উত্তরবাহিনী মন্দির, শিয়াখালা, চণ্ডীতলা, হুগলি
শ্যামল কুমার ঘোষ
উত্তরবাহিনী হুগলি জেলার শিয়াখালা পল্লির বিখ্যাত ও বহু শতাব্দীর এক প্রাচীন লৌকিক দেবী। শিয়াখালার পূর্বের নাম ছিল শিবাক্ষেত্র। দেবীর মূর্তি বেশ সুশ্রী, দীর্ঘাঙ্গী, উচ্চতায় ৬ / ৭ ফুট এবং বলিষ্ঠ চেহারা। বর্ণ রক্তাভ হলুদ, মাথায় এলোকেশের উপর মুকুট, ত্রিনয়ন, নাকে নথ, গলায় মুণ্ডমালা ও নানা প্রকার হার, ডান হাতে খড়্গ, বাম হাতে রুধির পাত্র। পরিধানে বক্ষবন্ধনী, সোনালী জরির কাজ করা রক্ত বর্ণের শাড়ি কটিদেশ থেকে পদতল পর্যন্ত বিস্তৃত। হিন্দুস্থানী মেয়েরা যে ধরনের হার, চুড়ি, মল ব্যবহার করেন দেবীর গায়ে সেই রকম অলংকারাদি। দেবীর বাম পা জোড় হাতে উপবিষ্ট বটুক ভৈরবের মাথায় এবং ডান পা শায়িত মহাকালরূপী শিবের বুকের উপর স্থাপিত। শায়িত শিবের নাভিদেশের উপর একটি অসুরের মুণ্ড।
পূর্বে দেবীর মূর্তি ছিল মাটির, বর্তমানে মূর্তিটি পাথরের। বাংলার কোন লৌকিক দেবীর এত বড় পাথরের মূর্তি ( ৬/৭ ফুট ) দেখা যায় না। স্থানীয় ভক্তদের চেষ্টায় কাশীর ভাস্কর দ্বারা উত্তরবাহিনীর এই পাথরের মূর্তি তৈরি করা হয়। এই মূর্তি নির্মাণে স্থানীয় চিকিৎসক যামিনীকান্ত রায়ের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। দেবীর আদি মূর্তিটি ছিল পাথরের, আকারে খুবই ছোট। তাই বড় মূর্তি তৈরি করার প্রয়োজন হয়। এই রকম ছোট মূর্তিকে ভোগমূর্তি বলে।
উত্তরবাহিনী দেবীর বহুকাল পূর্বেও খ্যাতি ছিল তা জানা যায় মধ্যযুগে রচিত মঙ্গলকাব্য থেকে। রূপরামের ধর্মমঙ্গলে আছে -
"শ্মশানে বন্দিলাম শ্যামা করালবদনী।
সেইখালায় বন্দিলাম উত্তর-বাহিনী।। "
উত্তরবাহিনীর প্রাচীনত্বের বিষয়ে জানা যায়, হুগলি জেলার এই অংশ খ্রি: ষোড়শ শতাব্দীতেও গভীর জঙ্গলে ঢাকা ছিল এবং অধিবাসীরা ছিলেন অনুন্নত শ্রেণীর। তাঁরা ভীষণ প্রকৃতির ও দুর্ধর্ষ যোদ্ধা ছিলেন। তাঁরা রাজশক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। সেই সময় বাংলার শাসক ছিলেন সুলতান হোসেন শাহ। তাঁর উজির ছিলেন শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল রচয়িতা গোপীনাথ বসু বা পুরন্দর খাঁ। যুদ্ধ বিষয়ে তিনি ছিলেন দক্ষ। তিনি শিয়াখালা অঞ্চলের সেই আদিবাসীদের দমন করেন। সে কারণে পুরন্দর খাঁ এই অঞ্চল সুলতানের কাছ থেকে 'জায়গীর' হিসাবে পান এবং শিয়াখালায় নিজের প্রাসাদ ও উত্তরবাহিনী দেবীর মন্দির তৈরি করেন।
দেবীর উৎপত্তি সম্পর্কে জনশ্রুতি, এই শিয়াখালা গ্রামে এক শাণ্ডিল্য গোত্রীয় এক ব্রাহ্মণ বাস করতেন। তাঁর এক বিদ্যাবিমুখ পুত্র সন্তান ছিল। লেখাপড়ায় তাঁর মন ছিল না। একদিন সেই ব্রাহ্মণ রেগে গিয়ে তাঁর গৃহিণীকে আদেশ দিলেন যে ছেলেকে ভাত দেওয়ার পরিবর্তে থালায় করে যেন ছাই পরিবেশন করা হয়। স্বামীর কথা শুনে স্ত্রী ছেলেকে ভাতের পরিবর্তে সত্য সত্যই ছাই পরিবেশন করেন। এই দেখে ওই ব্রাহ্মণ সন্তান রাগে-দুঃখে নিজের জীবন বিসর্জন দিতে পাশের কৌশিকী নদীতে ঝাঁপ দেন। ঝাঁপ দেওয়ার পর জলের মধ্যে তাঁর হাতে একটি বস্তু ঠেকে। জলের উপরে তুলে তিনি দেখেন, সেটি একটি পাথরের ক্ষুদ্রকায় এক দেবী মূর্তি। এই সময় তিনি একটি দৈব্যবাণী শোনেন, "আমি দেবী বিশালাক্ষী, উত্তরবাহিনী নামে আমাকে এখানে তুই প্রতিষ্ঠা কর এবং আমার নিয়মিত পূজা-অর্চনার ব্যবস্থা কর।" দৈব্যবাণী শুনে ওই ব্রাহ্মণ সন্তান পাশেই একটি চালা ঘর তৈরি করে দেবী মূর্তিটি প্রতিষ্ঠা করে পূজা-অর্চনা শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে সেই ব্রাহ্মণ সন্তান এক সর্বজ্ঞ পণ্ডিত হয়ে ওঠেন।
উত্তরবাহিনীর বর্তমান মন্দিরটি উঁচু ভিত্তিবেদির উপর স্থাপিত, উত্তরমুখী, পাঁচখিলানবিশিষ্ট একটি দালান। মন্দিরের সামনে বড় বড় থামবিশিষ্ট চাঁদনি আকৃতির নাটমন্দির বর্তমান। তবে মন্দির ও নাটমন্দির এখনো সম্পূর্ণ হয় নি।
বর্তমানে যে পাথরের মূর্তিটি মন্দিরে স্থাপিত সেটি ১৩৪০ বঙ্গাব্দের ১৬ই আষাঢ় প্রতিষ্ঠা করা হয়। তাই ১৬ই আষাঢ় মন্দিরে ব্যৎসরিক উৎসব পালন করা হয়। দেবীর নতুন ঘট প্রতিষ্ঠিত হয় শারদীয়া শুক্লা একাদশী তিথিতে। আষাঢ় মাসের ১৬ ও ১৭ তারিখ দুইদিন ব্যৎসরিক উৎসব উপলক্ষ্যে মন্দিরে অসংখ্য ভক্তের সমাগম হয়। উত্তরবাহিনীর ভোগ গ্রহণের জন্য শিয়াখালা ও আশেপাশের গ্রামের মানুষ ছাড়াও দূরদূরান্ত থেকেও বহু মানুষ মন্দিরে ভিড় করেন। এই উপলক্ষ্যে মন্দির চত্বরে মেলা বসে। আলোকমালায় সজ্জিত হয় মন্দির।
উত্তরবাহিনী - ১
মন্দির ও নাটমন্দির
উত্তরবাহিনী - ২
উত্তরবাহিনী - ৩ কী ভাবে যাবেন ?
হাওড়া স্টেশন থেকে বর্ধমান কর্ড লাইনের ট্রেন ধরে বারুইপাড়া স্টেশনে নামুন। সেখান থেকে টোটো ধরে শিয়াখালার মন্দির।
সহায়ক গ্রন্থ :
১) বাংলার লৌকিক দেবতা : গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসু
------------------------------------
------------------------------------
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন