সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির, রবীন্দ্র সরণি ও মদনমোহনতলার সংযোগ স্থল, বাগবাজার / কুমোরটুলি, কলকাতা
শ্যামল কুমার ঘোষ
সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির কলকাতার বাগবাজার / কুমোরটুলি অঞ্চলে অবস্থিত একটি প্রাচীন কালী মন্দির। অতীতে এই অঞ্চল ছিল বন-জঙ্গলে ঢাকা। এখন যেখানে মন্দির তার সামনে দিয়ে বয়ে যেত হুগলি নদী। নদী এখন অনেকটা পশ্চিমে সরে গেছে। এক সময় হিমালয়ে তপস্যারত কালীবর নামে এক সন্ন্যাসী স্বপ্নাদেশ পান যে দক্ষিণে সতীর অঙ্গ পড়েছে। সেই অঙ্গ খুঁজে বের করে মায়ের প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কালীবর নদীর পার বরাবর হাঁটতে হাঁটতে এখানে এসে একটি বেদি, কিছু ফুল ও হাড়গোড় পড়ে আছে দেখতে পান। কালীবর ভাবেন এই সেই স্থান। আসলে সেটি ছিল ডাকাতদের আস্তানা। ডাকাতি করার আগে ডাকাতরা মায়ের উদ্দেশ্যে বলি দিত। তিনি হোগলা পাতার একটি কুটির তৈরি করে তপস্যা শুরু করেন এবং সিদ্ধি লাভ করেন। মা তাঁকে মন্দিরের এই মূর্তিতে দেখা দেন। কালীবর সিদ্ধি লাভ করেন। তাই মায়ের নাম হয় 'সিদ্ধেশ্বরী'। মা তাকে বলেন সতীর অঙ্গ পেতে তাকে আরও দক্ষিণে যেতে হবে। মা তাঁকে যে মূর্তিতে দেখা দিয়েছিলেন তিনি সেই মূর্তি প্রতিষ্ঠা করলেন। তারপর দেবী মূর্তির ভার দুই কাপালিকের হাতে সমর্পণ করে মায়ের আদেশে আরও দক্ষিণে রহনা দিলেন। তারপর অনেক বছর কেটে গেছে। কালক্রমে কাপালিক ও ডাকাতদের থেকে হাতবদল হয়ে মায়ের পূজার ভার এল গৃহীর হাতে। প্রথমে মন্দিরটি ছিল হোগলা পাতার। অনেক পরে কুমোরটুলির গোবিন্দ মিত্রের পরিবার মন্দিরটি তৈরি করে দেন। বর্তমান মন্দিরটি কয়েকটি ঘর সহ একটি 'দালান'। গর্ভগৃহের সামনে অলিন্দ। তার সামনে গাড়ি বারান্দা। মন্দিরটির শেষ সংস্কার হয়েছে ইং ২০১৯ সালে।
মন্দিরে স্থাপিত দেবী মূর্তিটি মৃন্ময়ী। বছরে একবার মায়ের অঙ্গরাগ হয়। দেবীর বাম চরণের দিকে সম্পূর্ণ দিগম্বর শ্বেত মহাদেবের মস্তক। বসনে দেবী নয়নাভিরাম। মায়ের হাতের খাঁড়া ছাড়াও মন্দিরে আরও দুটি খাঁড়া আছে। একটি খাঁড়া খুবই ভারি। আগে এই খাঁড়া দিয়ে মোষ বলিও হয়েছে। সেটি এখন তাকে তোলা আছে। আর একটি খাঁড়া আছে খুবই প্রাচীন। এই খাঁড়া ধোয়া জল ভক্তকে দেওয়া হয়। এখানে উল্লেখ্য, অনেক মানুষের বিশ্বাস এই খাঁড়া ধোয়া জল বাড়িতে রাখলে কোন অশুভ শক্তি পরিবার কে স্পর্শ করতে পারে না। খাঁড়া ধোয়া জল দিতে দিতে খাঁড়াটি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে খুবই ছোট হয়ে গেছে। জনশ্রুতি, এক সময় দেবীর সামনে নরবলি দেওয়া হত।
ঠাকুর রামকৃষ্ণ এই মন্দিরে আসতেন। একবার কেশবচন্দ্র সেন গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে ঠাকুর সিদ্ধেশ্বরী মায়ের কাছে ডাব-চিনি মানত করেছিলেন। উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ছিলেন বসুমতী সাহিত্য মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ছিলেন ঠাকুর রামকৃষ্ণের কৃপাধন্য। ঠাকুর তাঁকে বলেছিলেন, যা উপেন মা সিদ্ধেশ্বরীর কাছে মানত কর। তোর এক দরজা শত দরজা হবে। তাইই হয়েছিল। নট ও নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ এই মন্দিরে আসতেন। তিনি নাটক রচনা করে খসড়াটি প্রথমে মায়ের পায়ে ছুঁইয়ে তারপর নাটকের মহড়া শুরু করতেন। তিনি আদর করে এই মাকে 'উত্তর কলকাতার গিন্নি' বলে ডাকতেন ।
নিত্য পূজা ছাড়াও প্রতি অমাবস্যায় রাত্রে মন্দিরে বিশেষ পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এ ছাড়া কালী পূজা, রটন্তি কালী পূজা ও ফলহারিণী কালী পূজাতে মহা সমারোহে মায়ের পূজা হয়। আর মায়ের বিশেষ উৎসবের দিন বৈশাখ মাসে বুদ্ধ পূর্ণিমায় মায়ের ফুলদোল হয়। মাকে ফুল দিয়ে সাজানো হয়। ফুলের গহনা পড়ানো হয়। সেদিন ফুলের সাজে মায়ের জগৎজননী রূপ ফুটে ওঠে।
সিদ্ধেশ্বরী মন্দির, বাগবাজার / কুমোরটুলি |
গর্ভগৃহের সামনের অলিন্দ - ১ |
গর্ভগৃহের সামনের অলিন্দ - ২ |
মা সিদ্ধেশ্বরী - ১ |
মা সিদ্ধেশ্বরী - ২ |
মা সিদ্ধেশ্বরী - ৩ |
মা সিদ্ধেশ্বরী - ৪ |
কলকাতার অন্যান্য মন্দির সম্বন্ধে জানতে নিচের লিংকে ক্লিক করুন / লিংকের উপর আঙুল দিয়ে টোকা দিন :
-------------------------------------------
--------------------------------------------