জলেশ্বর শিব মন্দির, শান্তিপুর, নদিয়া
শ্যামল কুমার ঘোষ
শান্তিপুরের প্রাচীন মন্দির গুলির মধ্যে জলেশ্বর শিব মন্দির উল্লেখযোগ্য। মন্দিরটি মতিগঞ্জ-বেজ পাড়ায় অবস্থিত এবং অল্প-উঁচু পাদপিঠের উপর স্থাপিত। এটি দক্ষিণমুখী, অলিন্দবিহীন ও বাংলা চারচালা শ্রেণীর মন্দির। পূর্ব দিকেও আর একটি প্রবেশদ্বার আছে এবং এই প্রবেশদ্বারটিই এখন ব্যবহার করা হয়। কারণ এই দিকের কাছেই রাস্তা। উভয় প্রবেশদ্বারের খিলানের উপর প্রান্তে প্রতীক শিব মন্দিরের সারি এবং তারমধ্যে শিবলিঙ্গ উৎকীর্ণ। এ মন্দিরের গঠন কতকটা দিগনগরের রাঘবেশ্বরের মন্দিরের মত হলেও এ মন্দিরের উচ্চতা রাঘবেশ্বরের মন্দিরের চেয়ে বেশি। মাটিয়ারির রুদ্ধেশ্বর মন্দিরের সঙ্গেও এ মন্দিরের গঠন ও আকৃতির অনেক মিল আছে, তবে সেটির থেকেও এ মন্দিরের উচ্চতা অনেক বেশি। মন্দিরের দক্ষিণ দিকে একটি নাটমন্দির আছে যেটি মন্দির স্থাপনের পরবর্তী কালে নির্মিত। মন্দিরে কোন প্রতিষ্ঠালিপি না থাকায় এ মন্দির কার দ্বারা বা কোন্ সময়ে প্রতিষ্ঠিত তা সঠিকভাবে বলা যায় না। অনেকে বলেন, রাজা রুদ্রের কনিষ্ট পুত্র রামকৃষ্ণের মাতা আঠারো শতকের প্রথম দিকে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। আবার কেউ কেউ বলেন এটি সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে নদিয়ারাজ রাঘব রায় প্রতিষ্ঠা করেন। ( রাজত্বকাল ১৬৩২-৮৩ )। এক সময়ে এই শিবলিঙ্গ লোকের কাছে 'রানির শিব' বা 'রুদ্রকান্ত' নামে পরিচিত ছিল। পরে কোন এক সময়ে এখানে নিদারুণ অনাবৃষ্টির সময় সাধক বিজয়কৃষ্ণ বৃষ্টিপাতের জন্য শিবের মাথায় প্রচুর গঙ্গাজল ঢেলেছিলেন। তারপরই বেশ বৃষ্টিপাত হয়। আর তারপর থেকেই শিবের নাম হয় 'জলেশ্বর'। শিবলিঙ্গটি কাল পাথরের। উচ্চতা প্রায় ৩ ফুট (৯২ সে. মি. )। জলেশ্বর শিবলিঙ্গ নিত্য পূজিত।
স্বর্গীয় কালীচরণ চট্টোপাধ্যায়ের মাতামহের পূর্বপুরুষরা এই মন্দিরের সেবায়েত ছিলেন। কালীচরণ বাবু একবার এই মন্দিরের সংস্কার করেন। তিনি মিউনিসিপ্যাল কমিশনার ও অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। তাঁর কন্যা স্বর্গীয়া মোহিতকুমারীর ( শান্তিপুরের প্রসিদ্ধ ধনী স্বর্গীয় কিশোরীলাল মুখোপাধ্যায়ের পুত্রবধু ) সময় নাটমন্দিরটি নির্মিত হয়।
মন্দিরটি পোড়ামাটির সূক্ষ্ম মূর্তি ও নকাশি অলংকরণে অলংকৃত। মন্দিরের দক্ষিণ ও পূর্ব উভয় প্রবেশদ্বার দুটিকে ঘিরে দুই সারি কুলুঙ্গির মধ্যে মূর্তিগুলি উৎকীর্ণ। দেওয়ালের বাকি অংশ প্রধানত নকাশি সজ্জায় সজ্জিত। মূর্তিগুলির পৌরাণিক বিষয়বস্তু -- কৃষ্ণলীলার বিভিন্ন দৃশ্য, ভীষ্মের শরশয্যা, রামায়নের কাহিনী, মারীচ, গরুড়বাহন, বিষ্ণু, হরগৌরী, গণেশ, কালী, নারদ ইত্যাদি এবং সামাজিক বিষয়বস্তু -- বন্দুকধারী সাহেব, তীরন্দাজ ব্যাধ, বর্মপরিহিত যোদ্ধা প্রভৃতি। অনেকগুলি কুলুঙ্গির মূর্তি এখন বিনষ্ট। সংস্কারের সময় পোড়ামাটির সজ্জার উপর কলিচুনের প্রলেপ দেওয়ায় পোড়ামাটির অলংকরণ এখন অনেকটাই ম্লান।
শান্তিপুরের জলেশ্বরের মন্দিরে যেতে হলে শিয়ালদহ থেকে শান্তিপুর লোকাল ধরুন। রেলপথে শান্তিপুরের দূরত্ব ৯৩ কি. মি. ; ট্রেনে সময় লাগে ঘন্টা আড়াই। স্টেশন থেকে রিকশায় বা টোটোতে পৌঁছে যান জলেশ্বরের মন্দির। ৩৪ নং জাতীয় সড়ক শান্তিপুরের ওপর দিয়ে গেছে। তাই বাসে বা গাড়িতেও যেতে পারেন।
জলেশ্বর শিব মন্দির |
শিব মন্দিরের চূড়া |
মন্দিরের দক্ষিণ দিকের প্রবেশ-দ্বার ( নাটমন্দির থেকে তোলা ) |
মন্দিরের পূর্ব দিকের প্রবেশ-দ্বার |
মন্দিরের টেরাকোটার কাজ - ১ |
মন্দিরের টেরাকোটার কাজ - ২ |
মন্দিরের টেরাকোটার কাজ - ৩ |
মন্দিরের টেরাকোটার কাজ - ৪ |
জলেশ্বর মন্দির ও নাটমন্দির |
জলেশ্বর শিবলিঙ্গ |
সহায়ক গ্রন্থাবলি :
১. বাংলার মন্দির স্থাপত্য ও ভাস্কর্য : প্রণব রায়
২. নদিয়া জেলার পুরাকীর্তি : মোহিত রায় ( তথ্য-সংকলন ও গ্রন্থনা )
৩. শান্তিপুর - পরিচয় ( ১ ম ভাগ ) : কালীকৃষ্ণ ভট্টাচার্য
-------------------------------
আমার ইমেল : shyamalfpb@gmail.com প্রয়োজনে যোগাযোগ করতে পারেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন