রাধা মদনমোহন মন্দির, গোকুল মিত্রের বাড়ি, রবীন্দ্র সরণি, বাগবাজার, কলকাতা
শ্যামল কুমার ঘোষ
কলকাতার বাগবাজার অঞ্চলের মদনমোহনতলায় ৫২০, রবীন্দ্র সরণিতে অবস্থিত রাধা মদনমোহন জিউ মন্দির। এই মদনমোহনের নামেই বাগবাজার / রবীন্দ্র সরণির একটি পাড়ার নাম হয়েছে মদনমোহনতলা। ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়।প্রতিষ্ঠা করেন গোকুল চন্দ্র মিত্র।
তাঁদের আদি নিবাস ছিল হাওড়ার বালিতে। বালি থেকে বর্গি হামলার ভয়ে তিনি পিতা সীতারাম মিত্রের সঙ্গে কলকাতায় পালিয়ে আসেন। নুনের ব্যবসা করে তিনি বিত্তবান হয়ে ওঠেন। লবণ ব্যবসার টাকা ও বিষ্ণুপুরের মদনমোহন বিগ্রহ তাঁকে দিয়ে ছিল প্রতিপত্তি ও সামাজিক মর্যাদা। লটারির টিকিট কেটে তিনি চাঁদনি চক পেয়েছিলেন। ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার রাস্তাঘাট, পুকুর খোঁড়া ইত্যাদি কাজের জন্য একটি লটারি কমিটি গঠিত হয়। লটারিতে যাঁরা জিততেন তাঁরা হীরাচুনির গয়না, অট্টালিকা, জমি ও সম্পত্তি পেতেন। গোকুল মিত্রের ভাগ্যে উঠেছিল চাঁদনি চক। বলা হয়, বিষ্ণুপুরের মদনমোহন বিগ্রহ তাঁর বাড়িতে আসার পর তিনি কলকাতার অন্যতম ধনী ব্যক্তি হয়ে ওঠেন।
মদনমোহন বিগ্রহের ইতিহাস :
দিল্লীর কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বীরভূমের বক্রেশ্বর ধাম দর্শন করে ইলামবাজারের কাছে বৃষভানুপুরে আসেন মহারাজ বীর হাম্মির। রাত্রি যাপনের জন্য তিনি জনৈক ধরণীধর মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে আশ্রয় নেন। সেখানে তিনি মুখোপাধ্যায় পরিবারের গৃহ দেবতা মদনমোহন জিউ'র অনিন্দ্যসুন্দর রূপ দর্শনে মুগ্ধ হন। নিজের পরিচয় দিয়ে তিনি যেকোনো মূল্যের বিনিময়ে বিগ্রহটিকে তাঁকে দিয়ে দেবার জন্য ব্রাহ্মণকে পীড়াপীড়ি করেন। ব্রাহ্মণ তাঁর এই প্রস্তাবে অরাজি হন। রাজা ভোর হওয়ার আগে বিগ্রহ নিয়ে চুপিচুপি বেরিয়ে পড়েন বিষ্ণুপুরের অভিমুখে। মদনমোহন বিগ্রহ রাজবাড়ির লক্ষ্মীগৃহে অধিষ্ঠিত হন। পরে, মল্লরাজ দুর্জন সিংহ ১৬৯৪ খ্রিস্টাব্দে বিষ্ণুপুরে মদনমোহন মন্দির তৈরি করে বিগ্রহটিকে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন। অন্য মতে, বীর হাম্বির শিকারে গিয়ে বীরভূমের এক গ্রামে জনৈক দরিদ্র ব্রাহ্মণের গৃহে এই মূর্তি দেখেন। তিনি প্রথমে অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে ব্রাহ্মণের কাছে মূর্তিটি চান। কিন্তু ব্রাহ্মণ তাতে রাজি না হওয়ায় বলপূর্বক তিনি মূর্তিটি বিষ্ণুপুরে নিয়ে আসেন।
বিষ্ণুপুরের রাজসিংহাসনে তখন মহারাজ গোপাল সিংহদেব। তিনি ছিলেন মদনমোহনের একনিষ্ঠ ভক্ত। তিনি মদনমোহনদেবের উপর তাঁর রাজ্যের সব শুভাশুভের ভার অর্পণ করে, 'কর্তা তিনি, নিজে সামান্য কর্মী মাত্র' এই মনোবৃত্তি নিয়ে জীবনের সবকিছু কাজ সম্পন্ন করতেন। তিনি শুধু নিজেই হরিনাম নিয়ে মত্ত থাকতেন না, প্রজাদেরও কৃষ্ণ প্রেমে উদ্বুদ্ধ করার জন্য তাদের প্রতিদিন হরিনাম করার আদেশ দিয়েছিলেন। লোকে এই আদেশকে 'গোপালের বেগার খাটা' আখ্যা দিয়েছিল। এসময় মারাঠা দস্যু-সর্দার ভাস্কর পণ্ডিতের নেতৃত্বে বিপুল বর্গি সেনা বিষ্ণুপুরের প্রায় ৩২ মাইল পূর্বে অবস্থিত গড়মান্দারণ লুট করে বর্তমান হাওড়া রোড ধরে কোতলপুর, কুম্ভস্থল, জয়পুর লুট করতে করতে তারা বিষ্ণুপুরের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। রাজদরবারে সেই খবর পৌঁছালেও মদনমোহনদেবের কাছে আত্মনিবেদিত রাজা তার প্রতিকারের কোনো উপায়ই করলেন না। তিনি তাঁর রাজ্যের সমস্ত প্রজাদের আদেশ দিলেন মদনমোহনের নাম-গান করতে। মহারানি ছিলেন বীরাঙ্গনা। ভগবানের উপর ভক্তি-বিশ্বাস থাকলেও নিচেষ্ট হয়ে বসে থাকার তিনি পক্ষপাতী ছিলেন না। যুবরাজ কৃষ্ণ সিংহ তখন অসুস্থ। তাই কনিষ্ঠ পুত্র গোবিন্দ সিংহকে সেনাবাহিনী সমেত পাঠিয়ে দিলেন ধানগড়ার দক্ষিণে অবস্থিত যুঝঘাটির যুদ্ধঘাটিতে। গুপ্তচর মারফত যুঝঘাটির সৈন্য সমাবেশের খবর জানতে পারেন ভাস্কর পণ্ডিত। তিনি আরও জানতে পারেন যে যুঝঘাটির নিকটবর্তী মুণ্ডমালা ঘাটের পরিখা পাহাড়ের উপর অসংখ্য কামান সাজানো আছে, কিন্তু কোনো গোলন্দাজ বাহিনী নেই। রাত্রি-নিশিতে দ্বারকেশ্বর নদী পার হয়ে কামানগুলি দখল নেওয়ার পরিকল্পনা করেন তিনি। আর বিষ্ণুপুরে মহারাজের আদেশে দিন-রাত চলতে থাকে হরিনাম সংকীর্তন। এই অবস্থায় একদিন শেষ রাতে বিষ্ণুপুরের আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে গর্জে উঠল দলমর্দন বা দলমাদল কামান। দলমাদলের গোলার আঘাতে মারা পড়ল প্রচুর বর্গী সৈন্য। বাকি সৈন্য নিয়ে পলায়ন করলেন ভাস্কর পণ্ডিত। রাজা ক্ষিপ্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, আমার আদেশ অমান্য করে কে দলমাদল কামানে অগ্নিসংযোগ করল? সবাই বলল, তারা কেউই তা করেনি। রাজা সব শুনে বুঝলেন, এ তাঁর প্রাণের দেবতা মদনমোহনের কাজ। ভক্তের আহ্বানে দেবতা সাড়া দিয়েছেন। তখন মদনমোহন বিগ্রহের মাহাত্ম দিকেদিকে ছড়িয়ে পড়ল।
বিষ্ণুপুর রাজসিংহাসনে তখন মল্লরাজ চৈতন্য সিংহ। ১৭৬৯/৭০ খ্রিষ্টাব্দ। ১১৭৬ বঙ্গাব্দ। একদিকে দুর্ভিক্ষ, ছিয়াত্তরের মন্বন্তর! তার উপর গৃহবিবাদ। দামোদর সিংহের সঙ্গে সম্পত্তি নিয়ে মামলা। দীর্ঘস্থায়ী সেই মামলা চালানোর খরচের জন্য দেওয়ান গঙ্গাগোবিন্দ সিংহের পরামর্শে মদনমোহন বিগ্রহসহ চৈতন্য সিংহ সালিকা অঞ্চলে ভাড়া বাড়িতে অবস্থান করেন দীর্ঘদিন। বঙ্গের বিখ্যাত দেবতা মদনমোহন কলকাতায়, এই খবরে ভক্ত সমাবেশ হয় মদনমোহনকে দেখতে। এদের মধ্যে ছিলেন নুন ব্যবসায়ী গোকুল মিত্র। চৈতন্য সিংহের প্র্রতি তিনি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। মামলায় জয় হয় রাজার। কিন্তু দীর্ঘদিন মামলা চালাতে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। দুর্ভিক্ষ পীড়িত প্রজাদের ওপর করারোপ করে ঋণ পরিশোধ করার মানসিকতা ছিল না রাজার। উপরন্তু নিরন্ন ও উপবাসী প্রজাদের জন্য অন্নসত্র খুলে নিঃস্ব হয়ে পড়লেন। তার উপর রাজস্ব বাকি। এক লক্ষ বিশ হাজার টাকা ঋণের দায়ে মদনমোহন বিগ্রহ বাঁধা পড়ল গোকুল মিত্রের ঘরে। কিন্তু প্রাণের ঠাকুর মদনমোহনের বিরহে তার প্রাণ কাঁদতে থাকে। ঋণ পরিশোধ করে মদনমোহনকে ফিরিয়ে আনার জন্য মহারানির গজমতি হার বিক্রি করে সুদ-আসল মিলে তিন লক্ষ টাকা নিয়ে হাজির হন গোকুল মিত্রের বাড়িতে।
' শুন শুন গোকুল মিত্র আমার বচন।।
কোথায় রেখেছ বাঁকা মদনমোহন।
তিন লক্ষ টাকা নিয়ে দাও সে ধন।।'
( নিবারণ দে প্রণীত 'মদনমোহনের আদি মাহাত্ম্য' থেকে )
এদিকে গোকুল মিত্রের ঘরে মদনমোহন আসার পর থেকেই তাঁর শ্রীবৃদ্ধি ঘটতে থাকে। তাছাড়া গোকুল মিত্রের মেয়ে বিষ্ণুপ্রিয়া মদনমোহনের প্রতি এতই অনুরক্ত হয়ে পরে যে মদনমোহন বিরহে তার প্রাণ যায় অবস্থা। নিজের শ্রীবৃদ্ধির কথা চিন্তা করে ও মেয়ের কথা ভেবে গোকুল মিত্র মদনমোহন বিগ্রহ ফেরত দিতে অস্বীকৃত হন। বলেন, 'রাজা মদনমোহনকে বন্দক নয়, বিক্রি করে গেছেন।'
'গোকুল মিত্র ফেরেরবাজ ফেরেবি করিল।
বন্দক কোবালা রেখে বিক্রি কোবালা কৈল।।'
( নিবারণ দে প্রণীত 'মদনমোহনের আদি মাহাত্ম্য' থেকে )
রাজাকে তখন বিফল মনোরথ হয়ে বিষ্ণুপুরে ফিরে যেতে হল। অন্য মতে, গোকুল মিত্র চৈতন্য সিংহকে মূর্তি ফেরত দিতে রাজি হন। তবে চতুর গোকুল মিত্র হুবহু একই রকম আর একটি বিগ্রহ তৈরি করেন এবং চৈতন্য সিংহকে তাঁদের বিগ্রহ বেছে নিতে বলেন। বিগ্রহ নিয়ে চৈতন্য সিংহ বিষ্ণুপুরে ফিরে যান। দুপক্ষই দাবি করতে থাকেন তাঁদের কাছেই আসল বিগ্রহ থাকল। চৈতন্ সিংহ যে বিগ্রহটি নিয়ে বিষ্ণুপুরে ফিরে যান সেই মদনমোহন বিগ্রহটি ১৩৬৯ বঙ্গাব্দের ২৯ শে অগ্রহায়ণ অপহৃত হয়। পরে আর একটি বিগ্রহ মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত হয়। গোকুল মিত্রের কাছে থাকা বিগ্রহটি ঠাকুরবাড়িতে পূজিত হতে থাকে।
গোকুল মিত্রের বাড়িটি এক বিঘা কয়েক কাঠা জমির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। সুবিশাল ঠাকুরবাড়ির প্রধান প্রবেশদ্বার দিয়ে ঢুকলে বাঁদিকে পড়বে দোতালায় যাওয়ার সিঁড়ি। আরও একটু এগুলে সামনে পড়বে বড়ো বড়ো থামওয়ালা চাঁদনি আকৃতির নাটমন্দির। এত উঁচু ও বড়ো নাটমন্দির কলকাতায় বিরল। নাটমন্দিরের সামনে উঁচু ভিত্তিবেদির উপর স্থাপিত ঠাকুরদালান। ঠাকুরদালান ও নাটমন্দির ঘিরে চারিদিকে আছে চকমিলানো সব ঘর। পূর্বোক্ত সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠলে ডান দিকে পড়বে বিরাট হলঘর। তার সামনে সুদৃশ্য সিংহাসনে অধিষ্ঠিত থাকেন মদনমোহন, রাধিকা ও তাঁর দুই সখি। তবে আমি যে দিন গিয়েছিলাম সেদিন শীতের সকালে মদনমোহন বারান্দায় রোদ পোহাচ্ছিলেন। বিগ্রহ দোতালায় থাকলেও এখন বিভিন্ন উৎসব হয় এই ঠাকুরদালান ও নাটমন্দিরে। ঠাকুরবাড়ির একটু দূরে রাসমঞ্চ। তবে এখন তার চার দিক দখল হয়ে গেছে।
সারা বছর নানা বৈষ্ণব অনুষ্ঠা হয় এই ঠাকুরবাড়িতে। যেমন -- দোল, রাসযাত্রা, রাধাষ্টমী, ঝুলন, অন্নকূট উৎসব ইত্যাদি। উৎসবে প্রচুর মানুষের সমাগম হয়। অন্নকূট উৎসবের দিন প্রচুর পুণ্যার্তি ঠাকুরবাড়িতে উপস্থিত হন। তাঁরা ভিড় করেন নাটমন্দিরের সামনের চত্বরে। পেতে ধরেন গামছা, চাদর, এমন কি উল্টো করে রাখা ছাতা। উপর থেকে মদনমোহন-রাধিকার অন্ন-ভোগ তাঁদের দিকে ছুড়ে দেওয়া হয়। সেই প্রসাদ পাওয়ার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে যায়।
সকাল ৭ টা থেকে ১২ টা এবং বিকাল ৫ টা থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত বিগ্রহ দর্শন করা যায়।
ঠাকুরবাড়িটি পরিদর্শনের তারিখ : ১৭.১২.২০২১
 |
প্রতিষ্ঠাফলক |
 |
বড় রাস্তার দিকে ঠাকুরবাড়ির ফলক |
 |
উপরে যাওয়ার সিঁড়ি |
 |
হলঘর - ১ |
 |
হলঘর - ২ |
 |
সিঁড়িতে ওঠার আগে |
 |
গলি পথে |
 |
নাটমন্দির, সামনে ঠাকুরদালান |
 |
ঠাকুরদালানের খিলানের উপরে পঙ্খের কাজ |
 |
ঠাকুরবাড়ির একাংশ |
 |
মদনমোহন, রাধিকা ও তাঁর দুই সখি -১
|
 |
মদনমোহন, রাধিকা ও তাঁর দুই সখি -২
|
 |
মদনমোহ ও রাধিকা |
 |
রাসমঞ্চ |
সহায়ক গ্রন্থ : ১) বনেদি কলকাতার ঘরবাড়ি : দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়
২) মল্লভূম বিষ্ণুপুর : মনোরঞ্জন চন্দ্র
৩) বিষ্ণুপুরের অমর কাহিনী : ফকিরনারায়ণ কর্মকার
কলকাতার অন্যান্য মন্দির সম্বন্ধে জানতে নিচের লিংকে ক্লিক করুন / লিংকের উপর আঙুল দিয়ে টোকা দিন :
কলকাতার মন্দির
-------------------------------------------
আমার ইমেল : shyamalfpb@gmail.com প্রয়োজনে যোগাযোগ করতে পারেন।
--------------------------------------------