সর্বমঙ্গলা মন্দির, বর্ধমান শহর, পূর্ব বর্ধমান
শ্যামল কুমার ঘোষ
রূপরাম চক্রবর্তীর ধর্মমঙ্গলে দেবী সর্বমঙ্গলার উল্লেখ পাওয়া যায় :
"বর্ধমানে বন্দদেবী সর্ব্বমঙ্গলা।
অধিষ্ঠান হন দেবী ঠিক দুপুরবেলা।।"
বর্ধমান শহরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী সর্বমঙ্গলা। এই দেবীমূর্তি খুব প্রাচীন। মন্দির প্রাঙ্গণে দুটি আটচালা শিবমন্দির রাজা চিত্রসেনের আমলে এবং অন্য তিনটি শিব মন্দির রাজা তেজচাঁদের আমলে নির্মিত হয়েছিল। অনুমান করা যায় যে চিত্রসেনের পূর্বে তাঁর পিতা কীর্তিচাঁদ রায় এই সর্বমঙ্গলা মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। কিন্তু কোন প্রতিষ্ঠাফলক না থাকার জন্য নির্মাণকাল সঠিক ভাবে বলা সম্ভব নয়। তবে ডেভিড ম্যাককাচ্চন নির্মাণকাল ঊনবিংশ শতক বলে উল্লেখ করেছেন। বর্ধমান রেলস্টেশন থেকে টোটোতে সহজেই এই মন্দিরে যাওয়া যায়।
সর্বমঙ্গলা মূর্তি সম্বন্ধে একটি কাহিনী শোনা যায়। তখন বর্ধমানের উত্তরে বাহির সর্বমঙ্গলায় অনেক পুকুর, ধানক্ষেত ও জলা-জায়গা ছিল। ওখানে অনেক বর্গক্ষত্রীয়দের বাস ছিল। তাঁরা ওই পুকুর ও জলা থেকে জাল দিয়ে মাছ, গুগলি, শামুক, কাঁকড়া ইত্যাদি ধরতেন। একদিন একজনের জালে শিলার মত একটি পাথর ওঠে। তারপর ওই পাথরের উল্টো দিকে তাঁরা শামুক-গুগলি থেঁতো করতে থাকেন। তখন শামুক-গুগলির খোল পুড়িয়ে চুন তৈরি করা হতো। একদিন ভুল করে শামুক-গুগলির সঙ্গে ওই শিলামূর্তিও অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হয়। কিন্তু আগুনে শিলামূর্তির কোন বিকৃত হয় না। সেই দিনই বর্ধমানের রাজা স্বপ্ন দেখেন, দেবী সর্বমঙ্গলা তাঁকে বলছেন, আমি দামোদরের তীরে চুনের ভাটায় শিলারূপে আছি, তুমি আমাকে উদ্ধার করে পূজা কর। ভোর না হতেই রাজা চুনের ভাটায় গিয়ে জানতে পারেন তিনজন ব্রাহ্মণ শিলামূর্তিটি নিয়ে গেছেন। রাজা সেই ব্রাহ্মণদের কাছে গিয়ে স্বপ্নাদেশের কথা বলেন। কিন্তু সেই তিন ব্রাহ্মণ শিলামূর্তি দিতে অস্বীকার করেন। তখন রাজা প্রস্তাব দেন যে দেবীর অধিকারী ব্রাহ্মণগণই থাকবেন। রাজা শুধু মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করে পূজার ব্যবস্থা করবেন। সেইমত রাজা মন্দির নির্মাণ করে তাতে ওই শিলামূর্তি প্রতিষ্ঠা করে পূজার ব্যবস্থা করেন। এই তিন জন ব্রাহ্মণ ছিলেন বেগুট গ্রামের। একবার কালাপাহাড় মন্দির ধ্বংস করতে আসছে শুনে ওই তিন ব্রাহ্মণ মন্দিরে তালা লাগিয়ে পালিয়ে যান। দেবীর পূজা বহুদিন বন্ধ থাকে। তারপর রাজা বাঁকা নদীর কাছ থেকে এক তান্ত্রিক সাধককে এনে পূজার ভার দেন। কিছুদিন পূজা করার পর সেই সাধক আর পূজা করতে চান না। তখন রায়ান গ্রামের ব্রাহ্মণরা পূজার ভার নেন। এরপর সেই আগেকার তিন ব্রাহ্মণ ফিরে এসে রায়ান গ্রামের ব্রাহ্মণদের চলে যেতে বলেন। তখন মহারাজা মধ্যস্থতা করে বেগুট ও রায়ান গ্রামের ব্রাহ্মণদের পালাক্রমে পূজার ব্যবস্থা করে দেন।
|
সর্বমঙ্গলা মন্দির, বর্ধমান শহর |
এবার সর্বমঙ্গলার মন্দির চত্বরের বিবরণ দিই। মন্দিরের পূর্ব দিকে প্রধান প্রবেশ-দ্বার। দক্ষিণ দিকে আর একটি প্রবেশ দ্বার আছে। এই প্রবেশ দ্বার দিয়ে ঢুকলে দেখা যাবে, সামনে পথের দু দিকে দুটি শিব মন্দির আছে। দুটি মন্দিরেরই গর্ভগৃহে একটি করে কাল পাথরের শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত। বাঁ দিকের মন্দিরটির নাম মিন্দ্রেশ্বর ( ইন্দ্রেশ্বর ) শিব মন্দির ও ডানদিকের মন্দিরটির নাম চন্দ্রেশ্বর শিব মন্দির। বাঁ দিকের মন্দিরটি উঁচু ভিত্তিবেদীর উপর স্থাপিত, ত্রিখিলানবিশিষ্ট, দক্ষিণমুখী, অলিন্দযুক্ত ও আটচালা শৈলীর। খিলানের উপরে টেরাকোটার সুন্দর কাজ আছে। এই টেরাকোটার বিষয় : নন্দীর পিঠে হরগৌরী, সপরিবারে মহিষাসুরমর্দিনী ও সিংহাসনে উপবিষ্ট রাম-সীতা। মন্দিরের দেওয়ালে একটি শ্বেতপাথরের প্রতিষ্ঠাফলক আছে। গর্ভগৃহে কালো পাথরের শিব লিঙ্গ নিত্য পূজিত।
|
মিন্দ্রেশ্বর ( ইন্দ্রেশ্বর ) শিব মন্দির |
|
মন্দিরের ত্রিখিলান বিন্যাস |
|
বাঁ দিকের খিলানের উপরের কাজ ( নন্দীর পিঠে হরগৌরী ) |
|
মাঝের খিলানের উপরের কাজ |
|
সপরিবারে মহিষাসুরমর্দিনী |
|
ডান দিকের খিলানের উপরের কাজ ( সিংহাসনে উপবিষ্ট রাম-সীতা ) |
|
প্রতিষ্ঠাফলক |
ডানদিকের মন্দিরটির নাম চন্দ্রেশ্বর শিব মন্দির। এই মন্দিরটিও উঁচু ভিত্তিবেদীর উপর স্থাপিত, ত্রিখিলানবিশিষ্ট, দক্ষিণমুখী, অলিন্দযুক্ত ও আটচালা শৈলীর। খিলানের উপরে টেরাকোটার সুন্দর কাজ আছে। এ মন্দিরের দেওয়ালেও একটি শ্বেতপাথরের প্রতিষ্ঠাফলক আছে। গর্ভগৃহে কালো পাথরের শিব লিঙ্গ নিত্য পূজিত।
|
চন্দ্রেশ্বর শিব মন্দির |
|
মন্দিরের ত্রিখিলান বিন্যাস |
|
বাঁ দিকের খিলানের উপরের কাজ |
|
মাঝের খিলানের উপরের কাজ |
|
ডান দিকের খিলানের উপরের কাজ |
|
প্রতিষ্ঠাফলক |
এই শিব মন্দির দুটি পার হয়ে বাঁ দিকে গেলে পর পর তিনটি শিব মন্দির দেখা যাবে। প্রথম মন্দিরটির নাম রামেশ্বর শিব মন্দির। উঁচু ভিত্তিবেদীর উপর স্থাপিত, উত্তরমুখী মন্দিরটি দেউল শ্রেণীর। মন্দিরের গায়ে টেরাকোটার কাজ আছে। গর্ভগৃহে সাদা পাথরের শিবলিঙ্গ নিত্য পূজিত। মন্দিরের দেওয়ালে একটি প্রতিষ্ঠাফলক আছে।
|
রামেশ্বর শিব মন্দির |
|
টেরাকোটার কাজ - ১ |
|
টেরাকোটার কাজ - ২ |
|
প্রতিষ্ঠাফলক |
তৃতীয় মন্দিরটির নাম কমলেশ্বর শিব মন্দির। উঁচু ভিত্তিবেদীর উপর স্থাপিত, উত্তরমুখী মন্দিরটি দেউল শ্রেণীর। মন্দিরের গায়ে টেরাকোটার কাজ আছে। টেরাকোটার বিষয় : 'রামরাজা' ইত্যাদি। গর্ভগৃহে সাদা পাথরের শিবলিঙ্গ নিত্য পূজিত। মন্দিরের দেওয়ালে একটি প্রতিষ্ঠাফলক আছে।
|
কমলেশ্বর শিব মন্দির |
|
টেরাকোটার কাজ - ১ |
|
'রামরাজা' |
|
টেরাকোটার কাজ - ২ |
|
টেরাকোটার কাজ - ৩ |
|
প্রতিষ্ঠাফলক
|
এই দুটি মন্দিরের মাঝের মন্দিরটির নাম মিত্রেশ্বর শিব মন্দির। উঁচু ভিত্তিবেদীর উপর স্থাপিত, দক্ষিণমুখী মন্দিরটি পঞ্চরত্ন শৈলীর। মন্দিরে কিছু টেরাকোটা ফলক আছে। এর বেশির ভাগই নষ্ট হয়ে গেছে। মন্দিরের দেওয়ালে একটি শ্বেতপাথরের সংস্কার-ফলক আছে। গর্ভগৃহে কালো পাথরের শিবলিঙ্গ নিত্য পূজিত।
|
মিত্রেশ্বর শিব মন্দির |
|
কূর্ম অবতার |
|
পরশুরাম |
|
সংস্কার-ফলক |
এই মন্দির তিনটির সামনে একটি হাড়িকাঠ আছে। যদিও বর্তমানে মন্দিরে কোন পশুবলি হয় না। এর সামনে নাটমন্দির। তারপর মূল সর্বমঙ্গলা মন্দির। উচ্চ ভিত্তিবেদীর উপর প্রতিষ্ঠিত, দক্ষিণমুখী মন্দিরটি নবরত্ন শৈলীর। কার্নিস সোজা। মন্দিরের দেওয়ালে কিছু টেরাকোটার কাজ আছে। গর্ভগৃহে মা সর্বমঙ্গলা নিত্য পূজিত। সর্বমঙ্গলা দেবী অষ্টাদশ ভুজা, কালো পাথরের। চরণতলে মহিষ, পাশে মহিষাসুর। সিংহাসনে মা উপবিষ্টা। ত্রিশূল দিয়ে অসুরের বক্ষ বিদীর্ণ করছেন।
|
সর্বমঙ্গলা মন্দির, বর্ধমান শহর |
|
টেরাকোটার কাজ - ১ |
|
টেরাকোটার কাজ - ২ |
|
টেরাকোটার কাজ - ৩ |
|
টেরাকোটার কাজ - ৪ |
|
মৃত্যুলতা - ১ |
|
মৃত্যুলতা - ২ |
|
দেবী সর্বমঙ্গলা |
মায়ের নিত্য পূজা, অন্নভোগ হয় শুদ্ধাচারে। সন্ধ্যায় হয় শীতল ও আরতি। সকাল থেকে ভক্তরা আসেন পূজা দিতে। পয়লা বৈশাখের দিন মন্দিরে ভক্তদের ঢল নামে। এ ছাড়াও বিপত্তারিনী পূজা, জ্যৈষ্ঠ মাসের মঙ্গলচণ্ডী পূজা, বাসন্তী পূজা, রামনবমী, কালী পূজা, শিবরাত্রি ও দুর্গা পূজার সময় প্রচুর ভক্ত সমাগম হয়। প্রতি অমাবস্যায় মন্দিরে ধুমধাম করে পূজা হয়। আগেই বলা হয়েছে যে মন্দিরে এখন কোন পশুবলি হয় না।
মন্দির চৌহদ্দির বাইরে পূর্ব-দক্ষিণ কোণে একটি কামান আছে। আগে দুর্গা পূজার সময় সন্ধিক্ষণ জ্ঞাপনের জন্য এই কামান থেকে তোপ দাগা হোত। ১৯৯৭ সালে দুর্ঘটনা ঘটার পর থেকে তা বন্ধ হয়ে যায়।
মন্দিরের দক্ষিণ দিকের গেটের পাশে, ইমারতের দেওয়ালের খিলানের উপর খুব সুন্দর সুন্দর পঙ্খের কাজ আছে।
মন্দির পরিদর্শনের তারিখ : ২০.০২.২০২০
|
পঙ্খের কাজ - ১ |
|
পঙ্খের কাজ - ২ |
|
পঙ্খের কাজ - ৩ |
|
পঙ্খের কাজ - ৪ |
সহায়ক গ্রন্থ : ১) বর্ধমান নগরের দেবদেবী : নীরদবরণ সরকার
*******
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন