Pages

রবিবার, ১০ জানুয়ারী, ২০১৬

Radharaman Jiu Temple, Baro Goswami Bari, Santipur

                       

     শ্রীশ্রী রাধারমণ  জিউ  মন্দির, বড়  গোস্বামী  বাড়ি, শান্তিপুর, নদিয়া

                                                             শ্যামল  কুমার  ঘোষ

              বৈষ্ণব  চূড়ামণি  শ্রীঅদ্বৈতাচার্যের  সাধনক্ষেত্র  শ্রীধাম  শান্তিপুর।  কথিত  আছে,  প্রায়  সাড়ে  পাঁচশো  বছর  আগে  পিতৃ-মাতৃ  বিয়োগের  পর  শ্রীঅদ্বৈতাচার্য  ভারত  ভ্রমণে  বেড়িয়ে  বর্তমান  নেপালের  গণ্ডকী  নদী  থেকে  এক  পবিত্র  নারায়ণ  শিলা  পান।  সেই  নারায়ণ  শিলা  তিনি  পরম  শ্রদ্ধায়  তাঁর  শান্তিপুরের  বাড়িতে  এনে  নিত্যসেবা  করতে  থাকেন।  অপ্রকট  হওয়ার  আগে  তিনি  সেই  নারায়ণ  শিলার  পূজার্চনার  ভার  তাঁর  প্রিয়  পুত্র  বলরামের  হাতে  অর্পণ  করেন।  পরে  বলরাম ওই  নারায়ণ  শিলার  পূজার্চনার  দায়িত্ব  দেন  জ্যেষ্ঠ  পুত্র  মথুরেশের  হাতে।  সেই  থেকেই  বংশ  পরম্পরায়  বড়  গোস্বামী  বাড়িতে  পূজিত  হচ্ছেন  অদ্বৈতপ্রভু  প্রতিষ্ঠিত  নারায়ণ  শিলা।  শ্রীঅদ্বৈতপ্রভুর  পৌত্র  মথুরেশ  গোস্বামীর  জ্যেষ্ঠ  পুত্র  রাঘবেন্দ্রের  বাড়ি  হিসাবে  পরবর্তী  কালে  এই  বাড়ি  'বড়  গোস্বামী  বাড়ি'  নামে  খ্যাত  হয়।

              বড়  গোস্বামী  বাড়িতে  শ্রীশ্রী রাধারমণ  বিগ্রহ  এক  দালান  মন্দিরে  প্রতিষ্ঠিত।  মন্দিরে   শ্রীশ্রী রাধারমণের  বিগ্রহের  পিছনের  পাথরে  উৎকীর্ণ  লিপির  কিছু  অংশ :  

     " পুণ্যক্ষেত্র  পুরীধামে  শ্রীদোলগোবিন্দ
     বিরাজিলে  কতকাল  বিতরি  আনন্দ,   
     বসন্ত  রায়ের  প্রেমে  যশোরাগমন ।  
     যবে  মানসিংহ  করে  রাজ্য  আক্রমণ  
     শ্রীঅদ্বৈত-পৌত্র  মথুরেশ  মহামতি 
     আনিলেন  শান্তিপুরে  এ  মোহন  মূরতি । 
     জীবেরে  করুণা  করি  শ্রীরাধারমণ 
     শ্রীরাসবিহারী  রূপে  দিলে  দরশন । "

              উৎকলীয়  ভাস্কর্যরীতির  এই  বিগ্রহটি  প্রথমে  উড়িষ্যারাজ  ইন্দ্রদ্যুম্ন  কর্তৃক  দোলগোবিন্দ  (একক  কৃষ্ণমূর্তি )  নামে  পুরীধামে  প্রতিষ্ঠিত  হয়।  যশোহর  রাজ  প্রতাপাদিত্য  তাঁর  খুল্লতাত  বসন্ত  রায়ের  আদেশে  পুরী  থেকে  সেটিকে  যশোহরে  নিয়ে  এসে  প্রতিষ্ঠা   করেন।  শান্তিপুরের  মথুরেশ  ছিলেন  এই  বিগ্রহের  পুরোহিতের  গুরু।  মানসিংহের  যশোহর  আক্রমণের  সময়  মথুরেশ  সেখানে  উপস্থিত  ছিলেন।  তিনি  বিগ্রহটিকে  শান্তিপুরে  নিয়ে  এসে  নিজগৃহে  নবরূপে  'রাধারমণ'  নামে  প্রতিষ্ঠা  করেন।  মথুরেশ  তিন  বিগ্রহ  তিন  পুত্রকে  দেন ;  শ্রীশ্রী  রাধারমণ  রাঘবেন্দ্রকে,  শ্রীশ্রী  রাধাবিনোদ  ঘনশ্যামকে  এবং  শ্রীশ্রী  রাধাবল্লভ  রামেশ্বরকে।  মুকুন্দদেবের  ( রাঘবেন্দ্র  পুত্র )  পুত্র  ব্রজকিশোরের  সময়  এই  বিগ্রহ  অপহৃত  হয়।  'কাত্যায়নী'  পূজার  অনুকরণে  সেই  সময়  বড়  গোস্বামী  বাড়িতে  দুর্গাপূজার  প্রবর্তন  হয়।  কাত্যায়ন  মুনি  সর্বাগ্রে  তাঁর  উপাসনা  করেন  বলে  এই  নাম।  দিগনগরের  ঘোলার  বিলে  অপহৃত  বিগ্রহ  পাওয়া  যায়।  কৃষ্ণনগরের  রাজবাড়িতে  নিদর্শন  দেখিয়ে  বিগ্রহ  ফিরিয়ে  এনে  পুনরায়  প্রতিষ্ঠা  করা  হয়।  গোস্বামী  পরিবারের  অনেকে  মনে  করলেন  যে  শ্রী রাধারমণ  একা  থাকার  জন্যই  অপহৃত  হন।  তাঁর  সঙ্গে  শ্রী রাধিকা  বিগ্রহ  থাকলে  হয়তো  এই  অঘটন  ঘটত  না।  ফলে  প্রায়  ৪০০০  টাকা  ব্যয়ে  তাঁর  পাশে  এক  রাধিকা  বিগ্রহের  প্রতিষ্ঠা  অনুষ্ঠান  বা  লৌকিক  বিবাহ  হয়।  দিনটা  ছিল   রাস  পূর্ণিমা।  এই  বিবাহে  শান্তিপুরের  সকল  ঠাকুরের  আগমণ  হয় । সেই  থেকেই  শান্তিপুরের  রাস-শোভাযাত্রার  সৃষ্টি  হয় ।  তার  আগে  মথুরেশের  সময়  থেকে  রাসের  প্রবর্তন  হয়।  সে  দিনের  সেই  রাস-শোভাযাত্রা  কালের  গণ্ডি  পেরিয়ে  আজকের  ভাঙ্গারাসের  শোভাযাত্রা  নামে  খ্যাত  হয়েছে।  বড়  গোস্বামী  বাড়ির  সেদিনের  শোভাযাত্রায়  অন্যতম  উদ্যোগী  হিসাবে  আয়োজনের  দায়িত্বে  ছিলেন  বড়  গোস্বামী  বাড়ির  শিষ্যকুল  তৎকালীন  খাঁ  চৌধুরী  পরিবারের  লোকজন।

              বর্গীর  হাঙ্গামার  সময়  এই  শাখার  কেউ  কেউ  শ্রীশ্রী  রাধারমণ  কে  নিয়ে  পাবনা  জেলার ( বর্তমানে বাংলাদেশ )  কাঁকুড়কাঁটা  গ্রামে  পালিয়ে  যান  এবং  পরে  হাঙ্গামা  কেটে  গেলে  পুনরায়  শান্তিপুরে  ফিরে  আসেন। 
   
              শ্রীরাধারমণ-শ্রীমতি  ছাড়াও  বড়গোস্বামী  বাড়িতে  পূজিত  হন  শ্রীঅদ্বৈতের  প্রিয়  শ্রীমদনমোহন-শ্রীমতি  সহ  বিভিন্ন  নামে  রাধাকৃষ্ণের  আরও  চারটি  যুগলমূর্তি।  এছাড়া,  জগন্নাথ-বলভদ্র-সুভদ্রা,  গোপাল,  শ্রীরামচন্দ্র,  ষড়ভুজ  মহাপ্রভু,  অদ্বৈতাচার্য-সীতাদেবী  এবং  অচ্যুতানন্দের  মূর্তিও  এখানে  নিত্য  পূজিত  হন।  রাঘবেন্দ্রপুত্র  বিষ্ণুদেব  সুপণ্ডিত  ছিলেন।  তিনি  শ্রীশ্রী  মদনমোহন  ও  শ্রীরামচন্দ্রের  মূর্তিটি  প্রতিষ্ঠা  করেন।  নদিয়ারাজ  কৃষ্ণচন্দ্র  রামচন্দ্র  বিগ্রহের  জন্য  এক  পঞ্চচূড়  রথ  ও  ৮০  বিঘা  ব্রহ্মোত্তর   জমি  দান  করেন। রাঘবেন্দ্রের  অপর  পুত্র  কালাচাঁদ   সিদ্ধ  পুরুষ  ছিলেন।  তিনি  সন্তোষের  রাজবংশের  দীক্ষাগুরু  ছিলেন।  কুচবিহার  রাজার  দেওয়ান,  পাবনার  পরদার  জমিদার  প্রভৃতি  তাঁর  শিষ্য  ছিলেন।  কালাচাঁদের  শাখার  কৃষ্ণকুমার  ভক্ত,  সাধক  ও  দিগ্বিজয়ী  পণ্ডিত  ছিলেন।  মহাপ্রভুর  ষড়ভুজ  মূর্তিটি  তিনি  স্থাপন  করেন।
   
              প্রধান  দুই  উৎসব  রাসযাত্রা  এবং  আচার্যদেবের  আবির্ভাব  তিথি  মাকড়ি  সপ্তমী  উপলক্ষে  'অদ্বৈত  উৎসব'  ছাড়াও  এখানে  বৈষ্ণব  ধর্মের  প্রতিটি  উৎসব-অনুষ্ঠান  যথোচিত  মর্যাদায়  পালিত  হয়।  এখানে  উল্লেখ্য,  শান্তিপুরে  শ্রীঅদ্বৈতাচার্য়ের  বংশধরদের  যে  বিগ্রহবাড়িগুলো  আছে  তার  মধ্যে  মধ্যম  গোস্বামী  বাড়ি  ও  বড়  গোস্বামী  বাড়িতেই  একমাত্র  দুর্গোৎসব  হয়। 
  
              শান্তিপুরের  বড়  গোস্বামী  বাড়িতে  যেতে  হলে  শিয়ালদহ  থেকে  শান্তিপুর  লোকাল  ধরুন।  রেলপথে  শান্তিপুরের  দূরত্ব  ৯৩  কি মি।  ট্রেনে  সময়  লাগে  ঘন্টা  আড়াই। স্টেশন  থেকে  রিকশায়  বা  টোটোতে  পৌঁছে  যান  বড়  গোস্বামী  বাড়ি।  ৩৪ নং  জাতীয়  সড়ক  শান্তিপুরের  ওপর  দিয়ে  গেছে।  তাই  বাসে  বা  গাড়িতেও  যেতে  পারেন। 


বড়  গোস্বামী  বাড়ির  তোরণপথ

বড়  গোস্বামী  বাড়ির  ফটক

বড়  গোস্বামী  বাড়ি 

নাটমন্দির

শ্রীশ্রী রাধারমণ  জিউ  মন্দির 

শ্রীশ্রী রাধারমণ  জিউ'র  দোল-ঝুলন  মঞ্চ 

শ্রীশ্রী রাধারমণ  জিউ'র  রাসমন্দির

শ্রীশ্রী মদনমোহন  ও  অন্যান্য  বিগ্রহ

শ্রীশ্রী মদনমোহন  বিগ্রহ

শ্রীশ্রী রাধারমণ  বিগ্রহ - ১

শ্রীশ্রী রাধারমণ  বিগ্রহ - ২

শ্রীশ্রী রামচন্দ্র  বিগ্রহ

জগন্নাথ-বলভদ্র-সুভদ্রা  বিগ্রহ 

ষড়ভুজ  মহাপ্রভু
শ্রীঅদ্বৈতাচার্য ,  সীতাদেবী  ও  অচ্যুতানন্দের  মূর্তি 


বড় গোস্বামী বাড়িতে দুর্গা ( কাত্যায়নী ) পূজা

    বড়  গোস্বামী  বাড়ি  পরিদর্শনের  তারিখ :  ০৩.০১.২০১৬

সহায়ক  গ্রন্থাবলি   : 
            ১. নদিয়া  জেলার  পুরাকীর্তি :  মোহিত  রায় ( তথ্য-সংকলন  ও  গ্রন্থনা )
            ২. রাসোৎসব - ২০১৫  উপলক্ষে  শান্তিপুর  বিগ্রহবাড়ি  সমন্বয়  সমিতি  কর্তৃক  প্রকাশিত  পুস্তিকা 
            ৩. শান্তিপুর - পরিচয় ( ২ য় ভাগ ) :  কালীকৃষ্ণ  ভট্টাচার্য 
                                                   
                                                                     *******


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন