জগন্নাথ মন্দির, গোপীনাথপুর, কেশপুর থানা, পশ্চিম মেদিনীপুর
শ্যামল কুমার ঘোষ
পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার কেশপুর থানার অন্তর্গত গোপীনাথপুর একটি গ্রাম। মেদিনীপুর শহর থেকে বাগরুই গ্রামের দূরত্ব ২৩ কিমি। বাগরুই গ্রাম থেকে গোপীনাথপুরের দূরত্ব ৫ / ৬ কিমি। তারাপদ সাঁতরা ও প্রণব রায় তাঁদের গ্রন্থে গ্রামটিকে বাদাড় গোপীনাথপুর বলে উল্লেখ করেছেন। গ্রামের দু-এক জন আমার কাছেও বাদাড় বলে উল্লেখ করেছেন। গ্রামে নবরত্ন জগন্নাথ মন্দিরটি উল্লেখযোগ্য।
ইঁটের তৈরি পূর্বমুখী মন্দিরটি দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে ৭.২৬ ও ৭.১৬ মি. এবং উচ্চতায় প্রায় ১৫.২৪ মি। সামনে ত্রিখিলান প্রবেশপথযুক্ত অলিন্দ। গর্ভগৃহে প্রবেশের একটিই দরজা, সামনে অর্থাৎ পূর্বদিকে। মন্দিরে আগে একটি প্রতিষ্ঠাফলক ছিল। কিন্তু পূর্বে এর পাঠোদ্ধার করা যায় নি। বর্তমানে কোন প্রতিষ্ঠাফলক নেই। সংস্কারের সময় এটি হারিয়ে গেছে। প্রণব রায় লিখেছেন, স্থাপত্য ও পোড়ামাটির কাজের বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করে মন্দিরটি খ্রিস্টীয় আঠারো শতকের গোড়ার দিকে প্রতিষ্ঠিত বলে অনুমান করা যায়। তারাপদ সাঁতরা লিখেছেন, মন্দিরের সেবাইতগণের পক্ষ থেকে জানা যায় যে এটি ১১২৬ বঙ্গাব্দে নির্মিত। মন্দিরটি কর্ণগড়ের কোন রাজা নির্মাণ করে দেন এবং মন্দিরের সেবাকার্য সুষ্টভাবে পরিচালনার জন্য কয়েক শ বিঘা লাখেরাজ জমি দান করেন। সে জমির সামান্যই আজ মন্দির কর্তৃপক্ষের হাতে আছে।
মন্দিরে টেরাকোটার প্রাচুর্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তবে রঙ করার ফলে টেরাকোটার সৌন্দর্য অনেকটাই আজ ম্লান। পূর্ব দিকের প্রথম তলের উল্লেখযোগ্য টেরাকোটা ফলকগুলি : ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর, সঙ্গে নারদ। সমুদ্রমন্থনে লক্ষ্মীর উদ্ধার, রথারূঢ় সূর্যদেবের আবির্ভাব এবং কৃতাঞ্জলিপুটে ভক্তবৃন্দের স্তুতি, ভগীরথের গঙ্গা অনোয়ন, কৃষ্ণ কথা, সুপার্শ্ব কর্তৃক রাবণকে বাধাদান, অশোকবনে সীতা, মারীচ বধ ও অন্যান্য রামায়ণ কাহিনী। এই দিকে দ্বিতলেও টেরাকোটার অলঙ্করণ বর্তমান। সেখানে রামরাবণের যুদ্ধ, ভীষ্মের শরশয্যা, শিকার দৃশ্য ইত্যাদি লক্ষ্য করা যায়। দক্ষিণ দিকের উল্লেখযোগ্য ফলক : জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রার মূর্তি।
গর্ভগৃহে একটি লম্বা বেদির উপর আছেন জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রার দারু বিগ্রহ। আর আছেন দারু নির্মিত একটি ছোট জগন্নাথ বিগ্রহ বা বাল জগন্নাথ। পার্শ্বদেবতা হিসাবে আছেন মহাদেব ও একটি নারায়ণ শিলা। আলাদা করে আছেন আরও ৫১ টি নারায়ণ শিলা। এছাড়া ধাতু নির্মিত অন্যান্য বিগ্রহও আছেন। সমস্ত বিগ্রহ নিত্য পূজিত। নিত্য পূজা ছাড়াও মন্দিরে জন্মাষ্টমী, ঝুলন, রাধাষ্টমী, চাঁচর, দোল, রাস ইত্যাদি বৈষ্ণব অনুষ্ঠান পালন করা হয়। দোল উৎসব বেশ জাঁকজমক সহকারে পালন করা হয়। পাঁচ দিন ধরে চলে উৎসব। শেষ দিনে হয় অন্নকূট উৎসব। এই উপলক্ষ্যে ২৫/৩০ হাজার ভক্ত পাত পেড়ে প্রসাদ গ্রহণ করেন।
গর্ভগৃহের কাঠের দরজাটিও দর্শনীয়। দরজাটিতে ৪৮ টি ছোট ছোট বিভিন্ন মূর্তি ক্ষোদিত। যদিও অপরিপক্ক হাতে রাসায়নিক রং করার ফলে তা অনেকটাই আজ ম্লান।
বাদাড়-গোপীনাথপুর গ্রামের এই মন্দিরটি পুরীর মাধবদাস মঠের অধীন। ১৯ শতকের শেষ দিকে এই স্থান ম্যালেরিয়ায় জনশূন্য হয়ে যায়। ফলে চারপাশ বনবাদাড়ে পূর্ণ হয়ে যায়। টিমটিম করে চলতে থাকে মন্দিরের কাজকর্ম। পরে ২০ শতকের ৫০-এর দশক থেকে আবার এখানে বসবাস শুরু হয়। লোক বসতি একটু বেশি হলে গ্রামের লোকেরাই এগিয়ে আসেন মন্দিরটিকে রক্ষা করতে। পরে আশেপাশের অনেক গ্রামের লোকেরা এতে যুক্ত হন। ক্রমে জগন্নাথের নামে একটি ট্রাস্টি বোর্ড গঠিত হয়। মন্দিরটির সংস্কার করা হয়। সুষ্ট ভাবে বিগ্রহের সেবার ব্যবস্থা করা হয়। পরে অন্যান্য অনুষ্ঠানের সঙ্গে নতুন করে রথযাত্রার সূচনা করা হয়।
গ্রামবাসীদের দানেই বিগ্রহের সেবাকার্য পরিচালনা করা হয়। সকালে মিছরি। দুপুরে অন্নভোগ দেওয়া হয়। ব্যঞ্জন ঘিয়ে রান্না করা হয়। সন্ধ্যায় দুধ, মিছরি ও ফল দেওয়া হয়। গ্রামবাসীদের দেওয়া মানসিক পুজোর দিন পরমান্ন সহ অন্নভোগ নিবেদন করা হয়। আগেই উল্লেখ করেছি যে কর্ণগড়ের রাজারা জগন্নাথের নামে যে লাখেরাজ জমি দিয়েছিলেন তার সামান্য অংশই আজ অবশিষ্ট আছে। তবে সেই অবশিষ্ট চাষের জমির পাওনা ফসল চাষিরা জগন্নাথের সেবার জন্য দেন। এই ফসলের সবটা সেবার জন্য দরকার হয় না। অতিরিক্ত ফসল বিক্রি করে তহবিলে রাখা হয়। মন্দিরটির খোঁজ আমি চিন্ময় বাবুর ( চিন্ময় দাস ) কাছে পেয়েছিলাম। তাঁকে ধন্যবাদ।
কী ভাবে যাবেন ?
কলকাতা থেকে ট্রেনে বা বাসে মেদিনীপুর শহর। সেখান থেকে কেশপুর, ঘাটাল বা চন্দ্রকোনা গামী বাসে জামতলা মোড়। সেখান থেকে ট্রেকারে মুক্তিকেন্দ্র। মুক্তিকেন্দ্র থেকে ডান দিকে আধ কিমি হেঁটে বাগরুই গ্রাম ও লক্ষ্মীবরাহ মন্দির। এই মন্দির দেখে কংসাবতী তীরের আঁকাবাঁকা বাঁধ-রাস্তায় আরও পাঁচ / ছয় কিলো মিটার গেলে পাবেন গোপীনাথপুর গ্রাম। তবে এই পথে বাস, টোটো বা অটো কিছুই পাবেন না। পাবেন শুধু পথ চলতি সাইকেল বা বাইক আরোহী। তাঁদেরই কাউকে অনুরোধ করে পিছনে উঠে পড়তে হবে। যেমন আমি করেছিলাম। আর একটি বিকল্প পথ আছে। মেদিনীপুর থেকে বাসে ডেবরা বাজার। সেখান থেকে টোটোতে পশ্চিম লহনা। সেখান থেকে হেঁটে বাঁশের সাঁকোতে কংসাবতী নদী পেরিয়ে গোপীনাথপুরের জগন্নাথ মন্দির। এই পথেই আমি ফিরেছিলাম।
|
ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর, সঙ্গে নারদ |
|
জগন্নাথ মন্দির ( দক্ষিণ দিক থেকে তোলা ) |
|
জগন্নাথ মন্দির ( সামনে থেকে তোলা ) |
|
মন্দিরের ত্রিখিলান বিন্যাস |
|
বাঁ দিকের খিলানের উপরের কাজ |
|
ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর, সঙ্গে নারদ |
|
রথারূঢ় সূর্যদেবের আবির্ভাব এবং ভক্তবৃন্দের স্তুতি, |
সমুদ্রমন্থনে লক্ষ্মীর উদ্ধার ও অন্য দুটি চিত্র
|
মাঝের খিলানের উপরের কাজ |
|
রামায়ণ কাহিনী |
|
সুপার্শ্ব কর্তৃক রাবণকে বাধাদান ও অশোকবনে সীতা |
|
ডান দিকের খিলানের উপরের কাজ |
|
কৃষ্ণ লীলা |
|
মন্দিরের শিখর ( সামনে থেকে ) |
|
পূর্ব দিকের দ্বিতলের ত্রিখিলান বিন্যাস |
|
বাঁ দিকের খিলানের উপরের কাজ
|
|
মাঝের খিলানের উপরের কাজ
|
|
ডান দিকের খিলানের উপরের কাজ
|
|
দক্ষিণ দিকের ত্রিখিলান বিন্যাস |
|
কুলুঙ্গির কাজ -১ |
|
কুলুঙ্গির কাজ -২ |
|
কুলুঙ্গির কাজ -৩ |
|
মন্দিরের ফটক |
|
দরজার কাঠের ভাস্কর্য (বৃষোপরি শিব ) |
|
দরজার কাঠের ভাস্কর্য (কুম্ভকর্ণের নিদ্রাভঙ্গ )
|
|
দরজার কাঠের ভাস্কর্য (গোপীদের বস্ত্রহরণ ) |
|
দরজার কাঠের ভাস্কর্য (মহিষাসুরমর্দিনী ) |
|
দরজার কাঠের ভাস্কর্য |
|
দরজার কাঠের ভাস্কর্য |
|
জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রা ও অন্যান্য বিগ্রহ |