শনিবার, ২৮ অক্টোবর, ২০২৩

Kamalakanta Kalibari, Kotalhat, Bardhaman Town

 কমলাকান্ত কালীবাড়ি, কোটালহাট, বর্ধমান শহর

                          শ্যামল কুমার ঘোষ

            সাধক প্রবর কমলাকান্ত প্রতিষ্ঠিত কোটালহাটের কালীবাড়ি 'কমলাকান্তের কালীবাড়ি' নামেই পরিচিত। কমলাকান্ত ভট্টাচার্য সাধক কমলাকান্ত নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন। বর্ধমানের মহারাজা   তেজচাঁদ ১২১৬ বঙ্গাব্দে কমলাকান্তকে চান্না থেকে বর্ধমানে নিয়ে এসে তাঁর সভাপণ্ডিত করেন এবং পরে তাঁর শিষ্যত্বও গ্রহণ করেন। মহারাজ তেজচাঁদ কোটালহাটে তাঁকে বারো কাঠা জমি দান করলেন এবং সাধক কমলাকান্তের থাকার বন্দোবস্ত করে দিলেন। সাধক কমলাকান্ত সেখানে খড়ের ছাউনি দিয়ে এক মন্দির নির্মাণ করে মন্দিরে কালীমূর্তি স্থাপন করে আদ্যাশক্তি মহামায়ার সাধনার ক্ষেত্র প্রস্তুত করলেন। মন্দিরের পাশেই পঞ্চমুণ্ডির আসন প্রতিষ্ঠা করলেন। মন্দিরের পিছনে বেলগাছ প্রতিষ্ঠা করে স্থাপন করলেন ভৈরবকে। এই মন্দিরেই তিনি জগজ্জননীর মৃন্ময়ী রূপ থেকে চিন্ময়ী রূপের দেখা পেয়ে ছিলেন।   

            সেকালের খড়ের মন্দির বর্তমানে হয়েছে পাকা দালান শৈলীর মন্দির। মন্দির চত্বর গাছগাছালিতে ভরা। মূল মন্দিরে তিনটি ঘর। মন্দিরের পশ্চিমে ভোগ রান্নার ঘর। গর্ভগৃহের ডান দিকের ঘরটি ছিল সাধকের পঞ্চমুণ্ডির আসন। এই পঞ্চমুণ্ডির আসন যে ঘরে আছে সেই ঘরে সকলকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। এই ঘরে মায়ের একটি ছোট মূর্তি আছে। গর্ভগৃহে রয়েছে একটি বেদি। এর ভিতরে রয়েছে কমলাকান্তের সমাধি। তার উপরে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে মা কালীর কষ্টিপাথরের মূর্তি। পূর্বে মূর্তিটি ছিল মৃন্ময়ী। কষ্টিপাথরের মূর্তিটি বেশ বড়ো, চতুর্ভুজা। মন্দিরের সামনে আছে নাটমন্দির। নাটমন্দিরটি নির্মাণ করে দেন বৈদ্যনাথ দে মহাশয়। মায়ের নিত্য পূজা ছাড়াও প্রতি অমাবস্যায় হোম হয়। কার্তিকী অমাবস্যায় ধুমধামের সঙ্গে মায়ের পূজা করা হয়। 'কমলাকান্ত সমিতি' নামে একটি সমিতি মন্দিরের সেবাকার্য পরিচালনা করেন।    

            ভোগরান্না ঘরের পাশেই একটি বাঁধানো কুয়া। এই কুয়ার একটি ইতিহাস আছে। কমলাকান্তের মৃত্যুকাল উপস্থিত হলে মহারাজা তেজচন্দ্র  কমলাকান্তকে গঙ্গাতীরে নিয়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু কমলাকান্ত কিছুতেই তাতে রাজি হলেন না। এতে মহারাজ কিছুটা মনঃক্ষুণ্ণ হলেন। কিন্তু সাধকের মৃত্যুর সময় দেখা গেল এক জায়গায় মাটি ভেদ করে গঙ্গার আগমন ঘটেছে। পরবর্তীকালে সেটি বাঁধিয়ে রাখা হয়েছে। 

            এ রকম আরও অলৌকিক কাহিনী ঘটেছিল সাধকের জীবদ্দশায় যা আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে। একটি ঘটনা, মহারাজ তেজচন্দ্র তাঁর মদ্যপ পুত্র প্রতাপচাঁদকে ভালো করার জন্য কমলাকান্তের কাছে পাঠিয়ে ছিলেন। কিন্তু একদিন তিনি দেখলেন সাধক নিজেই সুরাপানে মত্ত। রাজা মনে মনে বিরক্ত হলেন। একদিন কমলাকান্ত কমণ্ডলু নিয়ে রাজপ্রসাদে এসেছেন। রাজার ধারণা হল  কমণ্ডলুর মধ্যে সুরা আছে। তাই মহারাজ কমলাকান্তকে জিজ্ঞাসা করলেন, 'ঠাকুর তোমার কমণ্ডলুর মধ্যে কী আছে ?' ভাবের ঘোরে সাধক উত্তর দিলেন, 'দুধ আছে।' তারপর রাজার অবিশ্বাসী চোখ দেখে  কমণ্ডলু থেকে মাটিতে দুধ ঢেলে দেখিয়ে দিলেন। রাজা লজ্জিত হলেন। আর এক দিনের ঘটনা - সাধক কমলাকান্ত মদ্যপ অবস্থায় রাজবাড়িতে এসেছেন মহারাজের কাছে। সাধক প্রকৃতিস্থ কিনা পরীক্ষা করবার জন্য মহারাজ সাধককে জিজ্ঞাসা করলেন, 'গুরুদেব, আজ কী তিথি ?' সাধক ভাবাবেগে উত্তর দিলেন, 'আজ পূর্ণিমা তিথি।' সেদিন ছিল অমাবস্যা। তাই মহারাজ বিরক্ত হয়ে সাধককে বললেন, আজ পূর্ণিমার চাঁদ দেখাতে পারবেন ? সাধক সেদিন মহারাজকে অমাবস্যার রাতে আকাশে পূর্ণ চন্দ্র দেখালেন।

            কমলাকান্ত অনেক শ্যামা সংগীত রচনা করেন। তাঁর রচিত একটি বিখ্যাত শ্যামা সংগীত -

                সদানন্দময়ী কালী, মহাকালের মনোমোহিনী গো মা !

                তুমি আপন সুখে আপনি নাচ, আপনি দেও মা করতালি।।

                আদিভূতা সনাতনী, শূন্যরূপা শশী-ভালী। 

                ব্রহ্মাণ্ড ছিল না যখন হে মা, মুণ্ডমালা কোথায় পেলি।।

                সবে মাত্র তুমি যন্ত্রী, যন্ত্র আমরা তন্ত্রে চলি। 

                তুমি যেমন রাখো তেমনি থাকি, যেমন বলাও তেমনি বলি। 

                অশান্ত কমলাকান্ত বলে দিয়ে গালাগালি -

                এবার সর্ব্বনাশি, ধ'রে অসি, ধর্ম্মাধর্ম্ম দুটোই খেলি।।                   

কষ্টিপাথরের মাতৃমূর্তি - ১

কষ্টিপাথরের মাতৃমূর্তি - ২

কষ্টিপাথরের মাতৃমূর্তি - ৩

কষ্টিপাথরের মাতৃমূর্তি - ৪

পঞ্চমুণ্ডির আসন ঘর

শিবলিঙ্গ 

বাঁধানো কুয়া
                   কী ভাবে যাবেন ?
            কোলকাতা থেকে ট্রেনে বর্ধমান। সেখান থেকে অটোতে মন্দির। কলকাতা থেকে বাসেও বর্ধমান যেতে পারেন।

        সহায়ক গ্রন্থ :
                      ১) নগর বর্ধমানের দেবদেবী : নীরদবরণ সরকার
                      ২) পশ্চিমবঙ্গের কালী ও শক্তি সাধনা : গৌতম বিশ্বাস 
                                              ********

রামায়ণের ৭টি খণ্ডের ৬৪ টি উপাখ্যান ও ১৮৫ টি টেরাকোটা ফলকের আলোকচিত্র সংবলিত আমার লেখা এবং 'রা প্রকাশন' কর্তৃক প্রকাশিত বই 'বাংলার টেরাকোটা মন্দিরে রামায়ণ' প্রকাশিত হয়েছে।


 বইটি ডাক যোগে সংগ্রহ করতে হলে যোগাযোগ করুন :  9038130757 এই নম্বরে। 

কলকাতার কলেজস্ট্রিটের মোড়ে দুই মোহিনীমোহন কাঞ্জিলালের কাপড়ের দোকানের মাঝের রাস্তা ১৫, শ্যামাচরণ দে স্ট্রিটের উপর অবস্থিত বিদ্যাসাগর টাওয়ারের দু'তলায় 'রা প্রকাশনে'র দোকান। ওখান থেকে বইটি সংগ্রহ করতে পারেন। কোনও অসুবিধা হলে উপরোক্ত নম্বরে ফোন করতে পারেন।

বুধবার, ২৫ অক্টোবর, ২০২৩

Temple of Mahamaya, Mahamayatala ( Mahamahapur ), South 24 Parganas

 মহামায়া মন্দির, মহামায়াতলা ( মহামায়াপুর ), দক্ষিণ ২৪ পরগনা

                     শ্যামল কুমার ঘোষ

            গড়িয়া ৫ নম্বর বাসস্ট্যাণ্ডের এক কিমি দক্ষিণে গড়িয়া-বারুইপুর বাস রাস্তায় ২২৮ নম্বর বাসস্ট্যাণ্ড। এই বাসস্ট্যাণ্ডের আগে একটা গলির মধ্যে মহামায়ার মন্দির অবস্থিত। জায়গাটির নাম মহামায়াপুর। কিন্তু লোকমুখে জায়গাটি মহামায়াতলা নামে পরিচিতি লাভ করেছে। 

            উঁচু ভিত্তিবেদির উপর স্থাপিত, দক্ষিণমুখী মূল মন্দিরটি আটচালা শৈলীর। গর্ভগৃহে প্রবেশের দুটি দরজা। একটি দক্ষিণ দিকে,  আর একটি পূর্ব দিকে। মন্দিরের সামনে মন্দিরের সংযুক্ত একটি সমতল ছাদবিশিষ্ট নাটমন্দির ও পূর্ব দিকে একটি সমতল ছাদবিশিষ্ট ভোগ ঘর পরবর্তী কালে নির্মাণ করা হয়েছে।  

             মন্দিরটি আগে ছিল টালির ছাদবিশিষ্ট কাঁচা মন্দির। ১২১০ বঙ্গাব্দে অর্থাৎ ১৮০৩ খ্রিস্টাব্দে রাজপুরের জমিদার দুর্গারাম করচৌধুরী ( ১৭৫৬-১৮১৬ ) স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে পাকা মন্দিরটি তৈরি করে দেন। সাগর চট্টোপাধ্যায় লিখিত 'দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার পুরাকীর্তি' গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে মন্দিরে একটি প্রতিষ্ঠালিপি ছিল। প্রতিষ্ঠালিপির পাঠ ছিল - 'শুভমস্তু শকাব্দ / .... ১২১০ / সন। ..শ্রী দুর্গারাম / কর দাসস্য '। 

           গর্ভগৃহে একটি বেদির উপর নিমকাঠের তৈরি দেবী মহামায়া দণ্ডায়মানা। দ্বিভুজা মূর্তি। দেবীর গায়ের রং হলুদ বর্ণ। মাথায় মুকুট, গায়ে নানা অলঙ্কার। 

            মন্দির প্রাঙ্গন পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। মন্দির চত্বরের এক ধারে একটি বিশাল বটগাছ। বটগাছের গোড়ার চার দিক গোল করে বাঁধানো। গাছের গোড়ায় মনস্কামনায় আশায় রঙিন সুতো জড়ানো। নিত্য পূজা ছাড়াও ২৩ শে জানুয়ারি মা মহামায়ার মহা সমারোহে বাৎসরিক পূজা অনুষ্ঠিত হয়। তাতে বহু মানুষের সমাগম হয়।  

মহামায়া মন্দির 
মন্দিরের শিখর 
মন্দিরের গর্ভগৃহের দৃশ্য 

মা মহামায়া - ১

মা মহামায়া - ২

           
কী ভাবে যাবেন ?
            মেট্রো স্টেশন 'নজরুল' বা গড়িয়া ৫ নম্বর বাস স্ট্যান্ড থেকে বাসে বা টোটোতে মহামায়াতলা যাওয়া যায়। সেখান থেকে হেঁটে মন্দির। এসপ্ল্যানেড বাস স্ট্যান্ড থেকে ২২৮ নম্বর বাসেও  মহামায়াতলা যাওয়া যায়।
                                      ********** 

রামায়ণের ৭টি খণ্ডের ৬৪ টি উপাখ্যান ও ১৮৫ টি টেরাকোটা ফলকের আলোকচিত্র সংবলিত আমার লেখা এবং 'রা প্রকাশন' কর্তৃক প্রকাশিত বই 'বাংলার টেরাকোটা মন্দিরে রামায়ণ' প্রকাশিত হয়েছে।


 বইটি ডাক যোগে সংগ্রহ করতে হলে যোগাযোগ করুন :  9038130757 এই নম্বরে। 

কলকাতার কলেজস্ট্রিটের মোড়ে দুই মোহিনীমোহন কাঞ্জিলালের কাপড়ের দোকানের মাঝের রাস্তা ১৫, শ্যামাচরণ দে স্ট্রিটের উপর অবস্থিত বিদ্যাসাগর টাওয়ারের দু'তলায় 'রা প্রকাশনে'র দোকান। ওখান থেকে বইটি সংগ্রহ করতে পারেন। কোনও অসুবিধা হলে উপরোক্ত নম্বরে ফোন করতে পারেন।

শনিবার, ৭ অক্টোবর, ২০২৩

Blue Jagannath Temple, Khristian Para, Kestopur ( Krishnapur ), North 24 Parganas

 নীল  জগন্নাথ  মন্দির,  দেবনাথ  বাড়ি,  খ্রিস্টান  পাড়া,  কেষ্টপুর ( কৃষ্ণপুর ), উত্তর  ২৪  পরগনা 

    শ্যামল  কুমার  ঘোষ 

            উত্তর  ২৪ পরগনার  কেষ্টপুরের  খ্রিস্টান  পাড়ায়  আছে  নীল জগন্নাথ  দেবের  মন্দির।  মন্দির  বললে  ভুল  হবে।  দেবনাথ  বাড়ির  একটি  ঘরে  বলরাম-সুভদ্রার  সঙ্গে  একই  আসনে  নীল  রঙের  জগন্নাথ  বিগ্রহ  পূজিত  হন।  সাধারণত  জগন্নাথ  দেবের  বিগ্রহ  কৃষ্ণ  বর্ণের  হয়।  তবে  এখানে  নীল  বর্ণের  কেন ?  এর  উত্তর  পেতে  হলে  বেশ  কয়েক  বছর  আমাদের  পিছিয়ে  যেতে  হবে।  দেবনাথ  পরিবারের  এক  সদস্য  অঙ্কিত  দেবনাথের  কাছ  থেকে  আমি  সেই  গল্প  জানতে  পারি।

            ২০১৮  তে  ঘটল  বিপত্তি।  তখন  এই  বাড়ির  জগন্নাথ  মূর্তি  ছিল  কৃষ্ণ  বর্ণের।  মূর্তি  ছিল  মৃন্ময়।  সে  বছর  রথের  সময়  অসাবধানতাবশত  সেই  মাটির  জগন্নাথ  মূর্তি  ক্ষতিগ্রস্ত  হল।  এই  ঘটনায়  দেবনাথ  পরিবারের  সকলে  শোকে  মুহ্যমান  হন  এবং  বিপদের  আশঙ্কায়  বিভিন্ন  পণ্ডিতদের  পরামর্শ  গ্রহণ  করেন।  পণ্ডিতদের  পরামর্শে  তাঁরা  ঠিক  করেন  জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রার  দারুমূর্তি  স্থাপন  করবেন।  নবদ্বীপে  এক  দারু  ভাস্করকে  মূর্তি  নির্মাণের  ফরমাশ  দেওয়া হল।  মূর্তি  নির্মাণ  যখন  শেষ  হয়ে  এসেছে  তখন  অঙ্কিত  বাবুর  মা  এক  রাতে  স্বপ্নে  দেখলেন  যে  একটি  নীল  বর্ণের  বালক  তাঁর  দিকে  এগিয়ে  আসছে।  তাঁরা  ভাবলেন  যে  এই  স্বপ্নের  মধ্যেই  ভগবানের  নির্দেশ  রয়েছে।  তাই  ঠিক  হল  জগন্নাথের  রং  করা  হবে  নীল।  নবদ্বীপের  শ্রী  অর্ক  দাস  তিন  বিগ্রহের  অঙ্গরাগ  করলেন।  অপূর্ব  হল  সেই  তিন  বিগ্রহ।  বিশেষ  করে  জগন্নাথের  বিগ্রহ।  জগন্নাথের  সেই  নয়নাভিরাম  রূপ  দেখে  যেন  চোখ  ফেরানো  যায়  না।  

              এই  বাড়িতে  জগন্নাথকে  গোপাল  রূপে  সেবা  করা  হয়।  অঙ্কিত  বাবুর  মা  জগন্নাথকে  ছেলে  বলে  মনে  করেন।  তাই  জগন্নাথের  এই  রকম  মুখশ্রী।  এখানে  উল্লেখ্য,  দেবনাথ  বাড়ির  সুভদ্রার  বিগ্রহটিও  ব্যতিক্রমী।  এখানে  সুভদ্রার  ত্রিনেত্র  যা  অন্য  কোথাও  দেখা  যায়  না।  এটি  করা  হয়  অঙ্কিত  বাবুর  দিদিমার  কথা  মতো।  অঙ্কিত  বাবুর  মামার  বাড়ি  দক্ষিণেশ্বরে।  তাই  দক্ষিণেশ্বরের  মায়ের  রূপ  কল্পনা  করে  এখানে  সুভদ্রার  ত্রিনেত্র।

                এ  বাড়ির  জগন্নাথের  ভোগে  থাকে  ফ্যান-ভাত  ও  ডাল  সেদ্ধ। অঙ্কিত  বাবুর  মা  স্বপ্নে  যখন  জগন্নাথকে  দেখেন  তখন  তিনি  তাঁকে  জিজ্ঞাসা  করেন  "তুমি  যে  আমার  বাড়িতে  আসতে  চাইছো  তা  তোমাকে  আমি  কী  খেতে  দেবো ?  আমার  তো  সেরকম  সামর্থ  নেই।"  প্রত্যুত্তরে  প্রভু  বলেন,  "সামান্য  ফ্যান-ভাত  ও  ডাল  সেদ্ধতেই  আমি  তুষ্ট।"  তাই  প্রতিদিনের  জগন্নাথের  ভোগে  পোলাও,  পরমান্ন  ইত্যাদি  যা-ই  দেওয়া  হোক  না  কেন  সঙ্গে  ফ্যান  ভাত  ও  ডাল  সেদ্ধ  দেওয়া  হবেই।

            ২০০২  খ্রিষ্টাব্দে  এ  বাড়িতে  রথযাত্রা  শুরু  করেছিলেন  অঙ্কিত  বাবুর  ঠাকুরমা।  তখন  রথযাত্রা  হত  ছোটো  করে।  আগে  এঁরা  নয়াপট্টিতে  ভাড়া  থাকতেন।  এ  বাড়ির  সকলে  সেখানে  রথযাত্রা  দেখতে  যেতেন।  কোনো  কারণে  সে  বছর  সেখানে  রথযাত্রা  বন্ধ  থাকে।  তাই  অঙ্কিত  বাবুর  ঠাকুরমার  পরামর্শে  তাঁরা  এই  বাড়িতে  রথযাত্রা  শুরু  করেন।  আগেই  বলা  হয়েছে  যে  তখন  জগন্নাথ  ছিল  মাটির  তৈরি।  নিজের  বাড়িতে  রথযাত্রা  হলেও  তাঁরা  অন্য  আর  একটা  জায়গায়  রথযাত্রা  দেখতে  যেতেন।  ২০১২ -১৩  নাগাদ  সেখানে  রথে  আসীন  জগন্নাথকে  অঙ্কিত  বাবুর  মা  স্পর্শ  করতে  যান।  কিন্তু  কর্তৃপক্ষ  তাঁকে  জগন্নাথকে  স্পর্শ  করতে  বাধা  দেন।  তাঁদের  যুক্তি  ছিল,  মহিলারা  জগন্নাথকে  স্পর্শ  করতে  পারে  না।  এতে  বাড়ির  সকলে  মনঃক্ষুণ্ণ  হয়ে  বাড়ির  রথটিকে  বড়ো  করতে  মনস্ত  করেন।  শুরু  হয়  বড়ো  করে  রথযাত্রা।  এরপর  ২০১৮  তে  অঘটনের  কথা  আগেই  বলা  হয়েছে।  রথযাত্রা  চলতে  থাকে।  ২০২১  ও  '২২  দুবছর  করোনার  কারণে  রথযাত্রা  বন্ধ  থাকে।  ২০২৩ -এ  রথটা  নষ্ট  হওয়ার  কারণে  রথ  টানা  হয়  নি।  তবে  কোলে  করে  বিগ্রহকে  মাসির  বাড়ি  নিয়ে  যাওয়া  হয়।  এখানে  উল্লেখ্য,  এখানে  জগন্নাথের  মাসির  বাড়ি  কাছেই  ঝুলন  মন্দিরের  কাছে  অমিত  মণ্ডলের  বাড়ি।  কেবল  মাত্র  রথযাত্রা  নয়, সারা  বছর  দেবনাথ  বাড়িতে  জগন্নাথের  আরও  নানা  অনুষ্ঠানের  আয়োজন  করা  হয়।  সেই  সব  অনুষ্ঠানে  এবং  রথযাত্রায়  জাতি-ধৰ্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে  সকলে  অংশ  গ্রহণ  করেন।  খ্রিস্টান  পাড়ার  বেশির  ভাগ  খ্রিস্টান  পরিবারের  বাস।  তাঁদের  অনেকেই  এই  সব  অনুষ্ঠানে  এবং  রথযাত্রায়  আন্তরিক  ভাবে  অংশ  গ্রহণ  করে  থাকেন।

            দেবনাথ  বাড়িতে  দারু  নির্মিত  জগন্নাথ-বলরাম-বিগ্রহ  ছাড়াও  পিতলের  গোপাল,  পিতলের  গৌর-নিতাই  ও  অন্যান্য  বিগ্রহ  বর্তমান।  সমস্ত  বিগ্রহই  নিত্য  পূজিত।          

দারু নির্মিত বলরাম-সুভদ্রা-জগন্নাথ
নীল জগন্নাথ
বলরাম ও সুভদ্রা
গোপাল ও অন্যান্য বিগ্রহ

গৌর-নিতাই ও অন্যান্য বিগ্রহ

          কী  ভাবে  যাবেন ?

            কলকাতার  উল্টোডাঙ্গা  ব্রিজের  কাছ  থেকে  কেষ্টপুর  গামী  ১২সি / ২  বাসে  খ্রিস্টান  পাড়ায়  নেমে  দেবনাথ  বাড়ি  বা  নীল  জগন্নাথ  বাড়ি  যাওয়া  যায়।  উল্টোডাঙ্গা  ব্রিজের  কাছ  থেকে  বাগুইআটি  গামী  বাসে  কেষ্টপুরে  নেমে  সাবওয়ে  দিয়ে  রাস্তার  বিপরীত  দিকে  গিয়ে  অটোতে  খ্রিস্টান  পাড়ায়  যাওয়া  যায়।

                                          ********

রামায়ণের ৭টি খণ্ডের ৬৪ টি উপাখ্যান ও ১৮৫ টি টেরাকোটা ফলকের আলোকচিত্র সংবলিত আমার লেখা এবং 'রা প্রকাশন' কর্তৃক প্রকাশিত বই 'বাংলার টেরাকোটা মন্দিরে রামায়ণ' প্রকাশিত হয়েছে।


 বইটি ডাক যোগে সংগ্রহ করতে হলে যোগাযোগ করুন :  9038130757 এই নম্বরে। 

কলকাতার কলেজস্ট্রিটের মোড়ে দুই মোহিনীমোহন কাঞ্জিলালের কাপড়ের দোকানের মাঝের রাস্তা ১৫, শ্যামাচরণ দে স্ট্রিটের উপর অবস্থিত বিদ্যাসাগর টাওয়ারের দু'তলায় 'রা প্রকাশনে'র দোকান। ওখান থেকে বইটি সংগ্রহ করতে পারেন। কোনও অসুবিধা হলে উপরোক্ত নম্বরে ফোন করতে পারেন।

মঙ্গলবার, ১ আগস্ট, ২০২৩

Siddheshwari Kali temple, De Bari, Rampara, Jangipara, Hooghly

  সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির, দে বাড়ি, রামপাড়া, জাঙ্গিপাড়া, হুগলি

                                 শ্যামল কুমার ঘোষ 

            হুগলি  জেলার  জাঙ্গিপাড়া  ব্লকের  অধীন  একটি  গ্রাম  রামপাড়া।  কলকাতা  থেকে  দূরত্ব  ৩৮  কিমি।  গ্রামে  দুটি  কালী  মন্দির  বিখ্যাত।  একটি  নন্দী  পরিবারের  এবং  অপরটি  দে  পরিবারের।  এখানে  দে  পরিবারের  কালী  মন্দির  নিয়ে  আলোচনা  করবো।

            উঁচু  ভিত্তিবেদির  উপর  স্থাপিত,  চার  খিলানবিশিষ্ট,  দক্ষিণমুখী  মন্দিরটি  দালান  শৈলীর।  মন্দিরটির  সামনের  দেওয়ালে  সুন্দর  পঙ্খের  আছে। মন্দিরটিতে  পাশাপাশি  কয়েকটি  ঘর।  একটি  ঘরে  মা  সিদ্ধেশ্বরী  বিরাজমান।  বিগ্রহটি  দারু  নির্মিত।  এটি  একটি  ব্যতিক্রমী  কালী  মূর্তি  এবং  খুবই  প্রাচীন।  ওই  একই  ঘরে  আছেন  লোকিক  দেবতা  পঞ্চানন।  এ  ছাড়াও  আছেন  নারায়ণ ( নারায়ণ  শিলা )  ও  লক্ষ্মী  ( কুনকে )।  মন্দিরের  বাকি  ঘরগুলি  ভোগঘর  হিসাবে  বা  অন্য  কাজে  ব্যবহার  করা  হয়।  মন্দিরটি  পাঁচিল  দিয়ে  ঘেরা।  মন্দিরটি  প্রতিষ্ঠা  করেন  রামপাড়ার  এই  দে  পরিবারের  এক  পূর্ব  পুরুষ।

রামপাড়া দে বাড়ি কালী মন্দির

মন্দিরে পঙ্খের কাজ

মন্দিরে খিলানের পঙ্খের কাজ

দালানের ছাদের নিচের পঙ্খের কাজ 

দালানের দেওয়ালে পঙ্খের কাজ

গর্ভগৃহের দৃশ্য 

নারায়ণ ( নারায়ণ  শিলা )  ও  লক্ষ্মী  ( কুনকে )

মা  সিদ্ধেশ্বরী - ১

মা  সিদ্ধেশ্বরী - ২

         কী  ভাবে  যাবেন ?

            হাওড়া  স্টেশন  থেকে  বর্ধমান  কর্ড  লাইনের  ট্রেন  ধরে  বারুইপাড়া  স্টেশনে  নামুন।  সেখান  থেকে  টোটো  ধরে  শিয়াখালার  অটো  স্ট্যাণ্ড।  সেখান  থেকে  টোটোতে  রামপাড়ার  নন্দী  বাড়ির  কাছেই  দে  বাড়ি।

           রামপাড়ার  নন্দী  বাড়ি  কালী  মন্দির  সম্বন্ধে  জানতে  নিচের  লিঙ্কে  ক্লিক  করুন :

            সিদ্ধেশ্বরী  কালী  মন্দির,  নন্দী  বাড়ি,  রামপাড়া,  হুগলি            

        ------------------------------------

রামায়ণের ৭টি খণ্ডের ৬৪ টি উপাখ্যান ও ১৮৫ টি টেরাকোটা ফলকের আলোকচিত্র সংবলিত আমার লেখা এবং 'রা প্রকাশন' কর্তৃক প্রকাশিত বই 'বাংলার টেরাকোটা মন্দিরে রামায়ণ' প্রকাশিত হয়েছে।


 বইটি ডাক যোগে সংগ্রহ করতে হলে যোগাযোগ করুন :  9038130757 এই নম্বরে। 

কলকাতার কলেজস্ট্রিটের মোড়ে দুই মোহিনীমোহন কাঞ্জিলালের কাপড়ের দোকানের মাঝের রাস্তা ১৫, শ্যামাচরণ দে স্ট্রিটের উপর অবস্থিত বিদ্যাসাগর টাওয়ারের দু'তলায় 'রা প্রকাশনে'র দোকান। ওখান থেকে বইটি সংগ্রহ করতে পারেন। কোনও অসুবিধা হলে উপরোক্ত নম্বরে ফোন করতে পারেন।

রবিবার, ৩০ জুলাই, ২০২৩

Siddheshwari Kali temple, Nandi Bari, Rampara, Jangipara, Hooghly

 সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির, নন্দী বাড়ি, রামপাড়া, জাঙ্গিপাড়া, হুগলি

                                 শ্যামল কুমার ঘোষ 

            হুগলি  জেলার  জাঙ্গিপাড়া  ব্লকের  অধীন  একটি  গ্রাম  রামপাড়া।  কলকাতা  থেকে  দূরত্ব  ৩৮  কিমি।  গ্রামে  দুটি  কালী  মন্দির  বিখ্যাত।  একটি  নন্দী  পরিবারের  এবং  অপরটি  দে  পরিবারের।  এখানে  নন্দী  পরিবারের  কালী  মন্দির  নিয়ে  আলোচনা  করবো।

            উঁচু  ভিত্তিবেদির  উপর  স্থাপিত,  ছয়  খিলানবিশিষ্ট ,  দক্ষিণমুখী  মন্দিরটি  দালান  শৈলীর।  মন্দিরটির  সামনের  দেওয়ালে  সুন্দর  পঙ্খের  আছে। মন্দিরটিতে  পাশাপাশি  কয়েকটি  ঘর।  একটি  ঘরে  মা  সিদ্ধেশ্বরী  বিরাজমান।  বিগ্রহটি  দারু  নির্মিত।  এটি  একটি  ব্যতিক্রমী  কালী  মূর্তি  এবং  খুবই  প্রাচীন।  ওই  একই  ঘরে  বাঘের  পিঠে  সওয়ার  লোকিক  দেবতা  পঞ্চানন।  মন্দিরের  বাকি  ঘরগুলি  ভোগঘর  হিসাবে  বা  অন্য  কাজে  ব্যবহার  করা  হয়।  মন্দিরটি  পাঁচিল  দিয়ে  ঘেরা।  মন্দির  প্রাঙ্গনে  একটি  জগন্নাথ  মন্দির  ও  একটি  বাগান  আছে।  মন্দিরে  একটি  রথও  আছে।  মন্দিরটি  প্রতিষ্ঠা  করেন  রামপাড়ার  নন্দী  পরিবারের  এক  পূর্ব  পুরুষ।         

রামপাড়া নন্দী বাড়ি কালী মন্দির 
 
দুই  পরি - ১ 

দুই পরি - ২
                 
গজ লক্ষ্মী 

দুই সখিসহ রাধা-কৃষ্ণ 

ষড়ভুজ গৌরাঙ্গ

অন্নপূর্ণা 

গরুড় মূর্তি 

লৌকিক দেবতা পঞ্চানন 

মা  সিদ্ধেশ্বরী - ১

মা  সিদ্ধেশ্বরী - ২

মা  সিদ্ধেশ্বরী - ৩

          কী  ভাবে  যাবেন ?

            হাওড়া  স্টেশন  থেকে  বর্ধমান  কর্ড  লাইনের  ট্রেন  ধরে  বারুইপাড়া  স্টেশনে  নামুন।  সেখান  থেকে  টোটো  ধরে  শিয়াখালার  অটো  স্ট্যাণ্ড।  সেখান  থেকে  টোটোতে  রামপাড়ার  নন্দী  বাড়ি।

              রামপাড়ার  দে  বাড়ির  কালী  মন্দির  সম্বন্ধে  জানতে  নিচের  লিঙ্কে  ক্লিক  করুন :

            সিদ্ধেশ্বরী  কালী  মন্দির,  দে  বাড়ি,  রামপাড়া,  হুগলি       

                       ------------------------------------

রামায়ণের ৭টি খণ্ডের ৬৪ টি উপাখ্যান ও ১৮৫ টি টেরাকোটা ফলকের আলোকচিত্র সংবলিত আমার লেখা এবং 'রা প্রকাশন' কর্তৃক প্রকাশিত বই 'বাংলার টেরাকোটা মন্দিরে রামায়ণ' প্রকাশিত হয়েছে।


 বইটি ডাক যোগে সংগ্রহ করতে হলে যোগাযোগ করুন :  9038130757 এই নম্বরে। 

কলকাতার কলেজস্ট্রিটের মোড়ে দুই মোহিনীমোহন কাঞ্জিলালের কাপড়ের দোকানের মাঝের রাস্তা ১৫, শ্যামাচরণ দে স্ট্রিটের উপর অবস্থিত বিদ্যাসাগর টাওয়ারের দু'তলায় 'রা প্রকাশনে'র দোকান। ওখান থেকে বইটি সংগ্রহ করতে পারেন। কোনও অসুবিধা হলে উপরোক্ত নম্বরে ফোন করতে পারেন।
        

রবিবার, ২৩ জুলাই, ২০২৩

Uttarbahini Temple, Sheakhala, Chanditala, Hooghly

 

 উত্তরবাহিনী  মন্দির,  শিয়াখালা,  চণ্ডীতলা,  হুগলি

শ্যামল  কুমার  ঘোষ 


             উত্তরবাহিনী  হুগলি  জেলার  শিয়াখালা  পল্লির  বিখ্যাত  ও  বহু  শতাব্দীর  এক  প্রাচীন  লৌকিক  দেবী।  শিয়াখালার  পূর্বের  নাম  ছিল  শিবাক্ষেত্র।  দেবীর  মূর্তি  বেশ  সুশ্রী,  দীর্ঘাঙ্গী,  উচ্চতায়  ৬ / ৭ ফুট  এবং  বলিষ্ঠ  চেহারা।  বর্ণ  রক্তাভ  হলুদ,  মাথায়  এলোকেশের  উপর  মুকুট,   ত্রিনয়ন,  নাকে  নথ,  গলায়  মুণ্ডমালা  ও  নানা  প্রকার  হার,  ডান  হাতে  খড়্গ,  বাম  হাতে  রুধির  পাত্র।  পরিধানে  বক্ষবন্ধনী,  সোনালী  জরির  কাজ  করা  রক্ত  বর্ণের  শাড়ি  কটিদেশ  থেকে  পদতল  পর্যন্ত  বিস্তৃত।  হিন্দুস্থানী  মেয়েরা  যে  ধরনের  হার,  চুড়ি,  মল  ব্যবহার  করেন  দেবীর  গায়ে  সেই  রকম  অলংকারাদি।  দেবীর  বাম  পা  জোড়  হাতে  উপবিষ্ট  বটুক  ভৈরবের  মাথায়  এবং  ডান  পা  শায়িত  মহাকালরূপী  শিবের  বুকের  উপর  স্থাপিত।  শায়িত  শিবের  নাভিদেশের  উপর  একটি  অসুরের  মুণ্ড।

            পূর্বে  দেবীর  মূর্তি  ছিল  মাটির,  বর্তমানে  মূর্তিটি  পাথরের।  বাংলার  কোন  লৌকিক  দেবীর  এত  বড়  পাথরের  মূর্তি  ( ৬/৭ ফুট )  দেখা  যায়  না।  স্থানীয়  ভক্তদের  চেষ্টায়  কাশীর  ভাস্কর  দ্বারা  উত্তরবাহিনীর  এই  পাথরের  মূর্তি  তৈরি  করা  হয়।  এই  মূর্তি  নির্মাণে  স্থানীয়  চিকিৎসক  যামিনীকান্ত  রায়ের  ভূমিকা  ছিল  উল্লেখযোগ্য।  দেবীর  আদি  মূর্তিটি  ছিল  পাথরের,  আকারে  খুবই  ছোট।  তাই  বড়  মূর্তি  তৈরি  করার  প্রয়োজন  হয়।  এই  রকম  ছোট  মূর্তিকে  ভোগমূর্তি  বলে। 

            উত্তরবাহিনী  দেবীর  বহুকাল  পূর্বেও  খ্যাতি  ছিল  তা  জানা  যায়  মধ্যযুগে  রচিত  মঙ্গলকাব্য  থেকে।  রূপরামের  ধর্মমঙ্গলে  আছে - 

     "শ্মশানে  বন্দিলাম  শ্যামা  করালবদনী। 

      সেইখালায়  বন্দিলাম  উত্তর-বাহিনী।। "

            উত্তরবাহিনীর  প্রাচীনত্বের  বিষয়ে  জানা  যায়,  হুগলি  জেলার  এই  অংশ  খ্রি:  ষোড়শ  শতাব্দীতেও  গভীর  জঙ্গলে  ঢাকা  ছিল  এবং  অধিবাসীরা  ছিলেন  অনুন্নত  শ্রেণীর।  তাঁরা  ভীষণ  প্রকৃতির  ও  দুর্ধর্ষ  যোদ্ধা  ছিলেন।  তাঁরা  রাজশক্তির  বিরুদ্ধে  বিদ্রোহ  ঘোষণা  করেন।  সেই  সময়  বাংলার  শাসক  ছিলেন  সুলতান  হোসেন  শাহ।  তাঁর  উজির  ছিলেন  শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল  রচয়িতা  গোপীনাথ  বসু  বা  পুরন্দর  খাঁ।  যুদ্ধ  বিষয়ে  তিনি  ছিলেন  দক্ষ।  তিনি  শিয়াখালা  অঞ্চলের  সেই  আদিবাসীদের  দমন  করেন।  সে কারণে  পুরন্দর  খাঁ  এই  অঞ্চল  সুলতানের  কাছ  থেকে  'জায়গীর'  হিসাবে  পান  এবং  শিয়াখালায়  নিজের  প্রাসাদ  ও  উত্তরবাহিনী  দেবীর  মন্দির  তৈরি  করেন।            

            দেবীর  উৎপত্তি  সম্পর্কে  জনশ্রুতি,  এই  শিয়াখালা  গ্রামে  এক  শাণ্ডিল্য  গোত্রীয়  এক  ব্রাহ্মণ  বাস  করতেন।  তাঁর  এক  বিদ্যাবিমুখ  পুত্র  সন্তান  ছিল।  লেখাপড়ায়  তাঁর  মন  ছিল  না।  একদিন  সেই  ব্রাহ্মণ  রেগে  গিয়ে  তাঁর  গৃহিণীকে  আদেশ  দিলেন  যে  ছেলেকে  ভাত  দেওয়ার  পরিবর্তে  থালায়  করে  যেন  ছাই  পরিবেশন  করা  হয়।  স্বামীর  কথা  শুনে  স্ত্রী  ছেলেকে  ভাতের  পরিবর্তে  সত্য  সত্যই  ছাই  পরিবেশন  করেন।  এই  দেখে  ওই  ব্রাহ্মণ   সন্তান  রাগে-দুঃখে  নিজের  জীবন  বিসর্জন  দিতে  পাশের  কৌশিকী  নদীতে  ঝাঁপ  দেন।  ঝাঁপ  দেওয়ার  পর  জলের  মধ্যে  তাঁর  হাতে  একটি  বস্তু  ঠেকে।  জলের  উপরে  তুলে  তিনি  দেখেন,  সেটি  একটি  পাথরের  ক্ষুদ্রকায়  এক  দেবী  মূর্তি।  এই  সময়  তিনি  একটি  দৈব্যবাণী  শোনেন,  "আমি  দেবী  বিশালাক্ষী,  উত্তরবাহিনী  নামে   আমাকে  এখানে  তুই  প্রতিষ্ঠা  কর  এবং  আমার  নিয়মিত  পূজা-অর্চনার  ব্যবস্থা  কর।"  দৈব্যবাণী  শুনে  ওই  ব্রাহ্মণ  সন্তান  পাশেই  একটি  চালা  ঘর  তৈরি  করে  দেবী  মূর্তিটি  প্রতিষ্ঠা  করে  পূজা-অর্চনা  শুরু  করেন।  পরবর্তী  সময়ে  সেই  ব্রাহ্মণ  সন্তান  এক  সর্বজ্ঞ  পণ্ডিত  হয়ে  ওঠেন।

            উত্তরবাহিনীর  বর্তমান  মন্দিরটি  উঁচু  ভিত্তিবেদির  উপর  স্থাপিত,  উত্তরমুখী,  পাঁচখিলানবিশিষ্ট  একটি  দালান।  মন্দিরের  সামনে  বড়  বড়  থামবিশিষ্ট  চাঁদনি  আকৃতির  নাটমন্দির  বর্তমান।  তবে  মন্দির  ও  নাটমন্দির  এখনো  সম্পূর্ণ  হয়  নি।  

            বর্তমানে  যে  পাথরের  মূর্তিটি  মন্দিরে  স্থাপিত  সেটি  ১৩৪০  বঙ্গাব্দের  ১৬ই  আষাঢ়  প্রতিষ্ঠা  করা  হয়।  তাই  ১৬ই  আষাঢ়  মন্দিরে  ব্যৎসরিক  উৎসব  পালন  করা  হয়।  দেবীর  নতুন  ঘট  প্রতিষ্ঠিত  হয়  শারদীয়া  শুক্লা  একাদশী  তিথিতে।  আষাঢ়  মাসের  ১৬  ও  ১৭  তারিখ  দুইদিন  ব্যৎসরিক  উৎসব  উপলক্ষ্যে  মন্দিরে  অসংখ্য  ভক্তের  সমাগম  হয়।  উত্তরবাহিনীর  ভোগ  গ্রহণের  জন্য  শিয়াখালা  ও  আশেপাশের  গ্রামের  মানুষ  ছাড়াও  দূরদূরান্ত  থেকেও  বহু  মানুষ  মন্দিরে  ভিড়  করেন।   এই উপলক্ষ্যে  মন্দির  চত্বরে  মেলা  বসে।  আলোকমালায়  সজ্জিত  হয়  মন্দির।                  

উত্তরবাহিনী - ১

মন্দির ও নাটমন্দির 

উত্তরবাহিনী - ২

উত্তরবাহিনী - ৩


          কী  ভাবে  যাবেন ?

            হাওড়া  স্টেশন  থেকে  বর্ধমান  কর্ড  লাইনের  ট্রেন  ধরে  বারুইপাড়া  স্টেশনে  নামুন।  সেখান  থেকে  টোটো  ধরে  শিয়াখালার  মন্দির। 

সহায়ক  গ্রন্থ :

          ১)  বাংলার  লৌকিক  দেবতা :  গোপেন্দ্রকৃষ্ণ  বসু  

           ------------------------------------

 রামায়ণের ৭টি খণ্ডের ৬৪ টি উপাখ্যান ও ১৮৫ টি টেরাকোটা ফলকের আলোকচিত্র সংবলিত আমার লেখা এবং 'রা প্রকাশন' কর্তৃক প্রকাশিত বই 'বাংলার টেরাকোটা মন্দিরে রামায়ণ' প্রকাশিত হয়েছে।


 বইটি ডাক যোগে সংগ্রহ করতে হলে যোগাযোগ করুন :  9038130757 এই নম্বরে। 

কলকাতার কলেজস্ট্রিটের মোড়ে দুই মোহিনীমোহন কাঞ্জিলালের কাপড়ের দোকানের মাঝের রাস্তা ১৫, শ্যামাচরণ দে স্ট্রিটের উপর অবস্থিত বিদ্যাসাগর টাওয়ারের দু'তলায় 'রা প্রকাশনে'র দোকান। ওখান থেকে বইটি সংগ্রহ করতে পারেন। কোনও অসুবিধা হলে উপরোক্ত নম্বরে ফোন করতে পারেন।

শুক্রবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

Anandamayi Kali Temple, Sukharia, Somrabazar, Hooghly

 আনন্দময়ী  কালী  মন্দির,  সুখাড়িয়া,  সোমরাবাজার,  হুগলি 

                                   শ্যামল  কুমার  ঘোষ


            ব্যাণ্ডেল-কাটোয়া  রেলপথে  সোমরাবাজার  একটি  রেলস্টেশন।  হাওড়া  থেকে  দূরত্ব  ৬৭  কিমি।  শিয়ালদহ  থেকে  সকাল  ৮ টা  ০৬  মিনিটের  কাটোয়া  লোকালে  বা  হাওড়া  থেকে  যে  কোন  কাটোয়া  লোকালে  এখানে  যাওয়া  যায়।  ব্যাণ্ডেল  থেকেও  সোমরাবাজার  যেতে  পারেন।  স্টেশন  থেকে  টোটোতে  সুখাড়িয়ার  আনন্দময়ী  কালী  মন্দিরে  যাওয়া  যায়।

            সুখাড়িয়ার  মুস্তৌফী  বংশ  নদিয়া  জেলার  উলার  মুস্তাফী  বা  মুস্তৌফী  বংশের  একটি  শাখা।  উলার  রামেশ্বর  মিত্রমুস্তাফী  বা  মিত্রমুস্তৗফী  ছিলেন  এই  বংশের  প্রতিষ্ঠাতা।  রামেশ্বর  নবাব  মুর্শিদকুলি  খাঁর  শাসনকালে  সুবে  বাংলার  রাজস্ব  বিভাগের  মুস্তৗফী  (= নায়েব  কানুনগো )  পদে  উন্নীত  হন।  এই  রামেশ্বরের  পুত্র  অনন্তরাম  মুস্তৗফী  মহারাজ  কৃষ্ণচন্দ্রের  বিরাগভাজন  হওয়ার  ফলে  উলা  ছেড়ে  সুখারিয়া  গ্রামে  চলে  আসেন।  তাঁর  দাদা  রঘুনন্দন  শ্রীপুরে  ( বলাগড় )  বসতি  স্থাপন  করেন।

            সুখাড়িয়ার  মন্দিরগুলির  মধ্যে  আনন্দময়ী  কালীমন্দির  উল্লেখযোগ্য।  ১৮১৩  খ্রীষ্টাব্দে  বীরেশ্বর  মুস্তৗফী  মন্দিরটি  নির্মাণ  করেন।  উঁচু  ভিত্তিবেদির  উপর  স্থাপিত,  দক্ষিণমুখী  মন্দিরটি  পঁচিশরত্ন  শৈলীর।  ত্রিতল  মন্দিরটিতে  মোট  পঁচিশটি  চূড়া  বা  রত্ন  আছে।  প্রথম  তলের  প্রতিটি  কোণে  তিনটি  হিসাবে  বারোটি,  দ্বিতীয়  তলের  প্রতিটি  কোণে  দুটি  হিসাবে  আটটি,  তৃতীয়  তলের  প্রতিটি  কোণে  একটি  হিসাবে  চারটি  এবং  সর্বোপরি  কেন্দ্রীয়  শিখর  বা  রত্ন।  এই  ধরণের  পঞ্চবিংশতিরত্ন  মন্দির  পশ্চিমবঙ্গে  আরও  চারটি  আছে,  বর্ধমান  জেলার  কালনায়  তিনটি  এবং  বাঁকুড়া  জেলার  সোনামুখীতে  একটি।  ১৮৯৭  খ্রীষ্টাব্দে  ভূমিকম্পে  এই  মন্দিরের  সর্বোচ্চ  পাঁচটি  চূড়া  ক্ষতিগ্রস্ত  হলে  সেগুলিকে  আবার  নূতন  করে  স্থাপন  করা  হয়। মন্দিরের  গায়ে  টেরাকোটার  অলংকরণ  আছে।  কিন্তু  কালের  প্রবাহে  বর্তমানে  সেগুলি  ক্ষতিগ্রস্ত।  টেরাকোটা  মূর্তিগুলির  মধ্যে  অন্নপূর্ণা,  জগদ্ধাত্রী,  কালী,  পঞ্চমুখী  গণেশ  ও  সিংহবাহিনী  উল্লেখযোগ্য।  মন্দিরের  গর্ভগৃহে  বেদির  উপর  শায়িত  শিবের  বক্ষোপরি  উপবিষ্টা  আনন্দময়ী  কালীর  বিগ্রহ  নিত্য  পূজিত।  বিগ্রহ  উচ্চতায়  প্রায়  ৩  ফুট ( ৯১.৪ সেমি )।  মন্দিরের  একটি  ঘরে  শ্রীধর  জিউ  নামক  নারায়ণ  শিলা  ও  অপর  একটি  নারায়ণ  শিলাও  নিত্য  পূজিত। 

            মন্দির  এলাকার  মধ্যে  দুই  সারিতে  ছয়টি  করে  বারোটি  মন্দির  আছে।  এর  মধ্যে  দুটি  পঞ্চরত্ন  ও  বাকিগুলো  আটচালা  শৈলীর।  পশ্চিমমুখী  ৬ টা  মন্দিরের  উত্তর  দিকে  একটি  পঞ্চরত্ন  ও  বাকি  ৫ টি  আটচালা  শৈলীর।  ৫ টা  আটচালা  মন্দিরের  মাঝের  আটচালা  মন্দিরের  গর্ভগৃহে  সাদা  শিবলিঙ্গ  ও  বাকি  ৪ টা  আটচালা  ও  পঞ্চরত্ন  মন্দিরের  গর্ভগৃহে  কালো  শিবলিঙ্গ  প্রতিষ্ঠিত।  পূর্বমুখী  ৬ টা  মন্দিরের  উত্তর  দিকে  একটি  পঞ্চরত্ন  ও  বাকি  ৫ টি  আটচালা  শৈলীর।  ৫ টা  আটচালা  মন্দিরের  মাঝের  আটচালা  মন্দিরের  গর্ভগৃহে  সাদা  শিবলিঙ্গ  ও  বাকি  ৪ টা  আটচালা  মন্দিরের  গর্ভগৃহে  কালো  শিবলিঙ্গ  প্রতিষ্ঠিত।  পঞ্চরত্ন  মন্দিরের  গর্ভগৃহে  গণেশ  বিগ্রহ  প্রতিষ্ঠিত।  এই  পঞ্চরত্ন  মন্দিরের  গায়ে  টেরাকোটা  ফলক  বর্তমান।  অষ্টাদশ  শতকের  গোড়ার  দিকে  এটি  নির্মিত  হয়।  মন্দির  চত্বরের  পশ্চিম  দিকে  একটি  বড়  পুকুর  আছে।  এই  পুকুরের  অপর  পাড়  থেকে  মন্দিরগুলি  খুব  সুন্দর  দেখায়।                                    

            মন্দিরটি  পরিদর্শনের  তারিখ :

আনন্দময়ী কালী মন্দির চত্বর, সুখাড়িয়া, হুগলি 

আনন্দময়ী কালী মন্দির, সুখাড়িয়া, হুগলি
মন্দিরের শিখর ( পূর্ব দিক থেকে )

মন্দিরের সামনের বিন্যাস


মাঝের খিলানের উপরের কাজ 

ডান দিকের খিলানের উপরের কাজ 

পূর্ব দিকের একটি সিংহ মূর্তি 

অন্নপূর্ণা মূর্তি 

জগদ্ধাত্রী

কালী

পঞ্চমুখী গণেশ

সিংহবাহিনী

গর্ভগৃহের  সামনের  অলিন্দের কাজ 

পূর্বমুখী ৬ টি মন্দির 

পশ্চিমমুখী ৬ টি মন্দির 

পূর্বমুখী পঞ্চমুখী গনেশ মন্দির 

গনেশ মন্দিরের সামনের দেওয়ালের কাজ -১

গনেশ মন্দিরের সামনের দেওয়ালের কাজ -২

গনেশ মন্দিরের সামনের দেওয়ালের কাজ -৩

গণেশ মূর্তি 

শ্রীধর জিউ ও অন্য একটি নারায়ণ শিলা

আনন্দময়ী কালী মূর্তি - ১

আনন্দময়ী কালী মূর্তি - ২

পুকুরের অপর পাড় থেকে মন্দির - ১

পুকুরের অপর পাড় থেকে মন্দির - ২


            সহায়ক  গ্রন্থ :

                           ১) হুগলি  জেলার  পুরাকীর্তি :  নরেন্দ্রনাথ  ভট্টাচার্য 


------------------------------------------------------------------------
             

রামায়ণের ৭টি খণ্ডের ৬৪ টি উপাখ্যান ও ১৮৫ টি টেরাকোটা ফলকের আলোকচিত্র সংবলিত আমার লেখা এবং 'রা প্রকাশন' কর্তৃক প্রকাশিত বই 'বাংলার টেরাকোটা মন্দিরে রামায়ণ' প্রকাশিত হয়েছে।


 বইটি ডাক যোগে সংগ্রহ করতে হলে যোগাযোগ করুন :  9038130757 এই নম্বরে। 

কলকাতার কলেজস্ট্রিটের মোড়ে দুই মোহিনীমোহন কাঞ্জিলালের কাপড়ের দোকানের মাঝের রাস্তা ১৫, শ্যামাচরণ দে স্ট্রিটের উপর অবস্থিত বিদ্যাসাগর টাওয়ারের দু'তলায় 'রা প্রকাশনে'র দোকান। ওখান থেকে বইটি সংগ্রহ করতে পারেন। কোনও অসুবিধা হলে উপরোক্ত নম্বরে ফোন করতে পারেন।