রাধা গোবিন্দ জিউর মন্দির, ১৪২ মহাত্মা গান্ধী রোড, বড়বাজার, কলকাতা
শ্যামল কুমার ঘোষ
কলকাতার বড়বাজারের ফলপট্টির কাছে ১৪২, মহাত্মা গান্ধী রোডে বড়বাজারের মল্লিক পরিবারের শ্রীশ্রী রাধা গোবিন্দ জিউর মন্দির অবস্থিত।
সংক্ষিপ্ত পরিচয় : বড়বাজারের এই মল্লিক বংশের রাজারামের পুত্র দর্পনারায়ণ মুসলিম শাসকের ভয়ে খুড়তুতো ভাই সুখরামকে সঙ্গে নিয়ে হুগলির ত্রিবেণী থেকে কলকাতায় চলে আসেন। তাঁর একমাত্র পুত্র নয়নচাঁদ। নয়নচাঁদের তিন পুত্র : গৌরচরণ, নিমাইচরণ ও রাধাচরণ। গৌরচরণের চার পুত্র : বিশ্বম্ভর, রামলোচন, জগমোহন ও রূপলাল। মধ্যম পুত্র রামলোচনের স্ত্রী চিত্রা দাসী এই মন্দির নির্মাণ করেন। তাঁদের পুত্র কাশীনাথ মল্লিক। নয়নচাঁদের মধ্যম পুত্র নিমাইচরণ বড়বাজারে ১৭৩৬ খ্রিস্টাব্দে জন্মগগ্রহণ করেন। তখন বড়বাজারের নাম ছিল কমল নয়নের বেড়। এখানে উল্লেখ্য, নয়নচাঁদ ১১৬২ বঙ্গাব্দে ( ১৭৫৫ খ্রিস্টাব্দে ) হুগলি জেলার মাহেশে শ্রী জগন্নাথ দেবের মন্দির নির্মাণ করেন এবং তাঁর পুত্র নিমাইচরণ ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে বিগ্রহের নিত্য সেবার ব্যবস্থা করেন। ১৪০৩ বঙ্গাব্দে ( ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে ) নয়নচাঁদ মল্লিকের পৌত্র রামমোহন মল্লিকের স্মৃতির উদ্দেশ্যে জগন্নাথ মন্দিরের সিংহদ্বার সংস্কার করেন কাশীনাথ মল্লিকের সেই সময়ের বংশধরগণ। নয়নচাঁদ ও তাঁর পুত্র গৌরচরণ ১৭০৮ শকাব্দে ( ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে ) নদিয়া জেলার কল্যাণীর রথতলার কাঞ্চনপল্লীতে কৃষ্ণরাইয়ের মন্দির নির্মাণ করেন।
রাস্তার উপর রয়েছে দুটি সিংহের মূর্তি যুক্ত একটি বড় দ্বার। দ্বারের পাশে একটি শ্বেতপাথরের ফলকে লেখা রয়েছে যে দ্বারটি সকাল ৭ টা থেকে রাত ৯ টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত খোলা থাকবে। কিন্তু বর্তমানে এই দ্বারটি আর খোলা হয় না। তার ডান পাশে রয়েছে আর একটি ছোট দ্বার। এই দ্বারটি দিয়ে প্রবেশ করলে দেখা যাবে বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা। সেটা পেরোলে ডান দিকে দেখা যাবে একটি দ্বার। দ্বারের মাথায় আছে মন্দিরের প্রতিষ্ঠাফলক। এই দ্বার দিয়ে ঢুকলে পড়বে মন্দির চত্বর। মন্দির চত্বরে ঢুকলে সামনে চোখে পড়বে বড় বড় থামওয়ালা ও কড়ি-বরগাযুক্ত বিশাল নাটমন্দির। তবে নাটমন্দিরটি বর্তমানে জীর্ণ হয়ে পড়েছে। নাটমন্দিরের ছাদে শালের খুঁটি দিয়ে ঠেকনা দেওয়া হয়েছে। নাটমন্দিরের সামনে মূল মন্দির। অল্প উঁচু ভিত্তিবেদির উপর স্থাপিত, পশ্চিমমুখী মন্দিরটি দালান শৈলীর। গর্ভগৃহের সামনে একটি বড় অলিন্দ। ঠাকুর দালানটি সুসংস্কৃত। গর্ভগৃহ ও অলিন্দের মেঝে পাথরের। গর্ভগৃহের সামনে তিনটি কলাপসিবল গেট। বাঁ দিকের গেটের সামনে একটি ধাতুময় সিংহাসনের উপর শ্বেতপাথরের বলরাম, অষ্টধাতুর রেবতী, নারায়ণ ( শিলা ) ও লক্ষ্মী ( কুনকে ) বিরাজমান। মাঝের গেটের সামনে আর একটি ধাতুময় সিংহাসনের উপর অষ্টধাতুর গোবিন্দ ও রাধিকা বিগ্রহ বিরাজমান। সিংহাসনের পায়াগুলোতে নয়নাভিরাম সিংহের মাথা। সিংহাসনের নিচে দুটি শ্বেতপাথরের গাই-বাছুরও খুব সুন্দর। ডান দিকের গেটের সামনে রয়েছে শ্রীশ্রী সিংহবাহিনী মাতার ফটো। এখানে উল্লেখ্য, এই শ্রীশ্রী সিংহবাহিনী মা মল্লিকদের বিভিন্ন শরিকদের বাড়িতে ঘুরে ঘুরে পূজিত হন। এই মন্দিরেরও তিনি আসেন পর্যায়ক্রমে। তাই অন্যত্র তোলা শ্রীশ্রী সিংহবাহিনী মাতার ছবি এখানে যুক্ত করলাম। আরও উল্লেখ্য, ঠাকুর রামকৃষ্ণ শ্রীশ্রী সিংহবাহিনী মাকে দেখতে এই বাড়িতে এসেছিলেন। মন্দির চত্বরের উঠানের মাঝখানে রয়েছে একটি গরুড় মূর্তি। এই গরুড় মূর্তির সামনে, নাটমন্দিরের বিপরীত দিকে একটি পৃথক ঘরে তিনটি খাটের একটির উপর আছেন দারু নির্মিত জগন্নাথ, নারায়ণ ( শিলা ), লক্ষ্মী ( কুনকে ), পিতলের সরস্বতী মূর্তি ও একটি ছোটো কষ্টিপাথরের শিবলিঙ্গ। দ্বিতীয় খাঠের উপর আছেন দারু নির্মিত জগন্নাথ ও একটি কষ্টিপাথরের রাধা-কৃষ্ণ। তৃতীয় খাঠের উপর আছেন দারু নির্মিত কানাই-বলাই। দণ্ডায়মান। সকল বিগ্রহের নিত্য পূজা ছাড়াও মন্দিরে দোলযাত্রা, স্নানযাত্রা, রথযাত্রা, ঝুলন, জন্মাষ্টমী ইত্যাদি অনুষ্ঠানে বিশেষ পূজা অনুষ্ঠিত হয়। ইসকনের প্রতিষ্ঠাতা শ্রী শ্রী প্রভুপাদ ভক্তিবেদান্ত স্বামী ছেলেবেলায় এই মন্দিরের কাছেই থাকতেন এবং তখন তিনি প্রায়ই এই মন্দিরে আসতেন। তাই মন্দিরের সামনের দেওয়ালে তাঁর একটি ছবি টাঙানো আছে।
আগে যে প্রতিষ্ঠাফলকের উল্লেখ করা হয়েছে তা থেকে জানা যায়, রামলোচন মল্লিকের সহধর্মিনী চিত্রা দাসী ১২২৮ বঙ্গাব্দের ৩০ শে মাঘ ( ১৮২১ খ্রিস্টাব্দে ) এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। নাটমন্দিরের গায়ে লাগানো একটি সংস্কার ফলক থেকে জানা যায়, ১৩৯৬ বঙ্গাব্দের ২৫ শে বৈশাখ ( ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে ) মন্দিরটির সংস্কার করা হয়।
|
গোবিন্দ ও রাধিকা বিগ্রহ - ১ |
|
রাধাগোবিন্দ মন্দিরের প্রতিষ্ঠাফলক |
|
গরুড় মূর্তি ও নাটমন্দির |
|
মন্দিরের সংস্কারফলক |
|
মন্দিরের সামনের বিন্যাস |
|
বলরাম, রেবতী, নারায়ণ শিলা ও লক্ষ্মী ( কুনকে ) |
|
বলরাম, রেবতী, নারায়ণ শিলা ও লক্ষ্মী ( কুনকে ) |
|
শ্বেতপাথরের বলরাম ও অষ্টধাতুর রেবতী
|
|
গোবিন্দ ও রাধিকা বিগ্রহ - ২ |
|
শ্বেতপাথরের গাই-বাছুর ও সিংহাসনের পায়া |
|
গোবিন্দ ও রাধিকা বিগ্রহ - ৩ |
|
গোবিন্দ ও রাধিকা বিগ্রহ - ৪ |
|
মন্দিরের শ্রীশ্রী সিংহবাহিনী মাতার ছবি |
|
অন্যত্র তোলা শ্রীশ্রী সিংহবাহিনী মাতা |
|
জগন্নাথ, নারায়ণ শিলা ও লক্ষ্মী ( কুনকে ), সরস্বতী ও শিবলিঙ্গ |
|
জগন্নাথ ও কষ্টিপাথরের রাধা-কৃষ্ণ |
|
দারু নির্মিত কানাই-বলাই |
|
মাহেশের মন্দিরের ফলক - ১ |
|
মাহেশের মন্দিরের ফলক - ২ |
|
কৃষ্ণরাই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাফলক |
সহায়ক গ্রন্থ :
১) কলকাতার বাবু বৃত্তান্ত : মূল লেখক : লোকনাথ ঘোষ ( অনুবাদক : শুদ্ধধন সেন )