ৮ টি চূড়া। এরপর বেড়ের প্রসারতা কমিয়ে ২য় তলের চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম উচ্চতায় ৩য় তল সৃষ্টি করা হয়েছে। তার চারকোণে ৪ টি এবং মাঝখানে আছে একটি বড় চূড়া। অর্থাৎ চূড়াগুলির সজ্জা হচ্ছে ১২+৮+৪+১ । মোট পঁচিশ।
মন্দিরের সামনে সন্নিবদ্ধ রয়েছে একটি 'একবাংলা ' মণ্ডপ। এটি পরিদর্শন কক্ষ রূপে ব্যবহৃত হয়।
গর্ভগৃহের সামনে ত্রিখিলান দালান। তোরণগুলির তিনটি খিলান ধারণের জন্য মধ্যে দুটি পূর্ণ স্তম্ভ ও ধারে দুটি অর্ধ স্তম্ভ রয়েছে। স্তম্ভগুলিতে ফুলকারি নকশা ছাড়াও আছে টেরাকোটার অলংকরণ। অন্যান্য মূর্তির মধ্যে সপরিবার দশভুজা মহিষাসুরমর্দিনীর একটি প্যানেল আছে। খিলানগুলির উপর প্রতীক শিব মন্দির ও তার মধ্যে শিবলিঙ্গ। গর্ভগৃহে মূল দ্বার একটি। মন্দিরের পূর্ব দিকে আছে ত্রিখলান সজ্জা। অলিন্দ নেই। দুটি জানলা। পশ্চিম দিকে ত্রিখিলান সজ্জা বিশিষ্ট ভোগ কক্ষ। দুটি জানলা ও একটি দরজা। কিন্তু কোন অলিন্দ নেই। পিছনে ত্রিখিলান ভরাটকরা। কোন দরজা বা জানলা নেই। উত্তর দিকের ভিতরে রয়েছে সিঁড়ি। ঐ সিঁড়ি উঠে গেছে ৩য় তলে।
মন্দিরের সামনের দেওয়ালে, স্তম্ভের গায়ে, চালা-মণ্ডপটির সর্বত্র রয়েছে অজস্র টেরাকোটা মূর্তি ও ফুলকারি নকশা। মূল মন্দিরের সামনের দেওয়ালে কার্নিসের নিচ পর্যন্ত খোপে খোপে অসংখ্য মূর্তিফলক বসানো। ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে 'কল্পলতা' বা 'মৃত্যুলতা'কে দেওয়ালের কোণে বা গায়ে খাড়াকরে লাগানোই প্রচলিত রীতি। এখানেও কোণের দুপাশে তা সমতলভাবে নিবদ্ধ এবং তা একতলার কার্নিস পর্যন্ত উঠে গেছে।
শুধুমাত্র টেরাকোটা প্রাচুর্য নয়, বিষয়বস্তুর বৈচিত্র, সুন্দর সুন্দর টেরাকোটা মূর্তি ও ফুলের নকশা যা এই মন্দিরে রয়েছে তা উচ্চমানের বলা যায়। ধর্মীয় ও সামাজিক দৃশ্যের ফলকগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য, কৃষ্ণলীলার নানা দৃশ্য, বকাসুর বধ, নৌকাবিলাশ, যুদ্ধ চিত্র, বন্দুকধারী ফিরিঙ্গি সৈন্য, শিকার দৃশ্য প্রভৃতি। তবে টেরাকোটাগুলির বেশিরভাগই নষ্ট হয়ে গেছে বা হতে চলেছে। পূর্ব, পশ্চিম ও উত্তর দিকের দেওয়ালের গায়ে রয়েছে ফুলকারি নকশা, এগুলিতে কোন মূর্তিসজ্জা নেই।
মন্দিরের বিগ্রহ নিত্য পূজিত। সকালে মাখন ও মিছরি ভোগ, তারপর পূজা, মধ্যাহ্নে ভোগ ও শয়ন, বৈকালে উত্থান এবং সন্ধ্যায় সন্ধ্যারতি ও ভোগ। মন্দিরটি প্রাচীর দিয়ে ঘেরা একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ঠাকুরবাড়ি, রন্ধনশালা প্রভৃতিও আছে। মন্দিরটি ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ, কলকাতা মণ্ডল দ্বারা সংরক্ষিত।
|
কৃষ্ণচন্দ্র মন্দির
|
|
কৃষ্ণচন্দ্র মন্দির ( উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে তোলা )
|
|
মন্দিরে রাতের আলোক-সজ্জা |
|
মন্দিরের সামনে সন্নিবদ্ধ একবাংলা মণ্ডপ
|
|
গর্ভগৃহের সামনের খিলান-দ্বার |
|
ভরাটকরা খিলানের কাজ |
|
পরিবারসহ মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তি |
|
কৃষ্ণলীলা - ১ (বকাসুর বধ, নৌকাবিলাস ও অন্যান্য চিত্র ) |
|
কৃষ্ণলীলা - ২ |
|
কৃষ্ণলীলা - ৩ ( কৃষ্ণের দাবাগ্নি ভক্ষণ ) |
|
কৃষ্ণলীলা - ৪
|
|
কৃষ্ণলীলা - ৫ ( কৃষ্ণকে যমুনার জলপূর্ণ ঘটের দ্বারা স্নান ) |
|
কৃষ্ণলীলা - ৬ |
|
কৃষ্ণলীলা - ৭ |
|
বাঘ শিকার - ১ |
|
বাঘ শিকার - ২ |
|
'কল্পলতা'-য় টেরাকোটা চিত্র - ১ |
|
'কল্পলতা' বা মৃত্যুলতা-য় টেরাকোটা চিত্র - ২ |
|
'কল্পলতা' বা মৃত্যুলতা-য় টেরাকোটা চিত্র - ৩ |
|
কুলুঙ্গিতে নিবদ্ধ টেরাকোটা-মূর্তি |
|
টেরাকোটার ফুল |
|
টেরাকোটার নকশা |
|
কৃষ্ণচন্দ্র, রাধিকা ও চার সখি |
|
কৃষ্ণচন্দ্র ও রাধিকা বিগ্রহ |
মন্দিরের প্রাচীর বেষ্টনীর মধ্যে রয়েছে তিনটি উপমন্দির। বদ্রিনারায়ণ, রাধাবল্লভ ও রামসীতার মন্দির। মন্দিরের সামনে আছে রাধাবল্লভ মন্দির, পশ্চিম দিকে আছে বদ্রিনারায়ণের মন্দির। এটি ইঁটের তৈরি দালান মন্দির। মন্দিরে বদ্রিনারায়ণের বিগ্রহ নিত্য পূজিত। আর পূর্ব দিকে আছে রামসীতার মন্দির। এটিও ইঁটের তৈরি দালান মন্দির। মন্দিরে রামসীতার বিগ্রহ নিত্য পূজিত।
|
বদ্রিনারায়ণের মন্দির |
|
বদ্রিনারায়ণের বিগ্রহ |
|
রামসীতার মন্দির |
|
রামসীতা ও অন্যান্য বিগ্রহ |
|
রামসীতা বিগ্রহ |
অম্বিকা কালনার এই মন্দিরে যেতে হলে শিয়ালদহ থেকে সকাল ৮ টা ৬ মিনিটের কাটোয়া লোকাল বা হাওড়া থেকে কাটোয়া লোকাল ধরুন। ব্যাণ্ডেল থেকেও অম্বিকা কালনা যাওয়ার গাড়ি পাবেন। স্টেশন থেকে রিকশা বা টোটোতে মন্দিরে পৌঁছে যান। নদিয়া জেলার শান্তিপুর থেকেও গঙ্গা পেরিয়ে কালনায় যেতে পারেন।
মন্দিরটি পরিদর্শনের তারিখ : ০১.০৭.২০১৬
সহায়ক গ্রন্থাবলি :
১) কালনা মহকুমার প্রত্নতত্ত্ব ও ধর্মীয় সংস্কৃতির ইতিবৃত্ত : বিবেকানন্দ দাস
২) পশ্চিমবঙ্গের মন্দির : শম্ভু ভট্টাচার্য
**********
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন