কমলাকান্ত কালীবাড়ি, কোটালহাট, বর্ধমান শহর
শ্যামল কুমার ঘোষ
সাধক প্রবর কমলাকান্ত প্রতিষ্ঠিত কোটালহাটের কালীবাড়ি 'কমলাকান্তের কালীবাড়ি' নামেই পরিচিত। কমলাকান্ত ভট্টাচার্য সাধক কমলাকান্ত নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন। বর্ধমানের মহারাজা তেজচাঁদ ১২১৬ বঙ্গাব্দে কমলাকান্তকে চান্না থেকে বর্ধমানে নিয়ে এসে তাঁর সভাপণ্ডিত করেন এবং পরে তাঁর শিষ্যত্বও গ্রহণ করেন। মহারাজ তেজচাঁদ কোটালহাটে তাঁকে বারো কাঠা জমি দান করলেন এবং সাধক কমলাকান্তের থাকার বন্দোবস্ত করে দিলেন। সাধক কমলাকান্ত সেখানে খড়ের ছাউনি দিয়ে এক মন্দির নির্মাণ করে মন্দিরে কালীমূর্তি স্থাপন করে আদ্যাশক্তি মহামায়ার সাধনার ক্ষেত্র প্রস্তুত করলেন। মন্দিরের পাশেই পঞ্চমুণ্ডির আসন প্রতিষ্ঠা করলেন। মন্দিরের পিছনে বেলগাছ প্রতিষ্ঠা করে স্থাপন করলেন ভৈরবকে। এই মন্দিরেই তিনি জগজ্জননীর মৃন্ময়ী রূপ থেকে চিন্ময়ী রূপের দেখা পেয়ে ছিলেন।
সেকালের খড়ের মন্দির বর্তমানে হয়েছে পাকা দালান শৈলীর মন্দির। মন্দির চত্বর গাছগাছালিতে ভরা। মূল মন্দিরে তিনটি ঘর। মন্দিরের পশ্চিমে ভোগ রান্নার ঘর। গর্ভগৃহের ডান দিকের ঘরটি ছিল সাধকের পঞ্চমুণ্ডির আসন। এই পঞ্চমুণ্ডির আসন যে ঘরে আছে সেই ঘরে সকলকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। এই ঘরে মায়ের একটি ছোট মূর্তি আছে। গর্ভগৃহে রয়েছে একটি বেদি। এর ভিতরে রয়েছে কমলাকান্তের সমাধি। তার উপরে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে মা কালীর কষ্টিপাথরের মূর্তি। পূর্বে মূর্তিটি ছিল মৃন্ময়ী। কষ্টিপাথরের মূর্তিটি বেশ বড়ো, চতুর্ভুজা। মন্দিরের সামনে আছে নাটমন্দির। নাটমন্দিরটি নির্মাণ করে দেন বৈদ্যনাথ দে মহাশয়। মায়ের নিত্য পূজা ছাড়াও প্রতি অমাবস্যায় হোম হয়। কার্তিকী অমাবস্যায় ধুমধামের সঙ্গে মায়ের পূজা করা হয়। 'কমলাকান্ত সমিতি' নামে একটি সমিতি মন্দিরের সেবাকার্য পরিচালনা করেন।
ভোগরান্না ঘরের পাশেই একটি বাঁধানো কুয়া। এই কুয়ার একটি ইতিহাস আছে। কমলাকান্তের মৃত্যুকাল উপস্থিত হলে মহারাজা তেজচন্দ্র কমলাকান্তকে গঙ্গাতীরে নিয়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু কমলাকান্ত কিছুতেই তাতে রাজি হলেন না। এতে মহারাজ কিছুটা মনঃক্ষুণ্ণ হলেন। কিন্তু সাধকের মৃত্যুর সময় দেখা গেল এক জায়গায় মাটি ভেদ করে গঙ্গার আগমন ঘটেছে। পরবর্তীকালে সেটি বাঁধিয়ে রাখা হয়েছে।
এ রকম আরও অলৌকিক কাহিনী ঘটেছিল সাধকের জীবদ্দশায় যা আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে। একটি ঘটনা, মহারাজ তেজচন্দ্র তাঁর মদ্যপ পুত্র প্রতাপচাঁদকে ভালো করার জন্য কমলাকান্তের কাছে পাঠিয়ে ছিলেন। কিন্তু একদিন তিনি দেখলেন সাধক নিজেই সুরাপানে মত্ত। রাজা মনে মনে বিরক্ত হলেন। একদিন কমলাকান্ত কমণ্ডলু নিয়ে রাজপ্রসাদে এসেছেন। রাজার ধারণা হল কমণ্ডলুর মধ্যে সুরা আছে। তাই মহারাজ কমলাকান্তকে জিজ্ঞাসা করলেন, 'ঠাকুর তোমার কমণ্ডলুর মধ্যে কী আছে ?' ভাবের ঘোরে সাধক উত্তর দিলেন, 'দুধ আছে।' তারপর রাজার অবিশ্বাসী চোখ দেখে কমণ্ডলু থেকে মাটিতে দুধ ঢেলে দেখিয়ে দিলেন। রাজা লজ্জিত হলেন। আর এক দিনের ঘটনা - সাধক কমলাকান্ত মদ্যপ অবস্থায় রাজবাড়িতে এসেছেন মহারাজের কাছে। সাধক প্রকৃতিস্থ কিনা পরীক্ষা করবার জন্য মহারাজ সাধককে জিজ্ঞাসা করলেন, 'গুরুদেব, আজ কী তিথি ?' সাধক ভাবাবেগে উত্তর দিলেন, 'আজ পূর্ণিমা তিথি।' সেদিন ছিল অমাবস্যা। তাই মহারাজ বিরক্ত হয়ে সাধককে বললেন, আজ পূর্ণিমার চাঁদ দেখাতে পারবেন ? সাধক সেদিন মহারাজকে অমাবস্যার রাতে আকাশে পূর্ণ চন্দ্র দেখালেন।
কমলাকান্ত অনেক শ্যামা সংগীত রচনা করেন। তাঁর রচিত একটি বিখ্যাত শ্যামা সংগীত -
সদানন্দময়ী কালী, মহাকালের মনোমোহিনী গো মা !
তুমি আপন সুখে আপনি নাচ, আপনি দেও মা করতালি।।
আদিভূতা সনাতনী, শূন্যরূপা শশী-ভালী।
ব্রহ্মাণ্ড ছিল না যখন হে মা, মুণ্ডমালা কোথায় পেলি।।
সবে মাত্র তুমি যন্ত্রী, যন্ত্র আমরা তন্ত্রে চলি।
তুমি যেমন রাখো তেমনি থাকি, যেমন বলাও তেমনি বলি।
অশান্ত কমলাকান্ত বলে দিয়ে গালাগালি -
এবার সর্ব্বনাশি, ধ'রে অসি, ধর্ম্মাধর্ম্ম দুটোই খেলি।। কষ্টিপাথরের মাতৃমূর্তি - ১
কষ্টিপাথরের মাতৃমূর্তি - ২ |
কষ্টিপাথরের মাতৃমূর্তি - ৩ |
কষ্টিপাথরের মাতৃমূর্তি - ৪ |
পঞ্চমুণ্ডির আসন ঘর |
শিবলিঙ্গ |
বাঁধানো কুয়া |