রাধাবল্লভ মন্দির, কান্দি, মুর্শিদাবাদ
শ্যামল কুমার ঘোষ
ভাগীরথীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত কান্দি মুর্শিদাবাদ জেলার একটি মহকুমা ও পৌর শহর। সিংহ বংশের প্রাণপুরুষ ( ভাগীরথীর পূর্ব তীরে বোয়ালিয়া গ্রামের আদি অধিবাসী ) উত্তররাঢ়ী কায়স্থ বংশীয় হরেকৃষ্ণ সিংহ ছিলেন একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ও তেজারতি কারবারি। তাঁর পুত্র মুরুলীধরও ছিলেন একজন বড় ব্যবসায়ী। তাঁর তিন পুত্র - নারায়ণ, গৌরাঙ্গ ও বিহারী। মধ্যম পুত্র গৌরাঙ্গ ছিলেন নবাবী আমলের সরকারি চাকুরে। গৌরাঙ্গ সিংহ কান্দিতে তাঁর বাসভবনের কার্নিশ তৈরি করেন সিরাজের রাজপ্রাসাদের অনুকরণে। ক্ষিপ্ত হয়ে সিরাজ গৌরাঙ্গকে বন্দি করেন এবং তাঁর বাসভবন ধ্বংস করেন। গৌরাঙ্গ সিংহ তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র ( বিহারী সিংহের পুত্র ) রাধাকান্তকে দত্তক নেন ১৭২৮ খ্রীষ্টাব্দে। নবাব আলীবর্দী ও সিরাজের সময় কানুনগো রাধাকান্ত রাজস্ব বিষয়ে দক্ষতার পরিচয় দেন। এই রাধাকান্তই নাকি সিরাজের বিরুদ্ধে হীন চক্রান্তের নায়কদের অন্যতম ছিলেন। পুরস্কার স্বরূপ ক্লাইভ ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দে রাধাকান্তকে রাজস্ব বিভাগে একজন তত্ত্বাবধায়ক হিসাবে নিযুক্ত করেন। পরে তিনি দেওয়ান হন। কান্দির রাধাবল্লভ মন্দির তাঁরই প্রতিষ্ঠিত। মন্দিরের নিস্কর জমি দেন মোঘল বাদশা দ্বিতীয় শাহ আলম।
এই বংশের সবচেয়ে বিতর্কিত ব্যক্তি ছিলেন রাধাকান্তের কনিষ্ট ভ্রাতা গঙ্গাগোবিন্দ সিংহ। তিনি বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের ভিত্তি শক্ত করতে প্রভূত সাহায্য করেন। কথিত আছে, অত্যাচারী ওয়ারেন হেস্টিংসের ডান হাত ছিলেন এই গঙ্গাগোবিন্দ। এদেশীয় অনেক জমিদার ও ছোটখাট রাজবংশ ধ্বংস সাধনে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে সাহায্য করার জন্য তিনি ব্রিটিশের কাছ থেকে প্রচুর ইনাম পান। সেই সময়ে তিনি বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার অত্যন্ত প্রভাবশালী দেওয়ান হিসাবে কুখ্যাত হয়েছিলেন। অপর দিকে তিনি ছিলেন শিক্ষানুরাগী ও দানশীল। গঙ্গাগোবিন্দের পুত্র প্রাণকৃষ্ণ সিংহ নবাব দরবারে দেওয়ান ছিলেন।
প্রাণকৃষ্ণের পুত্র কৃষ্ণচন্দ্র সিংহ ১৭৭৫ খ্রীষ্টাব্দে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি 'লালাবাবু' নামে পরিচিত ছিলেন। এখানে উল্লেখ্য, উত্তর ভারতে কায়স্থদের লালা বলা হয়। তিনি কান্দির সিংহ পরিবারের সবচেয়ে খ্যাতিমান পুরুষ ছিলেন। কলকাতায় প্রয়োজনীয় শিক্ষালাভের পর মাত্র ১৭ বছর বয়সে কর্মজীবন শুরু করেন জেলা জজের অফিসে সেরেস্তাদার হিসাবে। পরবর্তীকালে ইংরেজ কোম্পানির উড়িষ্যার দেওয়ান পদে আসীন হন। ধর্মপ্রাণ কৃষ্ণচন্দ্র ১৮০৮ খ্রীষ্টাব্দে কান্দির জমিদারি পান। তিনি বাংলা, উড়িষ্যা ও উত্তরপ্রদেশে বেশ কয়েকটি