জয় মিত্র কালী বাড়ি / কৃপাময়ী কালী মন্দির, বরানগর, উত্তর ২৪ পরগনা
শ্যামল কুমার ঘোষ
কৃপাময়ী কালী মন্দির বরাহনগরের কুঠিঘাটে অবস্থিত একটি প্রাচীন কালী মন্দির। যদিও মন্দিরটি জয় মিত্র কালী বাড়ি নামেই বেশি পরিচিত। ১২৫৭ বঙ্গাব্দের ( ১৮৫০ খ্রীষ্টাব্দ ) চৈত্র সংক্রান্তির দিন মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠা করেন কলকাতার শোভাবাজারের বিখ্যাত ধনী রামচন্দ্র মিত্রের ছেলে জয়নারায়ণ মিত্র। মন্দিরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী দক্ষিণা কালী। বিগ্রহ কষ্টিপাথরে নির্মিত। নির্মাণ করেন পূর্ব বর্ধমান জেলার কাটোয়া মহকুমার অন্তর্গত দাঁইহাটের নবীন ভাস্কর। এখানে উল্লেখ্য, দক্ষিণেশ্বরের মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৫৫ খ্রীষ্টাব্দে। অর্থাৎ, দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরের পাঁচ বছর আগে এই মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়। শ্রীরামকৃষ্ণ এই মন্দিরে কয়েকবার এসেছেন। তিনি কৃপাময়ী মাকে 'মাসি' বলে ডাকতেন।
উঁচু ভিত্তিবেদির স্থাপিত, ত্রিখিলান প্রবেশপথযুক্ত, দক্ষিণমুখী মন্দিরটি নবরত্ন শৈলীর। এক একটি স্তম্ভ 'কলাগেছ্যা' রীতির গোল স্তম্ভগুচ্ছের সমষ্টি। নবরত্নের শিখরগুলি রেখ ধরণের খাঁজ কাটা। মন্দিরের কার্নিস সোজা। দ্বিতলে ওঠার সিঁড়ি আছে। মন্দিরটির সঙ্গে মূলাজোড়ের ব্রহ্মময়ী কালী মন্দিরের খুবই সাদৃশ্য আছে। গর্ভগৃহে ঢোকার একটিই দরজা, সামনে। আর আছে দুটি নকল দরজা। মন্দিরের বাকি তিন দিকে তিনটি করে নকল দরজা আছে। গর্ভগৃহের সামনে অলিন্দ। মন্দিরের দ্বিতলের ছোট দালানের গায়ে ভিনিসীয় দরজা-জানলার চিহ্ন, ওপরে ফ্যান লাইট ( fanlight )। খিলানের উপরে পঙ্খের কাজ আছে। গর্ভগৃহে দেবী কৃপাময়ী নামক দক্ষিণাকালীর মূর্তি প্রতিষ্ঠিত ও নিত্যপূজিত।
মন্দিরের সামনে একটি নাটমন্দির ছিল। অনেক দিন আগে উপরের ছাদ পড়ে গিয়েছিল। এখন আবার নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছে। কয়েক বছর আগে মিত্র পরিবার মন্দিরের জমির কিছু অংশ এক প্রমোটারকে বিক্রি করে দেন। চুক্তি অনুযায়ী তিনি মন্দিরটি সংস্কার করে দেন।
মন্দিরটি পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। পশ্চিম দিকে গঙ্গার পাশে রাস্তা। তারপরই মন্দিরে ঢোকার প্রধান ফটক। ফটকের দুদিকের স্তম্ভের মাথায় দুটি মাঝারি আকারের সিংহ মূর্তি। এই ফটক দিয়ে ঢুকলে দুপাশে ছয়টি করে মোট বারোটি আটচালা শৈলীর শিব মন্দির। প্রতিটি শিব মন্দিরে শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত। প্রতিটি শিবলিঙ্গের আলাদা-আলাদা নাম। উত্তরদিকের শিব মন্দিরগুলির নাম ( পূর্ব থেকে পশ্চিমে ) : পশুপতিনাথ, বিশ্বনাথ, বৈদ্যনাথ, চন্দ্রনাথ, অমরনাথ ও ভুবনেশ্বর। দক্ষিণ দিকের শিব মন্দিরগুলির নাম ( পশ্চিম থেকে পূর্ব ) : রামেশ্বর, উমানন্দ, কেদারনাথ, সোমনাথ, তারকনাথ ও আদিনাথ। শিব মন্দির প্রাঙ্গণে সারি সারি তুলসীমঞ্চ আছে।
কৃপাময়ী কালীর মন্দিরে অনেক আগে পশুবলি হত। ১৩০৭ বঙ্গাব্দে ( ১৯০০ খ্রি. ) বালানন্দ ব্রহ্মচারীর নির্দেশে সেই বলিদান প্রথা বন্ধ হয়ে যায়। এ বিষয়ে একটি পদ্য মন্দিরের বাঁ দিকে তুলসীমঞ্চের দেওয়ালে খোদাই করা আছে :
সিন্দু বিন্দু নেত্র চন্দ্র পরিমিত সনে,
পূর্ণানন্দে সাথে করি এক শুভক্ষণে,
বালানন্দ ইষ্টদেব আসিয়া হেতায়,
হেরিলেন জীববলি আর্ত্ত বেদনায়
ক্ষান্ত কর রক্তস্রোত দিলেন বিধান।
সে বিধান মেনে নিল ভক্ত পুণ্যবান।।
-- তারানন্দ ও কৃষ্ণানন্দ
অর্থাৎ সিন্দু = ৭, বিন্দু = ০, নেত্র ৩, চন্দ্র = ১ অঙ্কের বামাগতি নিয়মানুসারে ১৩০৭ বঙ্গাব্দে ( ১৯০০ খ্রি. ) বালানন্দ ব্রহ্মচারী এক শুভক্ষণে পূর্ণানন্দকে সঙ্গে নিয়ে এখানে এসে জীববলি দেখে বেদনার্ত হন। সেই রক্তস্রোত বন্ধ করার বিধান দিলে পুণ্যবান ভক্তগণ তা মেনে নেন।
কী ভাবে যাবেন ?
হাওড়া, শিয়ালদহ বা শ্যামবাজার থেকে বি. টি. রোড গামী বাসে উঠে সিঁথির মোড়ে নামুন। সেখান থেকে কুঠিঘাট গামী অটোতে উঠে কুঠিঘাটে নামুন। সেখান থেকে কাছেই মন্দির।
মন্দিরটি পরিদর্শনের তারিখ : ১৮.০৮.২০২১
|
মন্দিরের শিখর |
|
নাটমন্দিরসহ কৃপাময়ী কালী মন্দির, বরানগর ( দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে তোলা ) |
|
নাটমন্দিরসহ কৃপাময়ী কালী মন্দির, বরানগর ( সামনে থেকে তোলা ) |
|
মন্দিরের ত্রিখিলান বিন্যাস |
|
মাঝের খিলানের উপরের কাজ |
|
'কলাগেছ্যা' রীতির গোল স্তম্ভগুচ্ছ |
|
দ্বিতলের দেওয়ালের কাজ |
|
উত্তরদিকের তিনটি শিব মন্দির |
|
শ্বেতপাথরের ফলক |
|
সিংহ দরজা |
|
কৃপাময়ী কালী মাতা - ১ |
|
কৃপাময়ী কালী মাতা - ২ |
|
কৃপাময়ী কালী মাতা - ৩ |
সহায়ক গ্রন্থ
১) বাংলার মন্দির স্থাপত্য ও ভাস্কর্য : প্রণব রায়
********
পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য কালী মন্দির সম্বন্ধে জানতে নিচের লিংকে ক্লিক করুন / লিংকের উপর আঙুল দিয়ে টোকা দিন :