কৃষ্ণচন্দ্র রায় দেব মন্দির, উলা বীরনগর, নদিয়া
শ্যামল কুমার ঘোষ
শিয়ালদহ-কৃষ্ণনগর রেলপথে বীরনগর একটি স্টেশন। কলকাতা থেকে রেলপথে দূরত্ব ৮১.৬ কিমি। বীরনগর স্টেশন থেকে ২ কিমি পূর্ব দিকে উলার মুস্থাফি পাড়া। এই পাড়ার মিত্র মুস্থাফিদের রাধাকৃষ্ণের জোড়বাংলা মন্দিরটি বিখ্যাত। মন্দিরটি টেরাকোটা অলংকরণে অলংকৃত।
বীরনগরের প্রাচীন নাম উলা। উলা নামকরণ সম্পর্কে নানান লোকশ্রুতি প্রচলিত আছে। উলুবন পরিষ্কার করে প্রথম বসতি স্থাপিত হয় বলে নাম হয় উলা। আবার অনেকে বলেন এই গ্রামের প্রাচীন ও বিখ্যাত দেবতা উলাই চণ্ডীর নামানুসারে নাম হয় উলা। এখানে একসময় গ্রামবাসীদের চেষ্টায় এক দুর্ধর্ষ ডাকাতদল ধরা পড়লে ইংরেজ সরকার উলার নতুন নামকরণ করেন বীরনগর অর্থাৎ বীরদের নগর।
উলার প্রাচীন জমিদার মুস্তৌফি বংশের প্রতিষ্ঠাতা রামেশ্বর মিত্র মুর্শিদকুলী খাঁর রাজত্বকালে বাংলার মুস্তৌফি (= নায়েব কানুনগো ) পদে নিযুক্ত হন। তিনি ১৬১৬ শকাব্দে ( ১৬৯৪ খ্রীষ্টাব্দে ) মুস্তাফি পাড়ায় তাঁর বসতবাড়ির কাছে রাধাকৃষ্ণের একটি সুন্দর জোড়বাংলা মন্দির নির্মাণ করেন। দুটি 'দোচালা' বা 'একবাংলা' জোড়া দিয়ে এ ধরণের মন্দির তৈরি হয় বলে এই স্থাপত্যশৈলীর নাম 'জোড়বাংলা'। মন্দিরটির সামনের দিকে পোড়ামাটির প্রতিষ্ঠা-ফলকের পাঠ হল :
অঙ্গৈককালেন্দুমিতে
শকাব্দে ১৬১৬ কায়স্থ
কায়স্থহবেষ ধর্ম্মঃ।
যো নির্ম্মমে শ্রীহরিযুগ্ম ধাম
শ্রীযুত রামেশ্বরমিত্রদাস।
অর্থাৎ ১৬১৬ শকাব্দে ( ১৬৯৪ খ্রীষ্টাব্দে ) কায়স্থকুলোদ্ভব শ্রী রামেশ্বর মিত্র শ্রীহরির এই যুগ্মগৃহ নির্মাণ করলেন। এখানে 'অঙ্গ' = ছয়, 'এক' = এক, 'কাল' = ছয়, 'ইন্দু' = এক ধরে অঙ্কের বামাগতি নিয়মানুসারে ১৬১৬ শকাব্দ হয়েছে। মন্দিরে রাধাকৃষ্ণ বিগ্রহ নিত্যপূজিত। মন্দিরের কৃষ্ণ বিগ্রহটি রামেশ্বর মিত্র প্রতিষ্ঠিত। রাধিকা মূর্তিটি কোন এক সময়ে চুরি গেলে পুনরায় অন্য মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়।
ভিত্তিবেদির উপর স্থাপিত, পশ্চিমমুখী এই মন্দিরের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা যথাক্রমে ৬.৭ মি. , ৬.৭ মি. এবং ৭.৬ মি.। প্রতিটি দোচালার প্রস্থ ৩.৩ মি.। প্রথম দোচালাটি অলিন্দ এবং দ্বিতীয় দোচালাটি গর্ভগৃহ হিসাবে ব্যবহৃত হয়। উৎকৃষ্ট টেরাকোটা অলংকারে মন্দিরটি অলংকৃত। পাদপীঠ সংলগ্ন দেওয়াল থেকে আরম্ভ করে সামনের দিকের প্রায় সর্বত্রই পোড়ামাটির অলংকরণ দেখা যায়। কারিগরি নৈপুণ্যে সেগুলি নদিয়া জেলার টেরাকোটা মন্দিরগুলির মধ্যে শ্রেষ্ঠ নিদর্শনের তুল্য হলেও অপটু হাতের সংস্কারে ও রঙের প্রলেপে তা এখন অনেকটাই ম্লান। বাইরের দেওয়ালে, ভিত্তিবেদি-সংলগ্ন দুটি অনুভূমিক সারির নিচের সারিতে টেরাকোটায় পালকিবাহিত বাবু ও রক্ষকগণ, নৌকাভ্রমণ, মুঘল যোদ্ধা, বানিজ্যতরী, মৃগয়া প্রভৃতি সামাজিক চিত্র ও উপরের সারিতে একটানা হংসশ্রেণী উৎকীর্ণ আছে। বাইরের ত্রিখিলান প্রবেশপথের তিনদিক ঘিরে কুলুঙ্গিতে নিবদ্ধ এক সারি মূর্তি-ভাস্কর্যের মধ্যে কৃষ্ণলীলা, রাম, লক্ষ্মণ, ভরত, শত্রুঘ্ন ও শিবদূর্গা প্রভৃতি পৌরাণিক দেবদেবীই প্রধান। বাঁ দিকের স্তম্ভের গায়ে কার্তিক-গনেশসহ মহিষমর্দিণী মূর্তিটি সুন্দর। দেওয়ালের বাকি অংশে ফুলকারি নকশা দ্বারা অলংকৃত। গর্ভগৃহে ( দ্বিতীয় দোচালা ) প্রবেশপথের উপরেও টেরাকোটার কিছু কাজ আছে। সেখানে, খিলানশীর্ষের দুপাশে দুটি লম্ফমান সিংহ দৃষ্টি-আকর্ষণী।
মিত্র মুস্তাফিদের কাঠের তৈরি কারুকার্যশোভিত একটি দুর্গামণ্ডপ ছিল। শোনা যায় সেই সময় এই দুর্গামণ্ডপটি দেখার জন্য বাংলার বিভিন্ন স্থান থেকে অনেক লোক এখানে হাজির হত। অনেক দিন হল সেটি একপ্রকার বিনষ্ট। শুধু কাঠের ওপর খোদাই করা কয়েকটি থাম বা কড়ি ইঁটের তৈরি নতুন দুর্গামণ্ডপে রাখা আছে। কীটপতঙ্গের অত্যাচারে সেগুলিও এখন জীর্ণ-দীর্ণ।
উপরোক্ত মন্দিরে যেতে হলে শিয়ালদহ থেকে লালগোলা প্যাসেঞ্জার বা কৃষ্ণনগর লোকালে উঠুন। নামুন বীরনগর স্টেশনে। স্টেশনের পূর্ব দিক থেকে টোটো বা রিকশায় উঠে পৌঁছে যান মন্দিরে।
 |
জোড়বাংলা মন্দির, উলা বীরনগর |
 |
মন্দিরের সামনের ত্রিখিলান প্রবেশপথ |
 |
মাঝের খিলানের উপরের কাজ |
 |
মন্দিরের প্রতিষ্ঠা-ফলক |
 |
ভিত্তিবেদি-সংলগ্ন টেরাকোটার কাজ - ১ |
 |
ভিত্তিবেদি-সংলগ্ন টেরাকোটার কাজ - ২ |
 |
ভিত্তিবেদি-সংলগ্ন টেরাকোটার কাজ - ৩ |
 |
কুলুঙ্গিতে নিবদ্ধ ও আশেপাশের টেরাকোটার কাজ - ১ |
 |
কুলুঙ্গিতে নিবদ্ধ ও আশেপাশের টেরাকোটার কাজ - ২ |
 |
কুলুঙ্গিতে নিবদ্ধ ও আশেপাশের টেরাকোটার কাজ - ৩ |
 |
মন্দিরের শিখরদেশ |
 |
গর্ভগৃহের সামনের খিলানের উপরের কাজ |
 |
মন্দিরের বিগ্রহ - ১ |
 |
মন্দিরের বিগ্রহ - ২ |
 |
বিনষ্ট দুর্গামণ্ডপের কাঠের উপর কারুকার্যের নমুনা
|
মন্দিরটি পরিদর্শনের তারিখ : ০৩.১১.২০১৫
সহায়ক গ্রন্থাবলি :
১. বাংলার মন্দির স্থাপত্য ও ভাস্কর্য : প্রণব রায় ২. নদিয়া জেলার পুরাকীর্তি : মোহিত রায় (তথ্য-সংকলন ও গ্রন্থনা )
-------------------------------------------
রামায়ণের ৭টি খণ্ডের ৬৪ টি উপাখ্যান ও ১৮৫ টি টেরাকোটা ফলকের আলোকচিত্র সংবলিত আমার লেখা এবং 'রা প্রকাশন' কর্তৃক প্রকাশিত বই 'বাংলার টেরাকোটা মন্দিরে রামায়ণ' প্রকাশিত হয়েছে। বইটির মুদ্রিত মূল্য - ৫৯৯ টাকা।
বইটি ডাক যোগে সংগ্রহ করতে হলে যোগাযোগ করুন : 9038130757 এই নম্বরে। কলকাতার কলেজস্ট্রিটের মোড়ে দুই মোহিনীমোহন কাঞ্জিলালের কাপড়ের দোকানের মাঝের রাস্তা ১৫, শ্যামাচরণ দে স্ট্রিটের উপর অবস্থিত বিদ্যাসাগর টাওয়ারের দু'তলায় 'রা প্রকাশনে'র দোকান। ওখান থেকে বইটি সংগ্রহ করতে পারেন। কোনও অসুবিধা হলে উপরোক্ত নম্বরে ফোন করতে পারেন।
প্রকাশনীতে বইটি সেরা বইয়ের সম্মান স্বর্ণকলম ২০২৫ পেয়েছে ।