মন্দির, অতিথিশালা ও দরিদ্রনারায়ণ সেবাসত্র স্থাপন করেন। একদিন তিনি পালকি করে ফিরছিলেন। হঠাৎ তিনি শুনতে পান, একটি ধোপার মেয়ে তার ঘুমন্ত বাবাকে ডাকছে, " ওঠ বাবা, বেলা যায়।" এই শুনে কৃষ্ণচন্দ্রের মনে বৈরাগ্য জেগে ওঠে। তিনি মনে মনে বলেন, সত্যই তো জীবনের বেলা শেষ হয়ে আসছে। অথচ পরমপুরুষের সন্ধান এখনও পাওয়া হল না। তিনি স্ত্রী কাত্যায়নী, একমাত্র নাবালক পুত্র নারায়ণ সিংহ ও বিশাল জমিদারি ছেড়ে বৃন্দাবনে চলে যান। সেখানে তিনি বৈষ্ণব সাধু কৃষ্ণদাস-বাবাজীর আশ্রিত হন এবং প্রকৃত ত্যাগী-সন্ন্যাসীর জীবন-যাপন করেন। বৃন্দাবনে তিনি কয়েকটি মন্দির নির্মাণ করেন। সেখানে মাত্র ৪৬ বছর বয়সে মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় ঘোড়ার পায়ের আঘাতে তাঁর জীবনাবসান হয়।
অপুত্রক ও স্বল্পায়ু নারায়ণ সিংহের তিনটি বিবাহ। প্রথম স্ত্রী তারাসুন্দরী ও তৃতীয়া করুণাময়ী দত্তক নেন যথাক্রমে হরিমোহন ( প্রতাপচন্দ্র ) ও রামমোহনকে ( ঈশ্বরচন্দ্র )। এঁরা দুজনেই ছিলেন কাত্যায়নীর ভ্রাতা কৃষ্ণচন্দ্র ঘোষের পুত্র।
প্রতাপচন্দ্র কান্দিতে একটি ইংরেজি বিদ্যালয় ও নাট্যশালা প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি কলকাতার 'বেলগাছিয়া ভিলা ' বাগানবাড়িটি দ্বারকানাথ ঠাকুরের কাছ থেকে কিনেছিলেন। সেখানে তিনি 'বেলগাছিয়া নাট্যশালা' প্রতিষ্ঠা করেন। এই নাট্যমঞ্চে রামনারায়ণ তর্করত্নের 'রত্নাবলী' ও মাইকেল মধুসূদন দত্তের শর্মিষ্ঠা নাটক অভিনীত হয়।
এই পরিবারের বিমলচন্দ্র সিংহ ছিলেন বিধানচন্দ্র রায়ের মন্ত্রিসভার ভূমিরাজস্ব মন্ত্রী। মন্ত্রী অতীশচন্দ্র সিংহ ও পরমাণু বিজ্ঞানী বিকাশচন্দ্র সিংহ এই বংশের সন্তান।
কান্দি শহরের অন্যতম দ্রষ্টব্য কান্দি রাজবংশের কুলদেবতা রাধাবল্লভের মন্দির। রাজবাড়ির কাছেই অবস্থিত এই মন্দির। এত বড় দেবালয় বাংলায় খুব কমই আছে। এখানে আছে কয়েকটি মহল। একটি মহলের একটি দোতলা বাড়ির একতলার একটি ঘরে রাধাবল্লভ ও রাধিকা মূর্তি একটি রুপোর সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত। ঘরের সামনে গাছগাছালিতে ভরা উঠান এবং তাকে ঘিরে চকমিলানো সব ঘর। রাধাবল্লভ বিগ্রহ কষ্টিপাথরের ও রাধিকা মূর্তি ধাতুময়ী। মন্দিরে টাঙানো একটি নোটিশ বোর্ড থেকে জানা যায় যে হরেকৃষ্ণ সিংহের মধ্যম পুত্র গৌরাঙ্গ সিংহ এই রাধাবল্লভ বিগ্রহের প্রতিষ্ঠাতা। পূর্বে রাধাবল্লভ বিগ্রহ এক ব্রাহ্মণের বাড়িতে পূজিত হতেন। একদিন রাতে রাধাবল্লভ সেই ব্রাহ্মণকে স্বপ্নে আদেশ দেন, কালকে তুমি আমাকে গৌরাঙ্গ সিংহের বাড়িতে রেখে আসবে। অনুরূপ স্বপ্ন তিনি গৌরাঙ্গ সিংহকেও দিয়েছিলেন যাতে তিনি সেই বিগ্রহ গ্রহণ করেন। রাধিকা মূর্তিটি পরে সংযোজিত হয়। সিংহাসনের নিচের অংশের লেখা থেকে জানা যায় যে সিংহাসনটি তৈরি করেন কান্তিচন্দ্র সিংহ ও যোগমায়া দাসী। এই কান্তিচন্দ্র ছিলেন প্রতাপচন্দ্রের পুত্র। এর পাশের একটি মহলে আয়তক্ষেত্রাকার চৌহদ্দির মাঝখানের উঠানে থামওয়ালা চাঁদনি আকৃতির সুন্দর নাটমন্দির এবং তাকে ঘিরে চকমিলানো বড় বড় ঘর। প্রতিটি ঘরে আছে একটি করে পত্রাকৃতি খিলান বিশিষ্ট বড় দরজা। এই ঘরগুলির সামনে বড় বড় থামওয়ালা টানা অলিন্দ। নাটমন্দিরে আছে সুন্দর পঙ্খের কাজ। এখানের এক দিকের তিনটি ভিন্ন ভিন্ন ঘরে কষ্টিপাথরের মদনমোহন, গোবিন্দ ও গোপাল ও বিপরীত দিকের একটি ঘরে দারু নির্মিত জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা নিত্য পূজিত হন। মন্দিরে সারা বছর ধরে চলে নানা উৎসব। কান্দির রাধাবল্লভ মন্দিরে রাসযাত্রা বিখ্যাত। রাসযাত্রা উপলক্ষ্যে বৃহৎ দালান মন্দিরের বিরাট চত্বরে রামায়ণ, মহাভারত ও পৌরাণিক কাহিনীর কিছু কিছু ঘটনা মাটির মূর্তি দিয়ে পরিবেশন করা হয়। নাটমন্দিরে কীর্তন ও অন্যান্য অনুষ্ঠানের আসর বসে। এই উপলক্ষ্যে মন্দিরের বাইরে কয়েক দিন মেলা বসে। প্রতি বছর এই মন্দিরে রথযাত্রা উৎসবেরও আয়োজন করা হয়। রথের দিন তিনটি রথে চড়ে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা কান্দি শহর পরিক্রমা করেন। প্রাচীন এই রথযাত্রা দেখতে বহু মানুষ ভিড় করেন। আগে পাশেই মাসির বাড়ি ছিল। কিন্তু এখন সেই বাড়ি ভেঙে যাওয়ার কারণে পরিক্রমা শেষে আবার বিগ্রহ মন্দিরে ফিরে আসেন। বিগ্রহ রাখা হয় অন্য একটি ঘরে। সেই ঘরে আট দিন ধরে চলে নিত্য পূজা ও ভোগ নিবেদন। এ ছাড়াও মন্দিরে জন্মাষ্টমী, ঝুলন ও অন্যান্য উৎসব পালন করা হয়। জনশ্রুতি, মুর্শিদাবাদের কান্দির জমিদার সিংহ বাড়ির কুলদেবতা রাধাবল্লভকে যে ভোগ দেওয়া হত সেই ভোগকে কালক্রমে রাধাবল্লভি বলা হত। রাধাবল্লভের নাম থেকে রাধাবল্লভি নাম হয়েছে। যদিও এর ভিন্ন মত আছে।
|
নাটমন্দির |
|
রাধাবল্লভ মন্দির, কান্দি, মুর্শিদাবাদ |
|
রাধাবল্লভ ও রাধারানি বিগ্রহ |
|
রাধাবল্লভ ও রাধারানি বিগ্রহ ( বড় করে ) |
|
রাধাবল্লভের সিংহাসনের উপরের অংশ |
|
রাধাবল্লভের সিংহাসনের নিচের অংশ |
|
পূর্ব দিকের অলিন্দ থেকে দেখা নাটমন্দির |
|
নাটমন্দির - ২ |
|
নাটমন্দির - ৩ |
|
পূর্ব দিকের অলিন্দ ও ঠাকুর ঘর ( এ দিকেই আছেন মদনমোহন, গোবিন্দ ও গোপাল )
|
|
মদনমোহন-রাধারানি ও অন্য রাধা-কৃষ্ণ |
|
গোবিন্দ-রাধারানি ও অন্য রাধা-কৃষ্ণ |
|
গোপাল, গৌর-নিতাই ও রাধা-কৃষ্ণ |
|
পশ্চিম দিকের অলিন্দ - ১ |
|
পশ্চিম দিকের অলিন্দ ও ঘর ( এ দিকেই আছেন জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রা ) |
|
জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রা |
|
ছোট জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রা |
|
নারায়ণ শিলা |
সহায়ক গ্রন্থ / প্রবন্ধ :
১) বাংলার খেতাবী রাজ-রাজরা : বিমল চন্দ্র দত্ত
২) কান্দির সিংহ বংশীয় রাজ বাড়ির ইতিহাস : ড : তাপস বন্দোপাধ্যায়
-----------------------------------
আমার ইমেল : shyamalfpb@gmail.com প্রয়োজনে যোগাযোগ করতে পারেন।