যুগল কিশোর মন্দির, আড়ংঘাটা, নদিয়া
শ্যামল কুমার ঘোষ
রানাঘাট-গেদে রেল-পথের একটি স্টেশন আড়ংঘাটা। কলকাতা থেকে রেলপথে আড়ংঘাটার দূরত্ব ৮২ কিমি। স্টেশন থেকে পশ্চিম দিকে মিনিট পাঁচেক হাঁটলে চুর্নি নদীর তীরে অবস্থিত যুগল কিশোরের মন্দিরে পৌঁছানো যায়। মন্দিরটি পূর্বমুখী পাঁচ খিলান বিশিষ্ট একটি দালান। এর সামনে চণ্ডীমণ্ডপ আকারের থামযুক্ত প্রশস্ত বারান্দা। বারান্দাটিও পাঁচ খিলান বিশিষ্ট। মন্দিরটির দেওয়াল অপরূপ পঙ্খ অলংকারে অলংকৃত। যদিও তা কালের আবর্তনে অনেকটাই বিবর্ণ। গর্ভগৃহে পাঁচটি প্রকোষ্ঠের মধ্যমটিতে চার তাকওয়ালা কাঠের তৈরী আসনের উপর তাকে রাধিকাসহ যুগলকিশোরের মূর্তি প্রতিষ্ঠিত এবং নিত্য পূজিত। রাধিকা ধাতুময়ী, শ্রীকৃষ্ণ বিগ্রহটি কষ্টিপাথরের তৈরী । একই ঘরের পাশের একটি কাঠের তৈরী তাকওয়ালা আসনে কালাচাঁদ, গোপীনাথ, শ্যামচাঁদ বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত। এ ছাড়া রাধাবল্লভ, গোপীবল্লভ, শালগ্রাম শিলা, বালগোপাল, সাক্ষীগোপাল, বলরাম ও রেবতীর মূর্তিও আছে। আগে পাঁচটি ঘরে আলাদা আলাদা বিগ্রহ থাকত এবং তাঁদের জন্য ঘরও নিদিষ্ট আছে। মন্দিরের দক্ষিণ দিক থেকে প্রথম ঘর গোপিনাথ, দ্বিতীয় ঘর রাধাবল্লভ, তৃতীয় ঘর যুগলকিশোর, চতুর্থ ঘর কালাচাঁদ ও পঞ্চম ঘর শ্যামচাঁদের জন্য নিদিষ্ট। কিন্তু বর্তমানে লোকাভাবে কাজের সুবিধার্তে বিগ্রহগুলি একই ঘরে রাখা আছে। মন্দিরের একটি ঘরে ( চরণপাদুকাগৃহ ) এই মন্দিরের পূর্ববর্তী মহান্তদের খড়ম রাখা আছে। মন্দিরের পিছনে, চুর্নি নদীর বাঁধানো ঘাটের পাশের একটি ছোট মন্দিরে যুগলেশ্বর শিবও নিত্য পূজিত।
যুগল কিশোরের এই মন্দিরটি ইং ১৭২৮ খ্রীষ্টাব্দে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র নির্মাণ করে দেন। যদিও পরে তা কয়েকবার সংস্কার করা হয়েছে। শোনা যায় যে গঙ্গারাম দাস নামে জনৈক নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের হিন্দুস্থানী মহান্ত বৃন্দাবন থেকে শ্রীকৃষ্ণের একটি কিশোর মূর্তি এনে নবদ্বীপের কাছে সমুদ্রগড়ে স্থাপন করে যথারীতি পূজার্চনা করতে থাকেন। ওই সময় নদিয়া জেলায় বর্গীর উপদ্রব আরম্ভ হলে গঙ্গারাম আত্মরক্ষার জন্য কিশোর মূর্তিটি নিয়ে গঙ্গা পেড়িয়ে আড়ংঘাটায় চলে আসেন এবং তাঁর স্বদেশবাসী রামপ্রসাদ পাড়ে নামক জনৈক ব্যবসায়ীর ( অন্য মতে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সিপাই ) কাছে আশ্রয় নেন। রামপ্রসাদের গোপীনাথ নামে একটি কৃষ্ণ বিগ্রহ ছিল। গোপীনাথ জিউর মন্দিরের পাশে আর একটি চালা-মন্দির নির্মাণ করে গঙ্গারাম কিশোর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা ও নিত্য সেবার ব্যবস্থা করেন। প্রথমে কেবল মাত্র কিশোর বিগ্রহেরই পূজা করা হত। পরে কৃষ্ণনগরের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রাজবাড়ির ভূগর্ভ থেকে একটি রাধিকা মূর্তি পেয়ে আড়ংঘাটার উক্ত বিগ্রহের বাঁদিকে স্থাপন করার জন্য গঙ্গারামকে সমর্পণ করেন এবং উভয় বিগ্রহের 'যুগলকিশোর' নামকরণ করেন। সেই থেকে এই বিগ্রহদ্বয় 'যুগলকিশোর' নামে খ্যাত হয়। মন্দিরের পিছনের চুর্নি নদীর ঘাটে কৃষ্ণচন্দ্র স্বয়ং কিশোরী রাধিকাকে নিয়ে বজরা থেকে নামেন। মহা সমারোহে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের দিয়ে অভিষেক করিয়ে শ্রী রাধিকা মূর্তি গঙ্গারামকে সমর্পণ করেন। বর্তমান মন্দিরের সামনের বকুলতলায় মহা আড়ম্বরের সঙ্গে কিশোর-কিশোরীর মিলন উৎসব করা হয়। এই যুগল মিলনের আনন্দ উৎসব পালনের জন্য মহারাজ জ্যৈষ্ঠমাস ব্যাপী মেলার ব্যবস্থা করেন এবং যুগলকিশোরের মিলনের যৌতুক স্বরূপ একশত পঁচিশ বিঘা নিস্কর জমি সেবায়তকে দান করেন।
প্রতি বছর জ্যৈষ্ঠ মাসে এক মাস ব্যাপী যুগল কিশোর দেবের ব্যৎসরিক পূজা উৎসব অনুষ্ঠিত হয় এবং এই উপলক্ষ্যে মন্দির প্রাঙ্গনে এক মাস ব্যাপী মেলা বসে। ( বর্তমানে মেলা শুরু হতে জ্যৈষ্ঠমাসের দশ বার তারিখ হয়ে যায়। ) মেলায় পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থান থেকে বহু নরনারীর সমাগম হয়। এ অঞ্চলের মহিলাদের মধ্যে একটি বিশ্বাস প্রচলিত আছে যে জ্যৈষ্ঠ মাসে যুগলকিশোর দর্শন করে পুজো দিলে এ জন্মে, এমন কি পরজন্মেও বৈধব্যদশা ভোগ করতে হয় না। বিধবাদের পরজন্মে বৈধব্যদশা ভোগ করতে হবে না। তাই মেলায় মহিলাদের আগমনই বেশি হয়।
মন্দিরের সামনে যে প্রাচীন বকুল গাছ আছে তাকে সিদ্ধ বকুল বলা হয়। এই বকুল গাছের তলায় মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের উপস্থিতিতে কিশোর-কিশোরী বিগ্রহদ্বয়ের মিলন হয়েছিল। বকুল গাছের ডালে সুতোয় ঢেলা বেঁধে ভক্তরা যুগলকিশোরের কাছে মানত করেন। মনস্কামনা পূর্ণ হলে আবার তারা এসে পুজো দিয়ে ঢেলা খুলে দিয়ে যান। এই গাছের মূলে বাঁধান বেদির উপর ষষ্ঠীস্বরূপ কয়েকটি পাথরখণ্ড আছে। ষষ্ঠীপুজোর দিন মহিলারা এখানে ষষ্ঠীর পুজো দেন।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে মন্দিরের পাশ দিয়ে চুর্নি নদী বয়ে গেছে। বছরের বিভিন্ন ঋতুতে চুর্নির বিভিন্ন রূপ দেখতে পাওয়া যায়। দর্শনার্থীরা উপরি পাওনা হিসাবে প্রকৃতির এই রূপের আস্বাদও নিতে পারেন। নৌকা করে চুর্নির অপর পারের গ্রামও ঘুরে দেখে আসতে পারেন।
যুগলকিশোর মন্দির ( বাঁ দিক থেকে তোলা ) |
যুগলকিশোর মন্দির ( সামনে থেকে তোলা ) |
মন্দিরের শিখর |
মন্দিরের ঢাকা-অলিন্দ |
মন্দিরের পঙ্খের কাজ - ১ |
মন্দিরের পঙ্খের কাজ - ২ |
মন্দিরের পঙ্খের কাজ - ৩ |
অন্যান্য বিগ্রহ |
মন্দিরের একটি ঘরের দারুমূর্তি |
যুগলকিশোর বিগ্রহ |
যুগলকিশোর বিগ্রহ ( অন্য সাজে ) |
যুগলেশ্বর শিব |
মন্দিরের সামনের সিদ্ধ বকুল |
ষষ্ঠী পুজো |
চুর্নি নদী |
আড়ংঘাটার যুগলকিশোর মন্দিরে যেতে হলে শিয়ালদহ থেকে সকাল ৭ টা ৪০ মিনিটের গেদে লোকাল ধরুন। ট্রেনে সময় লাগে ঘন্টা দুই। ট্রেন থেকে নেমে পশ্চিম দিকে ৫ মিনিট হাঁটলে পৌঁছে যাবেন মন্দিরে।
মন্দিরটি পরিদর্শনের তারিখ : ২৮.১০.২০১৫
সহায়ক গ্রন্থাবলি :
১. নদিয়া জেলার পুরাকীর্তি : মোহিত রায় ( তথ্যসংকলন ও গ্রন্থনা )
২. পশ্চিমবঙ্গ ভ্রমণ ও দর্শন : ভূপতিরঞ্জন দাস
-------------------------------------------
আমার ইমেল : shyamalfpb@gmail.com প্রয়োজনে যোগাযোগ করতে পারেন।
--------------------------------------------
Jai Jugol kishore
উত্তরমুছুনRadha binodh sabay ke valo koro
khub sundor.
উত্তরমুছুনধন্যবাদ।
মুছুনKhub e sundor jaiga
উত্তরমুছুনধন্যবাদ।
মুছুন