রবিবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

Nandadulal Jiu Temple, Saibona, North 24 Parganas

  

নন্দদুলাল  জিউ  মন্দির, সাইবনা, উত্তর  ২৪  পরগনা

               শ্যামল  কুমার  ঘোষ 

            সাইবনা  বা  সাঁইবনা  উত্তর  ২৪  পরগনার  একটি  গ্রাম।  এখানে নন্দদুলাল  জিউ'র  একটি  মন্দির  আছে।  এটি  সমতল  ছাদ  বিশিষ্ট,  পূর্বমুখী  একটি  দালান  মন্দির।  মন্দিরের  গর্ভগৃহের  উপর  একটি  উচ্চ  শিখর  স্থাপিত।  মন্দিরের  সামনে  নাটমন্দিরটি  গর্ভগৃহ  সংলগ্ন।  গর্ভগৃহে  একটি  কাঠের  মঞ্চে  'নন্দদুলাল  জিউ'  নামে  খ্যাত  কৃষ্ণ  ও  রাধার  যুগল  মূর্তি  প্রতিষ্ঠিত  আছে।  সম্ভবত  ষোল  শতকের  প্রথমে  এই  মূর্তি  প্রতিষ্ঠিত  হয়েছিল।  রাধিকা  মূর্তিটি  ধাতুময়ী  এবং  কৃষ্ণ  মূর্তিটি  কষ্টিপাথরের  তৈরী।  ঘরে  অপর  একটি  পৃথক  আসনে  জগন্নাথ, সুভদ্রা  ও  বলরামের  দারুময়  মূর্তি আছে। 

            প্রবাদ,  হুগলি  জেলার  শ্রীরামপুরের  পার্শ্ববর্তী  চাতরা  নিবাসী,  বৈষ্ণবচূড়ামণী,  শ্রীচৈতন্য  পরিকর,  পণ্ডিত  কাশীশ্বর  অত্যন্ত  গোঁড়া  বৈষ্ণব  ছিলেন।  তিনি  প্রতিদিন  নিজের  হাতে  তাঁদের  কুলদেবতা  শ্রীকৃষ্ণের  পূজা  করতেন।  তিনি  কোন  অবৈষ্ণব  কে  এই  বিগ্রহ  ছুঁতে  দিতেন  না।  একদিন  তিনি  কোন  কারণে  বাড়ির  বাইরে  গিয়েছিলেন।  তাঁর  ফিরতে  দেরি  দেখে  তাঁর  ভাগনে  ( অন্য  মতে,  দৌহিত্র )  শাক্তধর্মাবলম্বী  রুদ্ররাম  শ্রীকৃষ্ণের  পূজা  সম্পন্ন  করেন।  বাড়ি  ফিরে  এসে  কাশীশ্বর  এই  দেখে  খুবই  রাগ  করেন  এবং  রুদ্ররামকে  কটুকথা  বলেন।  মনের  দুঃখে  রুদ্ররাম  গৃহত্যাগ  করে  বর্তমান  বল্লভপুরের  যে  জায়গায়  হেনরী  মার্টিন  প্যাগোডা  অবস্থিত  সেখানে  আশ্রয়  নেন  এবং  শ্রীকৃষ্ণের  আরাধনায়  ব্রতী  হন।  তাঁর  ভক্তিতে  সন্তুষ্ট  হয়ে  তাঁর  আরাধ্য  দেবতা  স্বপ্নাদেশ  দেন,  গৌড়ের  রাজপ্রাসাদ  থেকে  শিলা  সংগ্রহ  করে   ওই  স্থানে  শ্রীকৃষ্ণ  বিগ্রহ  প্রতিষ্ঠা  করতে।  রুদ্ররাম  গৌড়ে  উপস্থিত  হয়ে  বাদশাহের  হিন্দু  প্রধানমন্ত্রীর  সাহায্যে  একটি  বড়  শিলাখণ্ড  সংগ্রহ  করে  বল্লভপুরে  নিয়ে  এলেন  এবং  ওই  শিলাখণ্ডটি  পূজার্চনা  করতে  লাগলেন।  পরে  বৃন্দাবনের  এক  শিল্পী  ওই  শিলাখণ্ড  থেকে  তিনটি  শ্রীকৃষ্ণ  বিগ্রহ  তৈরী  করে  দেন।  কাশীশ্বরের  তিন  ভাগনে  ( অন্য  মতে, দৌহিত্র )  এই  তিনটে  শ্রীকৃষ্ণ  বিগ্রহের  সেবার  ভার  নেন।  বড়  রুদ্ররাম  বল্লভপুরের  রাধাবল্লভজিউর,  মেজ  রামরাম  খড়দহের  শ্যামসুন্দরজিউর  এবং  ছোট  লক্ষ্মণ  সাইবনার  নন্দদুলালজিউর  পূজার  ভার  গ্রহণ  করেন।  অন্য  মত  হল, নিত্যানন্দ  প্রভুর  পুত্র  বীরভদ্র  গোস্বামী  গৌড়ের  রাজপ্রাসাদ  থেকে  উক্ত  পাথর  সংগ্রহ  করেছিলেন  এবং  বৃন্দাবনের  এক  বিখ্যাত  শিল্পীকে  দিয়ে  তিনটি  সুন্দর  কৃষ্ণমূর্তি  তৈরী  করান।  বীরভদ্র  গোস্বামীর  ইচ্ছায়  এই  তিন  বিগ্রহ পূর্বোক্ত  তিন  জায়গায়  প্রতিষ্ঠিত  হয়।  ভক্তদের  বিশ্বাস, একই  দিনে  এই  তিনটি  বিগ্রহ  দর্শন  করলে  আর  পুনর্জন্ম  হয়  না।  আবার  অনেকের  ধারণা, একই  দিনে  ( সূর্যোদয়  থেকে  সূর্যাস্তের  মধ্যে )  উপবাসি  থেকে  এই  তিন  বিগ্রহ  দর্শন  করলে  কলির  তিন  প্রভু  গৌরাঙ্গ, নিত্যানন্দ  ও  অদ্বৈত  দর্শণের  পুন্যলাভ  হয়।

            মন্দির  সম্মুখস্থ  নাটমন্দিরটি  শ্রীমতী  ভবতারিনী  দেবী  কর্তৃক  ৭ ই  শ্রাবণ  ১৩২৫  সনে  এবং  বাংলা  ১৩৬২  কলকাতার  এন্টনি  বাগানের  অক্ষয়  কুমার  নন্দী  কর্তৃক  সংস্কার  করা  হয়েছে।  নাটমন্দির  সহ  মূল  মন্দিরটি  পাঁচিল  দিয়ে  ঘেরা।  পাঁচিলের  ভিতরে   প্রবেশদ্বারের  ডান  দিকে  পাশাপাশি  দুটি  ইঁটের  তৈরী  আটচালা  মন্দিরে  শিবলিঙ্গ  প্রতিষ্ঠিত।

            নন্দদুলালজিউর  নিত্য  পূজা  ছাড়াও  বছরের  বিভিন্ন  সময়ে  বিভিন্ন  উৎসব  অনুষ্ঠিত  হয়।  এর  মধ্যে  মাঘী  পূর্ণিমার  উৎসব  ও  ফাল্গুণ  পূর্নিমায়  দোল  উৎসব  উল্লেখযোগ্য।  দোলযাত্রা উপলক্ষে  মন্দিরে  নন্দদুলালজিউর  যথারীতি  পূজার  পর  বিগ্রহদ্বয়কে  মন্দির  থেকে  দোলায়  চাপিয়ে  কাছের  একটি  দোলমঞ্চে  স্থাপন  করে  দেবদোলপর্ব  অনুষ্ঠিত  হয়।  দোলমঞ্চটি  প্রাচীন  এবং  দেখতে  সুন্দর।  বাংলা  ১৩৬৫ সনে  প্রাচীন  দোলমঞ্চটির  সংস্কার  করা  হয়।  প্রতিবৎসর  রথযাত্রা  উপলক্ষে  এই  মন্দিরে  জগন্নাথের  বিশেষ  পূজা  হয়  এবং  জগন্নাথ, বলরাম  ও  সুভদ্রাকে  একটি  রথে  স্থাপন  করে  টানা  হয়।  

            সাইবনার  নন্দদুলালজিউ  মন্দিরে  যেতে  হলে  ব্যারাকপুর  স্টেশন  বা  বারাসত  বাসস্ট্যান্ড  থেকে  ৮১  নং  বাসে  উঠুন।  ব্যারাকপুর-বারাসত  রোডের  উপর  মাথারাঙ্গিতে  নামুন।  ওখান  থেকে  অটো  বা  ভ্যান  রিকশায়  পৌঁছে  যান  মন্দিরে। ব্যারাকপুর  থেকে  বাসের  বদলে  নীলগঞ্জের  অটোতেও  উঠতে  পারেন।  ফেরার  সময়  মন্দির  থেকে  গাড়ি  না  পেলে  হেঁটে  সূর্যপুর  দত্তের  পোলে  আসুন।  ওখান  থেকে  গাড়ি  পাবেন। খড়দহ  থেকেও  যেতে  পারেন।  দুপুরে  মন্দির  বন্ধ  থাকে। 


শ্রীশ্রী নন্দদুলাল  মন্দির- ১

শ্রীশ্রী নন্দদুলাল  মন্দির- ২

মন্দিরের  শিখরদেশ

শ্রীশ্রী নন্দদুলাল  ও  রাধিকা   বিগ্রহ - ১

শ্রীশ্রী নন্দদুলাল  ও  রাধিকা   বিগ্রহ - ২

জগন্নাথ, বলরাম  ও সুভদ্রার  বিগ্রহ

জোড়া  শিবমন্দির

দোলমঞ্চ, সাইবনা


  সহায়ক  গ্রন্থাবলি  :

          ১. পশ্চিমবঙ্গের পূজা-পার্বণ  ও  মেলা ( ৩ য়  খণ্ড  ) অশোক  মিত্র  সম্পাদিত 

          ২. পশ্চিমবঙ্গ  ভ্রমণ  ও  দর্শণ  : ভূপতিরঞ্জন  দাস 



            বল্লভপুরের  ( শ্রীরামপুর,  হুগলি )  রাধাবল্লভ  জিউ  মন্দির  সম্বন্ধে  জানতে  নিচের  লিঙ্কে  ক্লিক  করুন :

 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন