মঙ্গলবার, ১০ মে, ২০২২

Gandheswari Temple, Rajendra Deb Lane, Kolkata

 

গন্ধেশ্বরী  মন্দির,  রাজেন্দ্র  দেব  লেন,  কলকাতা

                                 শ্যামল  কুমার  ঘোষ

             গন্ধবণিক  সম্প্রদায়ের  পূজিতা  দেবী  গন্ধেশ্বরী।  তিনি  দেবী  দুর্গারই  আর  এক  রূপ।  গন্ধবণিক  সম্প্রদায়  হচ্ছে  বাঙালি  হিন্দু  বণিক  সম্প্রদায়ের  একটি  গোষ্ঠী  যাঁরা  প্রাচীন  কাল  থেকে  মূলত  গন্ধ  দ্রব্যের  ব্যবসা  করে  আসছেন।  গন্ধ  দ্রব্য  যেমন -  প্রসাধন  দ্রব্য,  ধূপ,  চন্দন  কাঠ,  সিঁদুর,  বিভিন্ন  রকমের  মশলা  ইত্যাদি।  পরে  অবশ্য  তাঁরা  অন্য  ব্যবসাতেও  যুক্ত  হয়েছেন।  যেমন - ওষুধ,  অস্ত্র  ইত্যাদি।  বন্দুক  ব্যবসায়ী  এন. সি. দাঁয়ের  পরিবার  ও  শোভাবাজারের  বিশিষ্ট  ব্যবসায়ী  বটকৃষ্ণ  পালের  পরিবার  এই  গন্ধবণিক  সম্প্রদায়ভুক্ত।    

            দেবী  গন্ধেশ্বরীর  উৎপত্তির  পৌরাণিক  কাহিনী :  সুভুতির  ঔরসে  ও  তপতি  নামের  এক  রাক্ষসীর  গর্ভে  গন্ধাসুরের  জন্ম।  মহাদেবের  বরে  সে  পরাক্রমশালী  ও  ত্রিভুবনবিজয়ী  হয়ে  ওঠে।  সুভুতি  বৈশ্যকন্যা  সুরূপাকে  হরণ  করতে  গিয়ে  বৈশ্যদের  কাছে  চূড়ান্ত  অপমানিত  হয়।  গন্ধাসুর  পিতার  অপমানের  প্রতিশোধ  নেওয়ার  জন্য  বৈশ্যদের  উপর  অত্যাচার  শুরু  করে।  একদিন  সুবর্ণবট  নামক  এক  বৈশ্যকে  আক্রমণ  করে  হত্যা  করে।  তাঁর  স্ত্রী  চন্দ্রাবতী  প্রাণ  ভয়ে  পালিয়ে  গিয়ে  এক  বনে  আশ্রয়  নেন।  চন্দ্রাবতী  ছিলেন  গর্ভবতী।  বনে  তিনি  এক  কন্যা  সন্তানের  জন্ম  দিয়ে  মারা  যান।  সেই  বনে  ছিল  ঋষি  কশ্যপের  আশ্রম।  ঋষি  কশ্যপ  ধ্যানযোগে  এই  ঘটনা  জেনে  সেখানে  উপস্থিত  হয়ে  মৃতা  চন্দ্রাবতীর  পাশে  সেই  শিশুকন্যার  দেখা  পেলেন।  চন্দ্রাবতীর  দেহ  যথাযথ  সৎকার  করে  তিনি  সেই  শিশুকন্যাকে  নিজ  আশ্রমে  নিয়ে  এলেন।  শিশুকন্যার  দেহ  থেকে  সুগন্ধ  ছড়াতে  দেখে  শিশুকন্যার  নাম  রাখলেন  গন্ধবতী।  বড়  হয়ে  গন্ধবতী  ঋষির  কাছে  তার  পিতামাতার  মৃত্যুর  কারণ  জানলেন।  সব  জেনে  তাঁর  মনে  প্রতিশোধের  আগুন  জ্বলে  উঠল।  গন্ধবতী  যজ্ঞের  আগুন  জ্বেলে  মহামায়ার  তপস্যায়  ব্রতী  হলেন।  এদিকে  গন্ধাসুর  গন্ধবতীর  রূপলাবণ্যের  কথা  শুনে  সেই  আশ্রমে  উপস্থিত  হল।  ধ্যানমগ্ন  গন্ধবতীকে  দেখে  তার  রূপে  মোহিত  হয়ে  তাকে  প্রেম  নিবেদন  করতে  লাগল।  কিন্তু  কিছুতেই  গন্ধবতীর  ধ্যান  ভঙ্গ  না  হওয়াতে  উত্তেজিত  হয়ে  তার  চুলের  মুঠি  ধরে  আকর্ষণ  করল।  নারীর  অপমানে  রুষ্ট  হয়ে  যজ্ঞকুণ্ড  ধূমায়িত  হয়ে  উঠল  এবং  সেই  যজ্ঞকুণ্ড   থেকে  উঠে  এলেন  অস্ত্রশস্ত্রে  সজ্জিতা  চতুর্ভুজা  এক  সিংহবাহিনী  দেবী।  গন্ধবতীর  ধ্যান  ভঙ্গ  হল।  তিনি  দেবীকে  প্রণাম  করলেন।  দেবী  তাঁকে  অভয়  দান  করে  রোষ-নয়নে  গন্ধাসুরের  দিকে  এগিয়ে  গেলেন।  গন্ধাসুর  বিশাল  দেহ  ধারণ  করে  দেবীকে  আক্রমণ  করল।  শুরু  হল  ঘোরতর  যুদ্ধ।  দেবতারা  সেই  যুদ্ধ  দেখতে  ছুটে  এলেন।  তুমুল  যুদ্ধের  শেষে  দেবী  তাঁর  ত্রিশুল  দিয়ে  গন্ধাসুরকে  বিদ্ধ  করে  বধ  করলেন।  তারপর  দেবী  প্ৰচণ্ড  রোষে  গন্ধাসুরের  দেহ  সমুদ্রে  নিক্ষেপ  করলেন।  উপস্থিত  দেবতারা  দেবীর  নাম  দিলেন  'গন্ধেশ্বরী'।  দেবীর  ইচ্ছানুসারে  গন্ধাসুরের  বিশাল  দেহ  পরিণত  হল  এক  বিশাল  দ্বীপে।  সেই  দ্বীপে  উদ্ভূত  হল  মশলা  ও  সুগন্ধি  বৃক্ষ-লতা।  দেবী  বেনে  সম্প্রদায়ের  একটি  গোষ্ঠীকে  সেই  দ্বীপ  থেকে  মশলা,  গন্ধদ্রব্য  ইত্যাদি  আহরণ  করে  বাণিজ্য  করার  অধিকার  দিলেন,  তাঁদের  নাম  হল  গন্ধবণিক।            

             কলকাতায়  গন্ধেশ্বরী  মাতার  মন্দির  আছে  ঠনঠনিয়া  সিদ্ধেশ্বরী  কালী  মন্দিরের  অনতিদূরে।  বর্তমান  ঠিকানা -  ২১ সি,  রাজেন্দ্র  দেব  লেন।  পশ্চিমমুখী  মন্দিরটি  একটি  ছোট  ঘর  মাত্র।  সামনে  একটি  নাটমন্দির  আছে।  গর্ভগৃহে  অষ্টধাতুর  গন্ধেশ্বরী  মাতা  প্রতিষ্ঠিতা।  বিগ্রহ  প্রায়  তিন  ফুট  উঁচু।  চতুর্ভুজা  দেবী  সিংহের  উপর  আসিনা।  ত্রিশূল  দিয়ে  যেন গন্ধাসুরকে  বধ  করছেন।  নিত্য  পূজা  ছাড়াও  বৈশাখ  মাসে  বুদ্ধ  পূর্ণিমার  দিন  গন্ধেশ্বরী  মাতার  বিশেষ  পূজা  অনুষ্ঠিত  হয়।  এ  দিন  গন্ধবণিক  সমাজের  সমস্ত  মানুষ  মন্দিরে  উপস্থিত  হন  মায়ের  কাছে  প্রার্থনা  ও  পূজা  দেওয়ার  জন্য।  তাঁরা  সারা  বছরের  নিজেদের  ব্যবসার  সমৃদ্ধি  কামনা  করে  মায়ের  আশীর্বাদ  প্রার্থনা  করেন।  এ  দিন  বিশেষ  পূজা  উপলক্ষ্যে  মায়ের  কাছে  খিচুড়ি  ভোগ  নিবেদন  করা  হয়।  পরে  মন্দিরে  উপস্থিত  ভক্তবৃন্দ  সেই  ভোগ  পেয়ে  থাকেন।

             মন্দির  চত্বরের  মধ্যে  আছে  একটি  ছাত্রাবাস।  এখানে  গ্রাম  থেকে  কলকাতায়  পড়তে  আসা  শিক্ষার্থীরা  স্বল্পমূল্যে  থাকতে  পারেন।  এখানে  উল্লেখ্য,  গন্ধবণিক  মহাসভা  নানা  জনহিতকর  কাজের  সঙ্গে  যুক্ত।    

             ১৩৪৩  বঙ্গাব্দের  ১৪ই  বৈশাখ  এই  মন্দিরের  ভিত্তি  প্রস্তর  স্থাপন  করেন  হরিশঙ্কর  পাল।  ১৩৪৬  বঙ্গাব্দের  ১৭ই  বৈশাখ,  সোমবার,  শুক্লা  ত্রয়োদশী  তিথিতে  মন্দিরে  বিগ্রহ  প্রতিষ্ঠিত  হয়।  প্রতিষ্ঠা  করেন  সেই  সময়ের  গন্ধবণিক  মহাসভার  সভাপতি  নৃত্যগোপাল  রুদ্র।  মন্দিরের  বাইরের  দেওয়ালে  দুটি  শ্বেতপাথরের  ফলক  আছে।

             সকাল  ৬ টা.  থেকে  ১১ টা  এবং  সন্ধ্যা  ৬ টা  থেকে  ৭ টা  পর্যন্ত  মন্দির  খোলা  থাকে

             কী  ভাবে  যাবেন ?

             কলকাতার  কলেজ  স্ট্রিট  মোড়  থেকে  বিধান  সরণি  ধরে  শ্যামবাজারের   দিকে  একটা  স্টপেজ  এগিয়ে  গেলে  পড়বে  ঠনঠনিয়া  সিদ্ধেশ্বরী  কালী  বাড়ি।  এই  মন্দিরের  দক্ষিণ  দিকের  রাস্তা  রাজেন্দ্র  দেব  লেন  ধরে  খানিকটা  এগিয়ে  কাউকে  জিজ্ঞাসা  করলেই  পেয়ে  যাবেন  মন্দির।   

গন্ধেশ্বরী মাতা -১

মন্দিরের ফটক

গন্ধেশ্বরী মাতা -২

গন্ধেশ্বরী মাতা -৩

মন্দিরের ভিত্তি প্রস্তরফলক

মন্দিরের বিগ্রহের প্রতিষ্ঠাফলক
 

            -------------------------------------------

            আমার  ইমেল :  shyamalfpb@gmail.com   প্রয়োজনে  যোগাযোগ  করতে  পারেন।

           --------------------------------------------          

                                                                           

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন