লালজী মন্দির, রাজবাড়ি মন্দির চত্বর, অম্বিকা কালনা, বর্ধমান
শ্যামল কুমার ঘোষ
অম্বিকা কালনার রাজবাড়ি মন্দির চত্বরের উত্তর-পশ্চিম কোণে অবস্থিত লালজী মন্দির। মন্দিরটি পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। এই মন্দির ও সিদ্ধেশ্বরীর 'জোড়বাংলা' একই বছরে প্রতিষ্ঠিত। বর্ধমানের মহারাজা কীর্তিচন্দ্রের মাতা রাজকুমারী ব্রজকিশোরী ১৬৬১ শকাব্দে ( ১৭৩৯ খ্রিস্টাব্দে ) এই বিশাল মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। উঁচু ভিত্তিবেদির উপর স্থাপিত, ইঁটের তৈরি, দক্ষিণমুখী, চারতলাবিশিষ্ট, লালজীর বিশাল পঁচিশরত্ন মন্দির আয়তন ও গাম্ভীর্যের দিক থেকে অসাধারণ। পশ্চিমবঙ্গে এই শৈলীর মন্দিরের সংখ্যা মাত্র পাঁচ। তার মধ্যে দুটি হুগলি জেলার সুখাড়িয়ার আনন্দময়ী কালীমন্দির ও বাঁকুড়া জেলার সোনামুখীর শ্রীধর মন্দির এবং বাকি তিনটি অম্বিকা কালনার কৃষ্ণচন্দ্রের মন্দির, লালজী মন্দির ও গোপালজীর মন্দির। ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দের কিছু পূর্বে রচিত দীনবন্ধু মিত্র তাঁর সুরধুনী কাব্যে ( ১ ম খণ্ড ) এই মন্দিরে লালজী প্রতিষ্ঠার ইতিহাস বর্ণনা করেছেন।
মন্দিরটির প্রথম তলের ছাদের চার কোণে যে খাঁজের সৃষ্টি হয়েছে তাতে তিনটি করে, দুটি চূড়া সমমাপে এগোনো, মাঝেরটা একটু পিছানো, মোট ১২ টি চূড়া স্থাপিত। তারপর বেড় কমিয়ে খানিকটা উপরে অষ্টকোণাকৃতি ২য় তল সৃষ্টি করা হয়েছে। তার ছাদে আটকোণে মোট ৮ টি চূড়া। এরপর বেড়ের উচ্চতা কমিয়ে ২য় তলের চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম উচ্চতায় ৩য় তল সৃষ্টি করা হয়েছে। তার চার কোণে ৪ টি এবং মাঝে একটি বড় চূড়া। অর্থাৎ চূড়াগুলির সজ্জা হচ্ছে ১২+৮+৪+১ । মোট চূড়ার সংখ্যা পঁচিশ এবং উপরের তলের চূড়া ধরে মোট চারতলা। এই চূড়াগুলি চারকোণা এবং তাদের ছাদ উঁচু-নিচু কার্নিসের বিন্যাসে কিছুটা পীড়া শিখরের অনুরূপ।
মন্দিরের সামনে সন্নিবদ্ধ রয়েছে একটি 'একবাংলা ' মণ্ডপ। মণ্ডপটির মাথায় লম্বা একটি মটকা বাঁধা যা গ্রাম বাংলার খোড়ো চালের কথা মনে করিয়ে দেয়। এটি পরিদর্শন কক্ষ বা 'জগমোহন' রূপে ব্যবহৃত হয়। তবে সাধারণ দর্শনার্থীদের এখানে উঠতে দেওয়া হয় না। এর সংলগ্ন ভূমির সমতল বেদিতে আর একটি পৃথক সুবৃহৎ চারচালাবিশিষ্ট নাটমন্দির সৃষ্টি করা হয়েছে। এর চালাগুলি সুন্দর সুন্দর ইমারতি থামের ওপর স্থাপিত। সাধারণ দর্শনার্থীরা এখান থেকেই বিগ্রহ দর্শন করেন।
মন্দিরের সামনে ত্রিখিলান অলিন্দ। পূর্ব ও পশ্চিম দিকেও ত্রিখিলান অলিন্দ। পশ্চিম দিকে কোন প্রবেশ পথ নেই। পূর্ব দিকে রয়েছে একটি প্রবেশ দ্বার। পূর্ব দিকের দরজা দিয়ে গর্ভগৃহে ঢুকতেই ডান দিকে রয়েছে সিঁড়ি যা দিয়ে মন্দিরের উপরে ওঠা যায়। পিছনেও ত্রিখিলান। দুটি জানলা। এ দিকেই আছে শয়নকক্ষ। জানলার মাথায় প্রতীক শিব মন্দিরের সজ্জা ও ফুলকারি কাজ। মন্দির প্রাঙ্গণের মূল প্রবেশদ্বারের মাথার উপরে আছে একটা ছোট একবাংলা।
মন্দিরের খিলান স্তম্ভগুলিতে, চারি দেওয়ালে রয়েছে অসংখ্য টেরাকোটার কাজ ও ফুলকারি নকশা। তবে এর বেশির ভাগই নষ্ট হয়ে গেছে। ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে 'কল্পলতা' বা 'মৃত্যুলতা'কে দেওয়ালের কোণে বা গায়ে খাড়াভাবে লাগানোই প্রচলিত রীতি। এখানেও কোণের দুপাশে তা সমতলভাবে নিবদ্ধ এবং তা একতলার কার্নিস পর্যন্ত উঠে গেছে।
মন্দির-দালানে দণ্ডায়মান অবস্থ্যায় রয়েছেন রাধাকৃষ্ণ। উচ্চতা যথাক্রমে ২ ফুট ( ৬১ সেমি ) ও ১ ফুট ৬ ইঞ্চি ( ৪৬ সেমি )। লালজী বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে একটি কাহিনী আছে। এক বাউল তাঁর ঝোলায় করে লালজীর বিগ্রহ নিয়ে দেশ দেশান্তরে গান গেয়ে ফিরতেন। একদিন তিনি যখন কালনার গঙ্গাতীরে ভিক্ষালব্ধ পোড়া রুটি দিয়ে লালজীকে ভোগ দিচ্ছিলেন তখন সেই ঘাট দিয়ে বর্ধমানের রানি গঙ্গাস্নান সেরে ফিরছিলেন। তিনি বাউলের কাছ থেকে বিগ্রহ নিয়ে নিলেন। বললেন, তুমি লালজীকে দিনে মাত্র একবার খেতে দাও, তাও এই পোড়া রুটি। আমি জগন্নাথের মত দিনে বাহান্নবার ছানা-মাখন-পোলাও দিয়ে ভোগ দেব। পূর্বে রাজাদের আমলে লালজীকে দিনে ৫২ বার ৫২ রকমের ভোগ দেওয়া হত। সাধক যেমন লালজীকে ভোগ হিসাবে পোড়া রুটি নিবেদন করতেন তেমনই প্রথানুসারে বহু দিন পর্যন্ত ভোগের সঙ্গে পোড়া রুটিও লালজীকে নিবেদন করা হত।
লালজী মন্দিরে বিগ্রহের নিত্য পূজা ছাড়াও জন্মাষ্টমী, রথযাত্রা ও রাস উৎসব পালন করা হয়। মন্দিরে শারদীয়া পূজার প্রাক্কালে শ্রীকৃষ্ণের বাল্যকাল থেকে যৌবন পর্যন্ত নানা লীলাকাহিনী পঞ্চগুঁড়ির সাহায্যে অঙ্কিত করা হয়। এর নাম সাঁঝি। মন্দিরটি ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ, কলকাতা মণ্ডল দ্বারা সংরক্ষিত।
|
লালজী মন্দির ( উত্তর দিক থেকে তোলা ) |
|
মন্দিরের শিখর-দেশ ( পূর্ব দিক থেকে তোলা )
|
|
নাটমন্দিরের শিখর-দেশ |
|
একটি খিলানের উপরের কাজ |
|
মন্দিরের কোণে 'মৃত্যুলতা' - ১
|
|
মন্দিরের কোণে 'মৃত্যুলতা' - ২
|
|
মৃত্যুলতার টেরাকোটা মূর্তি - ১
|
|
মৃত্যুলতার টেরাকোটা মূর্তি - ২
|
|
মৃত্যুলতার টেরাকোটা মূর্তি - ৩
|
|
মৃত্যুলতার টেরাকোটা মূর্তি - ৪
|
|
মৃত্যুলতার টেরাকোটা মূর্তি - ৫
|
|
মৃত্যুলতার টেরাকোটা মূর্তি - ৬
|
|
মৃত্যুলতার টেরাকোটা মূর্তি - ৭
|
|
কুলুঙ্গিতে আবদ্ধ টেরাকোটা মূর্তি - ১ |
|
কুলুঙ্গিতে আবদ্ধ টেরাকোটা মূর্তি - ২ |
|
কুলুঙ্গিতে আবদ্ধ টেরাকোটা মূর্তি - ৩ |
|
কুলুঙ্গিতে আবদ্ধ টেরাকোটা মূর্তি - ১ |
|
ভিত্তিবেদি সংলগ্ন টেরাকোটা মূর্তি - ১ |
|
কৃষ্ণলীলা - ১ |
|
কৃষ্ণলীলা - ২ |
|
কৃষ্ণলীলা - ৩ |
|
টেরাকোটার ফুল |
|
লালজী ও রাধিকা বিগ্রহ -১ |
|
লালজী ও রাধিকা বিগ্রহ -২
|
লালজী ঠাকুরবাড়ির প্রবেশ-দ্বার দিয়ে ঢুকলে বাঁ দিকে পড়বে উত্তরমুখী গিরিগোবর্ধন মন্দির। মন্দিরটি ১৬৮০ শকাব্দে ( ১৭৫১ খ্রীষ্টাব্দে ) নির্মিত হয়। এটি এক নতুন স্থাপত্যশৈলী। প্রচলিত চালা রীতিতে নির্মিত না হলেও এর চালের মধ্যে চালার সাদৃশ্য আছে। চাল বড় বড় শিলার আকারে তৈরি। মাঝে মাঝে নানা মূর্তি। এর সামনে কোন ঢাকা বারান্দা নেই। শ্রীকৃষ্ণের গিরিগোবর্ধন ধারণের প্রতীক স্বরূপ এর চাল নির্মিত।
|
গিরিগোবর্ধন মন্দির |
অম্বিকা কালনার এই মন্দিরে যেতে হলে শিয়ালদহ থেকে সকাল ৮ টা ৬ মিনিটের কাটোয়া লোকাল বা হাওড়া থেকে কাটোয়া লোকাল ধরুন। ব্যাণ্ডেল থেকেও অম্বিকা কালনা যাওয়ার গাড়ি পাবেন। স্টেশন থেকে রিকশা বা টোটোতে মন্দিরে পৌঁছে যান। নদিয়া জেলার শান্তিপুর থেকেও গঙ্গা পেরিয়ে কালনায় যেতে পারেন।
মন্দিরটি পরিদর্শনের তারিখ : ০২..০৭.২০১৬
সহায়ক গ্রন্থাবলি :
১) কালনা মহকুমার প্রত্নতত্ত্ব ও ধর্মীয় সংস্কৃতির ইতিবৃত্ত : বিবেকানন্দ দাস
২) বাংলার মন্দির স্থাপত্য ও ভাস্কর্য : প্রণব রায়
*********
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন