দুৰ্গেশ্বর / মোটা শিব মন্দির, মহম্মদ রমজান লেন, নিমতলা, কলকাতা
শ্যামল কুমার ঘোষ
কলকাতার নিমতলা অঞ্চলে ১৬, মহম্মদ রমজান লেনে দুৰ্গেশ্বর শিব মন্দির অবস্থিত। উঁচু ভিত্তিবেদির উপর স্থাপিত, অলিন্দবিহীন, পশ্চিমমুখী মন্দিরটি আটচালা শৈলীর। মন্দিরটি আয়তনের তুলনায় অত্যাধিক উচ্চতাসম্পন্ন। উচ্চতার কারণ গর্ভগৃহে প্রতিষ্ঠিত বিশালাকায় শিবলিঙ্গ। শিবলিঙ্গের এই বিশাল আকারের জন্য স্থানীয় মানুষের কাছে এই শিবলিঙ্গটি 'মোটা শিব' নামে পরিচিত। মন্দিরটি দৈর্ঘ্যে ৮.৬ মিটার, প্রস্থে ৭ মিটার ও উচ্চতায় আনুমানিক 15 মিটার। কালের প্রবাহে মন্দির-শীর্ষে বট গাছ জন্মেছে। পূর্ব দিকের দেওয়ালে সেই বটের ঝুড়ি নেমেছে। মন্দিরে আগে কিছু পঙ্খ ও টেরাকোটা অলংকরণ ছিল। তবে এখন তার কিছুই অবশিষ্ট নেই।
মন্দিরের তিনটি প্রবেশদ্বার। উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে। দক্ষিণ দিকের প্রবেশদ্বার দিয়ে প্রবেশ করা যায় না। মন্দিরটি ১৭১৬ শকাব্দে বা ১২০১ বঙ্গাব্দে বা ১৭৯৪ খ্রীষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত। প্রতিষ্ঠা করেন হাটখোলার দত্ত পরিবারের মদন মোহন দত্তের দুই পুত্র রসিকলাল দাস দত্ত ও হরলাল দাস দত্ত। পশ্চিম দিকের প্রবেশপথের উপরে একটি প্রতিষ্ঠাফলক আছে। প্রতিষ্ঠাফলকের পথ নিম্নরূপ :
" অঙ্গৌষধীশ ধরণীধর
শীতরশ্মি। প্রখ্যাত শাক
সময়ে পিতৃরাজ্ঞয়ৈতত্
সংস্থাপিতং মদনমোহন
দত্ত পুত্রৈ দুৰ্গেশ্বরাখ্যা শিব
লিঙ্গমভূত সূসৌধে।। ১৭১৬ "
এখানে মদন মোহন দত্তের সম্পর্কে কিছু কথা উল্লেখ করি : হাটখোলার দত্ত বংশের রামচন্দ্রের ছিল পাঁচ পুত্র - কৃষ্ণচন্দ্র, মানিক্যচন্দ্র, ভারতচন্দ্র, শ্যামচন্দ্র ও গোরাচাঁদ। জ্যেষ্ঠ কৃষ্ণচন্দ্রের চার পুত্র - মদনমোহন, রামশঙ্কর, রামকান্ত ও রামলাল। দত্ত পরিবারের মদনমোহন দত্তের নাম ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয়। তিনি ছিলেন সভ্রান্ত জমিদার, ব্যাঙ্কিং ব্যবসায়ী ও কয়েকটি জাহাজের মালিক। এঁরই সাহায্যে ছাতু বাবু ও লাটু বাবুর পিতা রামদুলাল দে সাধারণ অবস্থা থেকে বিপুল সম্পদের মালিক হতে পেরেছিলেন। মদনমোহন অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি ছিলেন। আমতা, মেদিনীপুর, ঢাকা ও অন্যান্য স্থানে তিনি পুষ্করিণী ও কূপ খনন করে দিয়ে ছিলেন। অনেক গুলি শিবমন্দিরও নির্মাণ করে ছিলেন। গয়ার প্রেতশিলা পাহাড়ে চূড়া প্রর্যন্ত ওঠার জন্য সিঁড়ি করে দিয়ে ছিলেন। তিনি এই মন্দিরের কাছেই ২, দত্তপাড়া লেনে বাড়ি করেন। সেই বাড়িতে এখনও প্রতি বছর দুর্গা পূজা অনুষ্ঠিত হয়।
মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রতিষ্ঠিত বিশালাকায় শিবলিঙ্গটির উচ্চতা প্রায় ২.৫ মিটার। শিবলিঙ্গের মাথায় জল ঢালবার জন্য সিঁড়ি আছে। কষ্টিপাথরে নির্মিত শিবলিঙ্গটির একেবারে নিচে পশ্চিম দিকের গায়ে যে দু' লাইন লিপি খোদিত আছে তার পাঠ নিম্নরূপ :
" শ্রীরসিকলাল দাস দত্ত ঃ
শ্রীহরলাল দাস দত্ত। সন ১২০১ সাল "
এ ছাড়া দক্ষিণ দিকে আর একটি যে লিপি খোদিত আছে তার পাঠ : " শ্রীগদাধর দাস ভাস্কর। " সম্ভবত ইনিই শিবলিঙ্গটির শিল্পী-কারিগর। তবে শিল্পীর নাম থাকলেও তাঁর নিবাস সম্পর্কে কোনও উল্লেখ নেই।
মন্দিরটি সকল-সন্ধ্যায় খোলা থাকে। বাবার মাথায় জল ঢালার সময় ভোর ৫ টা থেকে সকাল ৬ টা পর্যন্ত এবং সকাল ৭ টা ৩০ মিনিট থেকে দুপুর ১২ টা ১৫ মিনিট পর্যন্ত। মন্দিরে প্রতিদিন শিবলিঙ্গের মাথায় জল ঢালবার জন্য ভিড় হয়। পূর্ণার্থীরা তাঁদের মনস্কামনায় জন্য মন্দিরে ঢিল বাঁধে। পূর্ব দিকের দেওয়ালে বটের ঝুড়িতে এ রকম অনেক ঢিল-বাঁধা দেখা যায়।
মন্দিরটি পরিদর্শনের তারিখ : ১৭.১২.২০২১
দুৰ্গেশ্বর শিব মন্দির |
মন্দিরের প্রতিষ্ঠাফলক |
শিবলিঙ্গের গায়ের লিপি - ১ |
শিবলিঙ্গের গায়ের লিপি - ২ |
দুৰ্গেশ্বর শিবলিঙ্গ - ১ |
দুৰ্গেশ্বর শিবলিঙ্গ - ২ |
দুৰ্গেশ্বর শিবলিঙ্গের পূজার্চনা |
মনস্কামনায় ঢিল বাঁধা |
সহায়ক গ্রন্থ :
১) কলকাতার মন্দির-মসজিদ : তারাপদ সাঁতরা
২) কলকাতার বাবু বৃত্তান্ত : লোকনাথ ঘোষ
কলকাতার অন্যান্য মন্দির সম্বন্ধে জানতে নিচের লিংকে ক্লিক করুন / লিংকের উপর আঙুল দিয়ে টোকা দিন :
-------------------------------------------
--------------------------------------------
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন