শনিবার, ৭ অক্টোবর, ২০২৩

Blue Jagannath Temple, Khristian Para, Kestopur ( Krishnapur ), North 24 Parganas

 নীল  জগন্নাথ  মন্দির,  দেবনাথ  বাড়ি,  খ্রিস্টান  পাড়া,  কেষ্টপুর ( কৃষ্ণপুর ), উত্তর  ২৪  পরগনা 

    শ্যামল  কুমার  ঘোষ 

            উত্তর  ২৪ পরগনার  কেষ্টপুরের  খ্রিস্টান  পাড়ায়  আছে  নীল জগন্নাথ  দেবের  মন্দির।  মন্দির  বললে  ভুল  হবে।  দেবনাথ  বাড়ির  একটি  ঘরে  বলরাম-সুভদ্রার  সঙ্গে  একই  আসনে  নীল  রঙের  জগন্নাথ  বিগ্রহ  পূজিত  হন।  সাধারণত  জগন্নাথ  দেবের  বিগ্রহ  কৃষ্ণ  বর্ণের  হয়।  তবে  এখানে  নীল  বর্ণের  কেন ?  এর  উত্তর  পেতে  হলে  বেশ  কয়েক  বছর  আমাদের  পিছিয়ে  যেতে  হবে।  দেবনাথ  পরিবারের  এক  সদস্য  অঙ্কিত  দেবনাথের  কাছ  থেকে  আমি  সেই  গল্প  জানতে  পারি।

            ২০১৮  তে  ঘটল  বিপত্তি।  তখন  এই  বাড়ির  জগন্নাথ  মূর্তি  ছিল  কৃষ্ণ  বর্ণের।  মূর্তি  ছিল  মৃন্ময়।  সে  বছর  রথের  সময়  অসাবধানতাবশত  সেই  মাটির  জগন্নাথ  মূর্তি  ক্ষতিগ্রস্ত  হল।  এই  ঘটনায়  দেবনাথ  পরিবারের  সকলে  শোকে  মুহ্যমান  হন  এবং  বিপদের  আশঙ্কায়  বিভিন্ন  পণ্ডিতদের  পরামর্শ  গ্রহণ  করেন।  পণ্ডিতদের  পরামর্শে  তাঁরা  ঠিক  করেন  জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রার  দারুমূর্তি  স্থাপন  করবেন।  নবদ্বীপে  এক  দারু  ভাস্করকে  মূর্তি  নির্মাণের  ফরমাশ  দেওয়া হল।  মূর্তি  নির্মাণ  যখন  শেষ  হয়ে  এসেছে  তখন  অঙ্কিত  বাবুর  মা  এক  রাতে  স্বপ্নে  দেখলেন  যে  একটি  নীল  বর্ণের  বালক  তাঁর  দিকে  এগিয়ে  আসছে।  তাঁরা  ভাবলেন  যে  এই  স্বপ্নের  মধ্যেই  ভগবানের  নির্দেশ  রয়েছে।  তাই  ঠিক  হল  জগন্নাথের  রং  করা  হবে  নীল।  নবদ্বীপের  শ্রী  অর্ক  দাস  তিন  বিগ্রহের  অঙ্গরাগ  করলেন।  অপূর্ব  হল  সেই  তিন  বিগ্রহ।  বিশেষ  করে  জগন্নাথের  বিগ্রহ।  জগন্নাথের  সেই  নয়নাভিরাম  রূপ  দেখে  যেন  চোখ  ফেরানো  যায়  না।  

              এই  বাড়িতে  জগন্নাথকে  গোপাল  রূপে  সেবা  করা  হয়।  অঙ্কিত  বাবুর  মা  জগন্নাথকে  ছেলে  বলে  মনে  করেন।  তাই  জগন্নাথের  এই  রকম  মুখশ্রী।  এখানে  উল্লেখ্য,  দেবনাথ  বাড়ির  সুভদ্রার  বিগ্রহটিও  ব্যতিক্রমী।  এখানে  সুভদ্রার  ত্রিনেত্র  যা  অন্য  কোথাও  দেখা  যায়  না।  এটি  করা  হয়  অঙ্কিত  বাবুর  দিদিমার  কথা  মতো।  অঙ্কিত  বাবুর  মামার  বাড়ি  দক্ষিণেশ্বরে।  তাই  দক্ষিণেশ্বরের  মায়ের  রূপ  কল্পনা  করে  এখানে  সুভদ্রার  ত্রিনেত্র।

                এ  বাড়ির  জগন্নাথের  ভোগে  থাকে  ফ্যান-ভাত  ও  ডাল  সেদ্ধ। অঙ্কিত  বাবুর  মা  স্বপ্নে  যখন  জগন্নাথকে  দেখেন  তখন  তিনি  তাঁকে  জিজ্ঞাসা  করেন  "তুমি  যে  আমার  বাড়িতে  আসতে  চাইছো  তা  তোমাকে  আমি  কী  খেতে  দেবো ?  আমার  তো  সেরকম  সামর্থ  নেই।"  প্রত্যুত্তরে  প্রভু  বলেন,  "সামান্য  ফ্যান-ভাত  ও  ডাল  সেদ্ধতেই  আমি  তুষ্ট।"  তাই  প্রতিদিনের  জগন্নাথের  ভোগে  পোলাও,  পরমান্ন  ইত্যাদি  যা-ই  দেওয়া  হোক  না  কেন  সঙ্গে  ফ্যান  ভাত  ও  ডাল  সেদ্ধ  দেওয়া  হবেই।

            ২০০২  খ্রিষ্টাব্দে  এ  বাড়িতে  রথযাত্রা  শুরু  করেছিলেন  অঙ্কিত  বাবুর  ঠাকুরমা।  তখন  রথযাত্রা  হত  ছোটো  করে।  আগে  এঁরা  নয়াপট্টিতে  ভাড়া  থাকতেন।  এ  বাড়ির  সকলে  সেখানে  রথযাত্রা  দেখতে  যেতেন।  কোনো  কারণে  সে  বছর  সেখানে  রথযাত্রা  বন্ধ  থাকে।  তাই  অঙ্কিত  বাবুর  ঠাকুরমার  পরামর্শে  তাঁরা  এই  বাড়িতে  রথযাত্রা  শুরু  করেন।  আগেই  বলা  হয়েছে  যে  তখন  জগন্নাথ  ছিল  মাটির  তৈরি।  নিজের  বাড়িতে  রথযাত্রা  হলেও  তাঁরা  অন্য  আর  একটা  জায়গায়  রথযাত্রা  দেখতে  যেতেন।  ২০১২ -১৩  নাগাদ  সেখানে  রথে  আসীন  জগন্নাথকে  অঙ্কিত  বাবুর  মা  স্পর্শ  করতে  যান।  কিন্তু  কর্তৃপক্ষ  তাঁকে  জগন্নাথকে  স্পর্শ  করতে  বাধা  দেন।  তাঁদের  যুক্তি  ছিল,  মহিলারা  জগন্নাথকে  স্পর্শ  করতে  পারে  না।  এতে  বাড়ির  সকলে  মনঃক্ষুণ্ণ  হয়ে  বাড়ির  রথটিকে  বড়ো  করতে  মনস্ত  করেন।  শুরু  হয়  বড়ো  করে  রথযাত্রা।  এরপর  ২০১৮  তে  অঘটনের  কথা  আগেই  বলা  হয়েছে।  রথযাত্রা  চলতে  থাকে।  ২০২১  ও  '২২  দুবছর  করোনার  কারণে  রথযাত্রা  বন্ধ  থাকে।  ২০২৩ -এ  রথটা  নষ্ট  হওয়ার  কারণে  রথ  টানা  হয়  নি।  তবে  কোলে  করে  বিগ্রহকে  মাসির  বাড়ি  নিয়ে  যাওয়া  হয়।  এখানে  উল্লেখ্য,  এখানে  জগন্নাথের  মাসির  বাড়ি  কাছেই  ঝুলন  মন্দিরের  কাছে  অমিত  মণ্ডলের  বাড়ি।  কেবল  মাত্র  রথযাত্রা  নয়, সারা  বছর  দেবনাথ  বাড়িতে  জগন্নাথের  আরও  নানা  অনুষ্ঠানের  আয়োজন  করা  হয়।  সেই  সব  অনুষ্ঠানে  এবং  রথযাত্রায়  জাতি-ধৰ্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে  সকলে  অংশ  গ্রহণ  করেন।  খ্রিস্টান  পাড়ার  বেশির  ভাগ  খ্রিস্টান  পরিবারের  বাস।  তাঁদের  অনেকেই  এই  সব  অনুষ্ঠানে  এবং  রথযাত্রায়  আন্তরিক  ভাবে  অংশ  গ্রহণ  করে  থাকেন।

            দেবনাথ  বাড়িতে  দারু  নির্মিত  জগন্নাথ-বলরাম-বিগ্রহ  ছাড়াও  পিতলের  গোপাল,  পিতলের  গৌর-নিতাই  ও  অন্যান্য  বিগ্রহ  বর্তমান।  সমস্ত  বিগ্রহই  নিত্য  পূজিত।          

দারু নির্মিত বলরাম-সুভদ্রা-জগন্নাথ
নীল জগন্নাথ
বলরাম ও সুভদ্রা
গোপাল ও অন্যান্য বিগ্রহ

গৌর-নিতাই ও অন্যান্য বিগ্রহ

          কী  ভাবে  যাবেন ?

            কলকাতার  উল্টোডাঙ্গা  ব্রিজের  কাছ  থেকে  কেষ্টপুর  গামী  ১২সি / ২  বাসে  খ্রিস্টান  পাড়ায়  নেমে  দেবনাথ  বাড়ি  বা  নীল  জগন্নাথ  বাড়ি  যাওয়া  যায়।  উল্টোডাঙ্গা  ব্রিজের  কাছ  থেকে  বাগুইআটি  গামী  বাসে  কেষ্টপুরে  নেমে  সাবওয়ে  দিয়ে  রাস্তার  বিপরীত  দিকে  গিয়ে  অটোতে  খ্রিস্টান  পাড়ায়  যাওয়া  যায়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন