মঙ্গলবার, ২৫ অক্টোবর, ২০২২

Ekratna Gopinath temple, Radhakantapur, Daspur, Paschim Medinipur

 একরত্ন গোপীনাথ মন্দির, রাধাকান্তপুর, দাসপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর

                    শ্যামল কুমার ঘোষ

            পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার দাসপুর থানার অধীন একটি গ্রাম রাধাকান্তপুর। গ্রামে দাস পরিবারের প্রতিষ্ঠিত গোপীনাথ মন্দিরটি একটি উল্লেখযোগ্য পুরাকীর্তি। পাঁশকুড়া-ঘাটাল বাস রাস্তার একটি স্টপেজ টালিভাটা। সেখান থেকে পূর্ব দিকে হেঁটে মন্দিরে যাওয়া যায়।

            অল্প উঁচু ভিত্তিবেদির উপর স্থাপিত, দক্ষিণমুখী মন্দিরটি একরত্ন শৈলীর। আটকোনা রত্নটি ছাদের উত্তরদিকের দেওয়াল ঘেঁষে বসানো হয়েছে। গর্ভগৃহের সামনে ত্রিখিলান প্রবেশপথবিশিষ্ট অলিন্দ। গর্ভগৃহে প্রবেশের একটিই দরজা, সামনে। মন্দিরটির সামনের দেওয়ালে প্রচুর টেরাকোটা আছে। টেরাকোটার বিষয় : রামরাজা, কৃষ্ণের কালীয়দমন, কৃষ্ণ কর্তৃক গোপীদের বস্ত্রহরণ, শিবের বিবাহ, কৃষ্ণলীলা, চড়ক দৃশ্য, সিংহল যাত্রা কালে ধনপতি ও তার পুত্রের  কমলেকামিনীর পরিবর্ত হিসাবে গণেশজননীর দর্শনসিংহবাহিনী মূর্তি, রণতরী, যুদ্ধযাত্রার দৃশ্য ইত্যাদি। মন্দিরের পূর্ণস্তম্ভ দুটির ভিত্তিবেদি সংলগ্ন দুটি যুদ্ধযাত্রার প্যানেল আছে। অনেকে বলেন যে ডান দিকের প্যানেলটি শোভা সিংহের বর্ধমান আক্রমণের দৃশ্য।   

            মন্দিরের কার্নিশের কিছু নিচে পোড়ামাটির সুদীর্ঘ নয় সারি লিপি ১২৫১ সালে ( ইং ১৮৪৪ খ্রীষ্টাব্দে ) মন্দির সংস্কারকালীন। ঐ লিপি থেকে জানা যায় যে ১২৫১ বঙ্গাব্দে সংস্কারের প্রায় ২০০ বছর আগে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। দাস বংশের পূর্বপুরুষ জনানন্দ দাসের জ্যেষ্ঠ পুত্র শ্যাম দাস বর্ধমান থেকে গোপীনাথ বিগ্রহ আনিয়ে এই মন্দিরে স্থাপন করেছিলেন। সে সময় চেচুয়া বরদার প্রতাপশালী জমিদার 'সভা সিংহ' ( শোভা সিংহ ) এই শ্যাম দাসের প্রতি রুষ্ট হয়ে তাঁর মুণ্ডচ্ছেদ করেন।  শ্যাম দাসের কাটা মুণ্ড 'দুর্গা দুর্গা' উচ্চারণ করায় শোভা সিংহ বিস্মিত হন। এর অনেক বছর পরে যজ্ঞেশ্বর দাস, হীরু মিস্ত্রি নামে এক মিস্ত্রিকে দিয়ে ১২৫১ সালে মন্দিরটির সংস্কার করেন। গোপীনাথ মন্দিরের সামনে তিনি একটি পুকুর, পাকা ঘাট ও একটি শিব মন্দির স্থাপন করেন। ঘাটে 'জগ্গেস্বর দাস' নামটি উৎকীর্ণ আছে। সুদীর্ঘ লিপিটি পঞ্চানন রায় কাব্যতীর্থ ও প্রণব রায়ের লেখা 'ঘাটালের কথা' গ্রন্থে কবিতার আকারে মুদ্রিত আছে ( প্রাচীন বানান পরিবর্তন করা হয়েছে )। মুদ্রিত  কবিতাটি নিচে দেওয়া হল :

রাধাকান্তপুরে বাস          জনানন্দ দাস

              স্বর্গে বাস এই সে কারণে :

মহা মহা পুণ্যবলে         সপ্ত পুত্র ক্ষিতিতলে 

              জ্যেষ্ঠপুত্র শ্যামদাস নামে : 

যিনি দাতা পুন্যোদয়      প্রকাশিত মহাশয় 

              মধ্যম তৃতীয় সহোদরে : 

বর্দ্ধমানে পাঠাইয়া        গোপীনাথে আনাইয়া 

              স্থাপন করিল এই ঘরে : 

নবাব পৃথিবী পতি         তার ভয়ে ব্যস্ত অতি 

              সীমানা ঘেরিয়া খুলিলা গড় :

দামামা দরজা পরে        জয়চণ্ডীর কৃপাবরে 

              পুস্করিণী খুলিলা তারপর : 

সন্ধান পাইল যদি           সভাসিংহ নরপতি 

              এই হেতু কড়া না আইসে : 

কম্পবান ক্রোধভরে       আজ্ঞা দিল অনুচরে 

              হান শির পদাতিক রোষে : 

বিপক্ষ হইল কাল           কাল হইল পরকাল 

              কিছু না জানিল মহাশয় : 

তাহাতে ছেদিত মুণ্ড       দুর্গা দুর্গা ডাকে তুণ্ড 

              শুনি রাজা মানিল বিস্ময় : 

কবিতা করিতে তার        এইস্থানে আঁটা ভার 

              হইল দুই শতেক বৎসর : 

আপদ হইল ইথে            বৃক্ষ হইল মন্দিরেতে 

              সারাইতে সাধ্য নাহি কার :

নারান দাসের বংশে        মধ্যম বাড়ীর অংশে 

              যজ্ঞেশ্বর জন্মেছিল সার : 

সন ১২৫১ সালে             গোষ্ঠীর সহিত মিলে 

              নানা যুক্তি করে জনে জনে :

কেহ বলে নয়া কর          কেহ বলে একেই সার 

              যজ্ঞেশ্বরের কিছুই না লয় মনে : 

পিতৃকীর্ত্তি ডুবাইয়া          কেমনে করিব ইহা    

              সারাইব যা থাকে ভাগ্যেতে :

ভদ্রলোক ডাকাইয়া          হীরু মিস্ত্রী আনাইয়া 

              উদ্যোগ করিল সারাইতে :

সন ১২৫১ সালে               গোপীনাথের কৃপাবলে 

              মন্দির করিল মেরামতি : 

হিসাব করহ সবে              ইহাতে নিকাশ পাবে 

              কবিতা সমাপ্ত হইল ইতি :

            আগেই বলা হয়েছে যে মন্দিরটি ১২৫১ বঙ্গাব্দে সংস্কারের প্রায় ২০০ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয়। পরেও কয়েকবার সংস্কার করা হয়। ২০১৯ খ্রীষ্টাব্দে রাজ্য প্রত্নতত্ত্ব দপ্তর কর্তৃক মন্দিরটির আমূল সংস্কার করা হয়।                                 

গোপীনাথ মন্দির, রাধাকান্তপুর, দাসপুর 

মন্দিরের সামনের বিন্যাস 

মন্দিরের ত্রিখিলান বিন্যাস 

বাঁ দিকের খিলানের উপরের কাজ 

শ্রীকৃষ্ণ কর্তৃক গোপীদের বস্ত্রহরণ 

মাঝের দিকের খিলানের উপরের কাজ

কালীয় দমন 

পোড়ামাটির অলংকরণে চড়ক দৃশ্য  

ডান দিকের খিলানের উপরের কাজ

সিংহল যাত্রা কালে ধনপতি ও তার পুত্রের
 কমলেকামিনীর পরিবর্ত হিসাবে গণেশজননীর দর্শন
শিবের বিয়ে 

বাঁ দিকের পূর্ণ স্তম্ভের কাজ 

বাঁ দিকের অর্ধ স্তম্ভের কাজ

ডান দিকের অর্ধ স্তম্ভের কাজ

ডান দিকের পূর্ণ স্তম্ভের কাজ

প্রতিষ্ঠাফলক 

   
           কী ভাবে যাবেন ?

             হাওড়া থেকে মেদিনীপুর গামী ট্রেনে উঠে পাঁশকুড়া স্টেশনে নামুন। স্টেশনের কাছেই পাঁশকুড়া বাস স্ট্যান্ড। সেখান থেকে ঘাটাল গামী বাসে উঠে টালিভাটা স্টপেজে নামুন। সেখান থেকে পূর্ব দিকে হেঁটে মন্দিরে যাওয়া যায়। 

      সহায়ক গ্রন্থ :

                ১) পুরাকীর্তি সমীক্ষা - মেদিনীপুর :  তারাপদ সাঁতরা 

               ২) মেদিনীপুর জেলার প্রত্ন-সম্পদ : প্রণব রায় 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন