বিজয় বৈদ্যনাথ শিব মন্দির, রাজবাড়ি মন্দির চত্বর, অম্বিকা কালনা, পূর্ব বর্ধমান
শ্যামল কুমার ঘোষ
অম্বিকা কালনার রাজবাড়ি মন্দির চত্বরে কৃষ্ণচন্দ্র মন্দিরের পিছনে অবস্থিত বিজয় বৈদ্যনাথ শিবমন্দির। এই মন্দিরটি আলাদা পাঁচিল দিয়ে ঘেরা হলেও কৃষ্ণচন্দ্র মন্দিরের প্রবেশ-দ্বার পেরিয়ে এই মন্দিরে প্রবেশ করতে হয়। এই মন্দির প্রাঙ্গণের দক্ষিণ দিকের দরজা দিয়ে কৃষ্ণচন্দ্র মন্দিরপ্রাঙ্গণে যাওয়া যায়।
মন্দিরটিতে শ্বেতপাথরের ফলকে লিখিত একটি প্রতিষ্ঠাফলক রয়েছে, যা হয়তো নষ্ট হওয়া মূল প্রতিষ্ঠাফলকের পরিবর্তে সংস্থাপিত। এটির পাঠ নিম্নরূপ :
কুমার শ্রীমিত্রসেন-ধর্ম্মপত্নী শ্রিয়ান্বিতা।
লক্ষ্মীদেবী বৈদ্যনাথং সমরাধ্য সুতার্থিনী।। ১।।
ত্রিলোকচন্দ্রংতনয়ং লব্ধা দেব প্রসাদতঃ।
নির্ম্মায় মন্দিরমিদং কারুকার্য্যসুশোভিতম্।।২।।
বিজয়াদি বৈদ্যনাথনাম্নাত্র শিবলিঙ্গকম্।
মহেশ্বরস্য প্রীত্যর্থৎ স্থাপয়ামাস ভক্তিতঃ।।৩।।
অর্থাৎ, কুমার শ্রীমিত্রসেনের ধৰ্মপত্নী শ্রীযুক্তা লক্ষ্মীদেবী পুত্রার্থী হয়ে বৈদ্যনাথ শিবকে আরাধনা করে দেবানুগ্রহে ত্রিলোকচন্দ্র নামক পুত্র লাভ করেন। এরপর তিনি কারুকার্যখচিত এই মন্দির নির্মাণ করে বিজয়বৈদ্যনাথ নামক শিবলিঙ্গ মহাদেবের প্রীতির জন্য ভক্তিপূর্বক স্থাপন করলেন।
কুমার মিত্রসেন ছিলেন রাজা চিত্রসেন রায়ের পিতৃব্য। ত্রিলোকচন্দের জননী বৈদ্যনাথকে আরাধনা করে ত্রিলোকচন্দ্রকে লাভ করেন। সেই ত্রিলোকচন্দ্র যখন রাজা হন তখন মানত পূরণের জন্য এই মন্দির নির্মিত হয়। যতদূর মনে হয়, কৃষ্ণচন্দ্র মন্দির নির্মাণের সময়ই এই মন্দির নির্মিত হয়। এখানে উল্লেখযোগ্য যে কৃষ্ণচন্দ্র মন্দির নির্মাণের সময় ১৭৫১ - ৫৫ খ্রীষ্টাব্দ।
মন্দিরটি উঁচু ভিত্তিবেদির উপর স্থাপিত, পূর্বমুখী, আটচালা মন্দির। এর আয়তন ১৯ ফুট ( ৫.৮ মি. ) × ২০ ফুট (৬ মি. -বারান্দাসহ )। উচ্চতা প্রায় ৩০ ফুট ( ৯ মি. )। গর্ভগৃহের সামনে তিনটি পত্রাকৃতি খিলানযুক্ত আবৃত অলিন্দ আছে। খিলান তিনটির উপরের চারপাশে আছে প্রতীক শিবালয় ও তার মধ্যে শিবলিঙ্গ। তোরণগুলির তিনটি খিলান ধারণের জন্য দুটি পূর্ণ স্তম্ভ ও দুটি অর্ধ স্তম্ভ রয়েছে। গর্ভগৃহে একটি মাত্র দরজা। মন্দিরটির সামনের দেওয়ালের দুপাশে ও উপরে দুই সারি কুলুঙ্গির মধ্যে অজস্র টেরাকোটা মূর্তি আছে। কিন্তু ত্রিখিলান প্রবেশ পথের উপরের পৃথক চার সারি ও তাদের সংযুক্ত অংশে পোড়ামাটির ফুল ছাড়া কোন মূর্তি নেই। ভিত্তিবেদি সংলগ্ন দেওয়ালেও পোড়ামাটির মূর্তি ফলক আছে। পোড়ামাটির কাজগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য, বীণাবাদনরতা পক্ষী-মানবী, নর্তকী, যুদ্ধযাত্রা, জমিদারের অন্যত্র গমন ও ফুলকারি নকশা ইত্যাদি। দুটি পূর্ণস্তম্ভের নিচের ও অন্যত্র অনেক জায়গার পোড়ামাটির কাজ নষ্ট হয়ে গেছে। মন্দিরের বাকি তিনটি দেওয়াল পলেস্তারা আবৃত।
মন্দিরের গর্ভগৃহে বিজয়বৈদ্যনাথ নামক কাল পাথরের শিবলিঙ্গ নিত্য পূজিত। শিবলিঙ্গের উচ্চতা প্রায় ৪ ফুট ৬ ইঞ্চি ( ১৩৭ সেমি ) । মন্দিরটি ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ, কলকাতা মণ্ডল দ্বারা সংরক্ষিত।
|
কৃষ্ণকে যমুনার জলপূর্ণ ঘাটের দ্বারা স্নান করানো |
|
বিজয় বৈদ্যনাথ শিবমন্দির |
|
মন্দিরের সামনের বিন্যাস |
|
একটি খিলানের উপরের কাজ |
|
গর্ভগৃহের সামনের খিলানের কাজ |
|
প্রতিষ্ঠা-ফলক |
|
ভিত্তিবেদি সংলগ্ন টেরাকোটার অলংকরণ -১ ( উপরে, কৃষ্ণলীলা ) |
|
ভিত্তিবেদি সংলগ্ন টেরাকোটার অলংকরণ -২ ( কুবলইপীড়, চানুরা, মুষ্টিক ও কংস বধ ) |
|
ভিত্তিবেদি সংলগ্ন টেরাকোটার অলংকরণ -৩ ( উপরে, কৃষ্ণলীলা ) |
|
ভিত্তিবেদি সংলগ্ন টেরাকোটার অলংকরণ -৪ ( উপরে, বসুদেব-দেবকী কর্তৃক বিষ্ণু বন্দনা, কংস নিয়জিত নিদ্রিত প্রহরীরা, বসুদেবের যমুনা অতিক্রমের দৃশ্য ও পুতনা বধ ) |
|
ভিত্তিবেদি সংলগ্ন টেরাকোটার অলংকরণ -৫ ( উপরে, পুতনা বধ ) |
|
কুলুঙ্গির মধ্যে নিবদ্ধ টেরাকোটা মূর্তি -১ |
|
কুলুঙ্গির মধ্যে নিবদ্ধ টেরাকোটা মূর্তি -২ |
|
কুলুঙ্গির মধ্যে নিবদ্ধ টেরাকোটা মূর্তি -৩ |
|
কুলুঙ্গির মধ্যে নিবদ্ধ টেরাকোটা মূর্তি -৪ |
|
কুলুঙ্গির মধ্যে নিবদ্ধ টেরাকোটা মূর্তি -৫ |
|
কুলুঙ্গির মধ্যে নিবদ্ধ টেরাকোটা মূর্তি -৬ |
|
একটি ব্যাতিক্রমী টেরাকোটা চিত্র |
|
কৃষ্ণকে যমুনার জলপূর্ণ ঘাটের দ্বারা স্নান করানো |
|
বীণাবাদনরতা পক্ষীমানবী ও অন্য চিত্র |
|
বাদ্যযন্ত্রসহ |
|
শিকার দৃশ্য |
|
হাতির পিঠে চড়ে শিকার |
|
ফুলকারি নকশা -১ |
|
ফুলকারি নকশা -২ |
|
বিজয় বৈদ্যনাথ শিবলিঙ্গ |
অম্বিকা কালনার এই মন্দিরে যেতে হলে শিয়ালদহ থেকে সকাল ৮ টা ৬ মিনিটের কাটোয়া লোকাল বা হাওড়া থেকে কাটোয়া লোকাল ধরুন। ব্যাণ্ডেল থেকেও অম্বিকা কালনা যাওয়ার গাড়ি পাবেন। স্টেশন থেকে রিকশা বা টোটোতে মন্দিরে পৌঁছে যান। নদিয়া জেলার শান্তিপুর থেকেও গঙ্গা পেরিয়ে কালনায় যেতে পারেন।
মন্দিরটি পরিদর্শনের তারিখ : ০১.০৭.২০১৬
সহায়ক গ্রন্থাবলি :
১) কালনা মহকুমার প্রত্নতত্ত্ব ও ধর্মীয় সংস্কৃতির ইতিবৃত্ত : বিবেকানন্দ দাস
২) বাংলার মন্দির স্থাপত্য ও ভাস্কর্য : প্রণব রায়
*********
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন