প্রসন্নময়ী কালী মন্দির, গোবরডাঙ্গা, উত্তর ২৪ পরগনা
শ্যামল কুমার ঘোষ
শিয়ালদহ-বনগাঁ রেলপথের একটি স্টেশন গোবরডাঙ্গা। রেলপথে কলকাতা থেকে দূরত্ব ৫৭ কিমি। গোবরডাঙ্গা উত্তর ২৪ পরগণা জেলার একটি পৌর শহর। এখানকার প্রসন্নময়ী কালী বিশেষ জাগ্রতা দেবী। এই প্রসন্নময়ী কালী মূর্তি ও মন্দির প্রতিষ্ঠার একটি কাহিনী আছে।
পূর্বে নদিয়া জেলা, পরবর্তী কালে যশোহর জেলা ও বর্তমানে উত্তর ২৪ পরগণার গোবরডাঙ্গা গ্রামের জমিদার বংশের প্রতিষ্ঠা করেন খেলারাম মুখোপাধ্যায়। তাঁর দুই বিবাহ। প্রথমা স্ত্রী যশোহর জেলার ক্ষেত্রপাড়া গ্রামের আনন্দময়ী দেবীর গর্ভে জন্মলাভ করেন বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়। বৈদ্যনাথ বাবু নিঃসন্তান অবস্থায় ইং ১৮২২ সালে পরলোক গমন করেন। খেলারাম মুখোপাধ্যায়ের দ্বিতীয়া স্ত্রী নদিয়া জেলার ধর্মদহ গ্রামের দ্রৌপদী দেবীর গর্ভে কোন পুত্রসন্তান না হওয়ায় তিনি খুবই মনঃকষ্টে ছিলেন। সেই সময় এক সন্ন্যাসী এসে তাঁকে কালীমাতার একটি ফল দৈব ওষুধ হিসাবে ধারণ করতে বলেন। ওই ওষুধ ধারণের ফলে দ্রৌপদী দেবীর ইং ১৭৯৪ সালে একটি পুত্রসন্তান লাভ করেন। কালী মাতা প্রসন্ন হয়ে এই পুত্রসন্তান দেওয়ায় সেই পুত্রের নাম রাখা হয় কালীপ্রসন্ন। কালীমাতার প্রসাদে পুত্রসন্তান লাভ করায় খেলারাম মুখোপাধ্যায় এই কালীমূর্তি ও তৎসহ কালীমন্দির স্থাপনে উদ্যোগী হন। কিন্তু মন্দির নির্মাণ কার্য শেষ হওয়ার আগেই খেলারামের মৃত্যু হলে কালীপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায় মন্দির নির্মাণ কার্য শেষ করেন। বাংলা ১২২৯ সনের ( ১৮৮৮ খ্রীষ্টাব্দ ) ১ লা বৈশাখ এই প্রসন্নময়ী কালীমন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই থেকে মুখোপাধ্যায় বংশের প্রত্যেক পুরুষের নামের সঙ্গে 'প্রসন্ন' শব্দ যুক্ত করা হয়। উঁচু ভিত্তিবেদির উপর প্রতিষ্ঠিত, দক্ষিণমুখী মন্দিরটি একটি দালান। সামনে রোয়াক। গর্ভগৃহে শ্বেত পাথরের বেদির উপর শায়িত শিবের উপর দণ্ডায়মানা প্রায় ২.৫ ফুট উঁচু কষ্টি পাথরের সুন্দর কালিকা মূর্তি প্রতিষ্ঠিত। শায়িত শিব শ্বেত পাথরে নির্মিত। দেবী নানারূপ সোনা-রুপোর অলংকারে ভূষিতা। দেবীর নিত্যভোগ ও সন্ধ্যারতি ছাড়াও প্রতি বৎসর নববর্ষে, শারদীয়া অষ্টমী তিথিতে ও কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে সাড়ম্বরে পূজাপাঠ ও প্রতি শনি-মঙ্গলবারে বিশেষ পূজা অনুষ্ঠিত হয়। উৎসব উপলক্ষ্যে আশেপাশের বিভিন্ন জায়গা থেকে অনেক লোকের সমাগম হয়। শনি-মঙ্গলবারে অনেকে মানসিক-পূজাও দিয়ে থাকেন।
মন্দিরের চৌহদ্দির মধ্যে উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত দুটি সারিতে পূর্বমুখী ছয়টি ও পশ্চিমমুখী ছয়টি মোট বারোটি আটচালা শিবমন্দির আছে। প্রতিটি মন্দিরে শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত ও নিত্য পূজিত। এছাড়া ফাল্গুন মাসে শিবরাত্রি ও চৈত্র মাসে গাজন উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।
পূর্বে ১ লা বৈশাখ প্রসন্নময়ী কালীমন্দির প্রাঙ্গণে গোষ্ঠ উৎসব পালন করা হত। এটা ছিল মুখোপাধ্যায় বংশ প্রবর্তিত একটি প্রাচীন উৎসব। আগে এই উৎসব উপলক্ষ্যে চারদিক ঘেরা একটি স্থানে একটি গাভি ও একটি শূকর শাবককে ছেড়ে দিয়ে পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধ করতে উৎসাহিত করা হত। যতক্ষণ পর্যন্ত না গাভিটি শূকর শাবককে আক্রমণ করত ততক্ষণ এই খেলা চলত। এই আমোদ দেখতে বহু লোকের সমাগম হত এবং এই উপলক্ষ্যে মেলা বসত। বহুদিন হল এই খেলাটি বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু মেলাটি এখনো চালু আছে।
গোষ্ঠ উৎসব উপলক্ষ্যে ১ লা বৈশাখ যমুনা নদীর তীরে ও মুখোপাধ্যায় বাড়ির সামনে এই মেলা বসে। অবশ্য চৈত্র সংক্রান্তির দিন থেকেই মেলা শুরু হয়। বর্তমানে মুখোপাধ্যায় বাড়ির সামনের এই মেলায় মূলত বিভিন্ন রকমের মশলার বেচাকেনা হয়। কিন্তু মেলার নাম গোষ্ঠ মেলাই রয়ে গেছে। অবশ্য লোক মুখে এটি 'মশলা মেলা' নামেও পরিচিত। মেলায় বহু মানুষের সমাগম হয়। জমিদারির আমল থেকে বিক্রেতাদের কাছ থেকে যে খাজনা আদায় করা হয় তা প্রসন্নময়ী কালীর সেবা-পূজায় ব্যয় করা হয়।
মন্দিরটি পরিদর্শনের তারিখ : ১৯.১০.২০১৫
 |
| প্রসন্নময়ী কালীমন্দির, গোবরডাঙ্গা |
 |
| প্রসন্নময়ী কালীমাতা - ১ |
 |
| প্রসন্নময়ী কালীমাতা - ২ |
কী ভাবে যাবেন ?
শিয়ালদহ-বনগাঁ রেলপথের গোবরডাঙ্গা স্টেশনে নামুন। স্টেশন থেকে টোটো বা ভ্যান-রিকশায় পৌঁছে যান প্রসন্নময়ী কালীমন্দির।
তথ্য সূত্র :
১) কুশদহ, জ্যৈষ্ঠ, ১৩১৭
২) পশ্চিমবঙ্গের পূজা পার্বণ ও মেলা ( তৃতীয় খণ্ড )
********
গোবরডাঙ্গার মুখোপাধ্যায় পরিবারের ইতিহাস সম্বন্ধে জানতে নিচের লিংকে ক্লিক করুন :
পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য কালী মন্দির সম্বন্ধে জানতে নিচের লিংকে ক্লিক করুন / লিংকের উপর আঙুল দিয়ে টোকা দিন :
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন