শ্রীশ্রী অম্বিকা সিদ্ধেশ্বরী মহামায়া মন্দির, অম্বিকা কালনা, পূর্ব বর্ধমান
শ্যামল কুমার ঘোষ
অম্বিকা কালনার 'জোড়বাংলা' শৈলীর একমাত্র মন্দিরটি হল শ্রী শ্রী অম্বিকা সিদ্ধেশ্বরী মহামায়ার। এই দেবীকে অনেকেই মনে করেন যে ইনি জৈনদেবী। আর তাঁরই নামানুসারে হয় শহর অম্বিকা কালনার নামকরণ। পূর্বে 'অম্বিকা' ও 'নিজ কালনা' নামে দুটি আলাদা অঞ্চল ছিল। পরবর্তী কালে স্থান দুটি একীকরণ করে নাম হয় 'অম্বিকা-কালনা'। সাধারণের কাছে এই দেবী 'সিদ্ধেশ্বরী কালী' নামে পরিচিত হলেও মন্দিরের প্রবেশদ্বারের উপরে যে শ্বেতপাথরের ফলক লাগানো আছে তাতে দেবীকে ওই পূর্বোক্ত নামেই অভিহিত করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠা কাল দেওয়া আছে ৬৮৮ শকাব্দ। ইঁটের তৈরী, দক্ষিণমুখী এই মন্দিরটি সিদ্ধেশ্বরী মোড়ের কাছে অবস্থিত। মন্দিরের সামনে একটি প্রতিষ্ঠা-লিপি থাকলেও বার বার দেওয়া রঙের প্রলেপে তা ভীষণ অস্পষ্ট। তবে পূর্বে উদ্ধারীকৃত লিপিটির পাঠ হল ঃ
" শুভমস্তু শকাব্দা ১৬৬১/২/২৬/৬ শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী দেবীং শ্রীযুক্ত মহারাজা চিত্রসেন রায়স্য। মিস্ত্রি শ্রীরামচন্দ্র "
অতএব লিপি থেকে জানা যায় যে রাজা চিত্রসেন ১৬৬১ শকাব্দে ( ১৭৩৯ খ্রীষ্টাব্দে ) এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। মন্দিরের মিস্ত্রি ছিলেন শ্রীরামচন্দ্র। মন্দিরের সামনে ত্রিখিলান অলিন্দ। খিলানগুলির উপরে আছে টেরাকোটার প্রতীক শিবমন্দির ও তার মধ্যে শিবলিঙ্গ। পোড়ামাটির কয়েকটি ফুলও আছে। কিন্তু বার বার দেওয়া রঙের প্রলেপে টেরাকোটার কাজ খুবই অস্পষ্ট।
কথিত আছে, অম্বরীশ ঋষি বর্তমান মন্দিরের অনতিদূরে পশ্চিমদিকে অম্বিকা-পুকুর নামে কথিত পুকুরের এক কোণে বটগাছের তলায় পাথরের কুলোর উপর জমাটবদ্ধ একটি ঘট পান। ( কুলো সমেত ঘটটি মন্দিরে রক্ষিত আছে। ) জায়গাটি ছিল গভীর অরণ্যে পরিপূর্ণ। তিনি ঐ ঘটকে বর্তমান মন্দির যে স্থানে অবস্থিত সেখানে বটগাছের তলায় প্রতিষ্ঠা করে সাধনা করেন এবং সিদ্ধিলাভ করেন। তখন মূর্তি ছিল না। ৪/৫ পুরুষ শিষ্য পরম্পরায় সেবাকার্য চলে। শেষ সাধক ঈশ্বরীশ। তিনি দেবীর স্বপ্নাদেশে মূর্তি তৈরি করান। নিমগাছের একটি কাষ্ঠখণ্ডেই মূর্তি তৈরি। ছোট বহরকুলির গাঙ্গুলীদের পুকুরপাড়ের যে তিনটি নিমগাছ ছিল তার মাঝেরটি দিয়ে কলকাতার নিমতলায় দারুশিল্পীকে দিয়ে মূর্তি তৈরি করানো হয় এবং পঞ্চমুণ্ডির আসনের উপর বসানো হয়। এর পিছনে ছিল গঙ্গা ও শ্মশান। এখানে নরবলির প্রথা ছিল। এখনও নরবলির বিকল্পে ডাব বলি দেওয়া হয়। মূর্তিটি জীর্ণ হলে অম্বিকা-পুকুরে বিসর্জন দেওয়া হয়। বর্তমান মূর্তিটি এবং মন্দিরটি দ্বিতীয় সংস্করণ। রাজা চিত্রসেন প্রতিমা দর্শন করতে এলে মন্দির থেকে পাথরের চাঁই খসে পরে। রাজা মন্দিরটিকে সংস্কার করান। অনেকে বলেন রাজা নতুন করে মন্দির নির্মাণ করান। ঈশ্বরীশের কোন শিষ্য ছিল না। স্বপ্নাদেশে তিনি সাতগাছিয়ার চাটুজ্জে বাড়ির একটি ছেলেকে আনেন। সেই ছেলেই ঠাকুর সেবার অধিকার পান। তাই পদবি হয় অধিকারী। তখন থেকেই বংশানুক্রমে দেবীর সেবাকার্য চলে আসছে।
মন্দিরটি উঁচু ভিত্তিবেদির উপর প্রতিষ্ঠিত। মন্দিরটিতে উঠবার জন্য আটটি ইঁটের ঢেউখেলানো সিঁড়ি ও একটি পাথর বসানো সিঁড়ি আছে। এই জোড়বাংলা রীতির মন্দিরটির ভিত্তিক্ষেত্ৰ ২৭ ফুট ( ৮.২ মি. ) x ১০ ফুট ( ৩ মি. )। ভিত্তিবেদির উপর এর উচ্চতা ১৫ ফুট ( ৪.৬ মি. )। মন্দিরবাড়িটি পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। প্রবেশদ্বারের মাথায় রয়েছে একটি দণ্ডায়মান সিংহ। গর্ভগৃহের প্রবেশদ্বারের মাথায়ও রয়েছে দণ্ডায়মান জোড়া সিংহ। যাদের একটি করে পা উপরে তোলা।
মূর্তিটি দারুনির্মিত। চতুর্ভুজা। দক্ষিণ দুই হস্তে বরাভয় মুদ্রা। বামের ঊর্ধ্বহস্তে খর্পর, নিম্নহস্তে নরমুণ্ড। দেবীর বামপদ এগিয়ে। তাই তিনি বামাকালী। উচ্চতা প্রায় ৫ ফুট ৬ ইঞ্চি ( ১.৭ মি. )। দেবী দারুনির্মিত হলেও শিবের মূর্তিটি কিন্তু দারু নির্মিত নয়।
মা সিদ্ধেশ্বরীর প্রতি বছর অঙ্গরাগ হয়। অঙ্গরাগ শুরু হয় বার্ষিকী পূজার অর্থাৎ কার্তিকী অমাবষ্যার ১০ দিন আগে। তখন মন্দির বন্ধ থাকে। ঘটে পুজো হয়। ভূতচতুর্দশীতে অর্থাৎ দেওয়ালির আগের দিন দেবীর দিগম্বরী বেশ জনসমক্ষে দেখানো হয় সন্ধ্যা ৭ টা থেকে রাত ১২ টা পর্যন্ত। তারপর বস্ত্র পরিয়ে হয় দেবীর পূজা। বাৎসরিক পূজায় বলিদান হয়। পূজা হয় তন্ত্র মতে।
মন্দিরের পূর্ব দিকে সারিবদ্ধভাবে রয়েছে চারটি শিবমন্দির। এদের মধ্যে তিনটি 'আটচালা' রীতির। এদের মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৬৬৮ শকাব্দে ( ১৭৪৬ খ্রীষ্টাব্দে )। প্রতিষ্ঠা করেন তিলকচন্দ্রের অমাত্য রামদেব নাগ। রাজা তিলকচন্দ্রের মাতা লক্ষ্মীকুমারী দেবী যে শিবমন্দিরটি নির্মাণ করেন তার প্রতিষ্ঠাকাল ১৬৮৫ শকাব্দ ( ১৭৬৩ খ্রীষ্টাব্দ )।
মন্দিরটি পরিদর্শনের তারিখ : ০১.০৭.২০১৬
অম্বিকা কালনার এই মন্দিরে যেতে হলে শিয়ালদহ থেকে সকাল ৮ টা ৬ মিনিটের কাটোয়া লোকাল বা হাওড়া থেকে কাটোয়া লোকাল ধরুন। ব্যাণ্ডেল থেকেও অম্বিকা কালনা যাওয়ার গাড়ি পাবেন। স্টেশন থেকে রিকশা বা টোটোতে মন্দিরে পৌঁছে যান। নদিয়া জেলার শান্তিপুর থেকেও গঙ্গা পেরিয়ে কালনায় যেতে পারেন।
সহায়ক গ্রন্থাবলি :
১) কালনা মহকুমার প্রত্নতত্ত্ব ও ধর্মীয় সংস্কৃতির ইতিবৃত্ত : বিবেকানন্দ দাস
২) বাংলার মন্দির স্থাপত্য ও ভাস্কর্য : প্রণব রায়
মন্দিরের প্রবেশ-দ্বারের উপরের সিংহ মূর্তি |
সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির |
মন্দিরের সামনের ত্রিখিলান বিন্যাস |
মন্দিরের প্রতিষ্ঠাফলক |
গর্ভগৃহের সামনের জোড়া সিংহ |
সিদ্ধেশ্বরী কালী মাতা - ১ |
সিদ্ধেশ্বরী কালী মাতা - ২ |
শিবমন্দির |
অম্বিকা কালনার এই মন্দিরে যেতে হলে শিয়ালদহ থেকে সকাল ৮ টা ৬ মিনিটের কাটোয়া লোকাল বা হাওড়া থেকে কাটোয়া লোকাল ধরুন। ব্যাণ্ডেল থেকেও অম্বিকা কালনা যাওয়ার গাড়ি পাবেন। স্টেশন থেকে রিকশা বা টোটোতে মন্দিরে পৌঁছে যান। নদিয়া জেলার শান্তিপুর থেকেও গঙ্গা পেরিয়ে কালনায় যেতে পারেন।
সহায়ক গ্রন্থাবলি :
১) কালনা মহকুমার প্রত্নতত্ত্ব ও ধর্মীয় সংস্কৃতির ইতিবৃত্ত : বিবেকানন্দ দাস
২) বাংলার মন্দির স্থাপত্য ও ভাস্কর্য : প্রণব রায়
********
পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য কালী মন্দির সম্বন্ধে জানতে নিচের লিংকে ক্লিক করুন / লিংকের উপর আঙুল দিয়ে টোকা দিন :
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন