Pages

সোমবার, ১৮ নভেম্বর, ২০১৯

Nabaratna Radhabinod Temple, Jaydeb Kenduli, Illambazar, Birbhum


নবরত্ন  রাধাবিনোদ  মন্দির,  জয়দেব-কেন্দুলী, ইলামবাজার,  বীরভূম 

শ্যামল  কুমার  ঘোষ 

            বীরভূম  জেলার  বোলপুর  মহকুমা  ও  ইলামবাজার  ব্লকের  অন্তর্গত  জয়দেব-কেন্দুলী  একটি  গ্রাম।  বোলপুরের  জামবুনি  বাসস্ট্যান্ড  থেকে  বাসে  সহজেই  এখানে  যাওয়া  যায়।

            'কেন্দুবিল্বসম্ভবরোহিণীরমণ' ...  গীতগোবিন্দ  পদাবলীর  ভণিতা  থেকে  জানা  যায়,  কবি  জয়দেবের  জন্মস্থান  'কেন্দুবিল্ব'  গ্রাম।  কেন্দুবিল্ব  থেকে  কেন্দুলী  বা  কেঁদুলি।  বর্তমান  নাম  'জয়দেব-কেন্দুলী'  বা ' জয়দেব-কেঁদুলি'।  অজয়  নদের  তীরে  কেন্দুলী গ্রাম।  বহুকাল  থেকে  পৌষ  সংক্রান্তিতে  এই  গ্রামে  জয়দেব-স্মারক  মেলা  হয়ে  আসছে।  মেলাতে  বহু  বাউলের  সমাবেশ  হয়।

            কবি  জয়দেবের  জন্মস্থান  নিয়ে  অবশ্য  মতভেদ  আছে।  উড়িষ্যার  পন্ডিতবর্গ  যুক্তিতর্ক  সহকারে  এই  মত  প্রকাশ  করেছেন  যে  কবি  জয়দেবের  জন্মস্থান  পুরী  জেলার  বালীঅন্টা  থানার  অন্তর্গত  প্রাচী  নদীতীরে  অবস্থিত  'কেন্দুলী  শাসন'।  

            রাজা  লক্ষ্মণ  সেনের  রাজসভার  পঞ্চরত্নের  অন্যতম  ছিলেন  কবি জয়দেব।  অন্যেরা  হলেন,  গোবর্ধন  আচার্য,  শরণ,  উমাপতি  ও  কবিরাজ ( ধোয়ী )।  তাঁর  পিতার  নাম  ভোজদেব,  মাতা  বামাদেবী  এবং  স্ত্রী  পদ্মাবতী।  তাঁর  স্ত্রী  ছিলেন  নাচেগানে  পারদর্শী।  কবি  জয়দেব  সম্বন্ধে  অনেক  কাহিনী  প্রচলিত  আছে।  তার  মধ্যে  'দেহি  পদপল্লবমুদারম্ '  কাহিনীটি  সবচেয়ে  রোমাঞ্চকর।  কাহিনীটি  হল :  কবি  জয়দেব  একবার  ''স্মরগরল  খণ্ডনং,  মম  শিরসি  মণ্ডনং ''  লিখে  পরবর্তী  অংশ  আর  লিখতে  পারছিলেন  না।  বনমালী  দাস  তাঁর  'জয়দেব-চরিত্র'  গ্রন্থে  লিখেছেন,  কবি  লিখতে  চাইছিলেন,  

                     "কৃষ্ণ  চাহে  পাদপদ্ম  মস্তকে  ধরিতে 
                      কেমনে  লিখিব  ইহা  বিস্ময়  এই  চিত্তে "  
            
            যাঁর  পদতলে  বিশ্বব্রহ্মাণ্ড,  তিনি  কি  করে  রাধার  পা  ধরবেন ?  ভাবতে  ভাবতে  তিনি  নদীতে  স্নান  করতে  গেলেন।  কিন্তু  কিছুক্ষণের  মধ্যেই  তিনি  স্নান  সেরে  ফিরে  এলেন।  পদ্মাবতী  বললেন,  স্নান  এত  তাড়াতাড়ি  হয়ে  গেল ?  জয়দেব  উত্তর  দিলেন,  যে  পদ  তিনি  খুঁজছিলেন  তা  পেয়েছেন।  এ  কথা  শুনে  পদ্মাবতী  তাড়াতাড়ি  তাঁকে  খেতে  দিলেন।  খাওয়া  শেষ  করে  তিনি  পদ্মাবতীকে  পুঁথি  আনতে  বললেন।  পদ্মাবতী  পুঁথি  নিয়ে  এলে  তিনি  তাতে  লিখলেন,  " দেহি  পদপল্লবমুদারম্ "  তারপর  তিনি  বিশ্রাম  করতে  ঘরে  চলে  গেলেন।  পদ্মাবতী  জয়দেবের  পাতে  খেতে  বসলেন।  এমন  সময়  জয়দেব  স্নান  সেরে  ফিরলেন।  জয়দেবকে  দেখে  পদ্মাবতী  অবাক  হলেন।  পদ্মাবতীর  কাছে  সব  শুনে  জয়দেবও  অবাক  হলেন।  পরে  পুঁথি  দেখে  জয়দেব  বুঝতে  পারলেন,  ভক্তবৎসল  শ্রীকৃষ্ণ  ভক্তের  মর্মবেদনা  বুঝতে  পেরে   নিজের  হাতে  লিখে  গিয়েছেন।

            'জয়দেব-কেন্দুলী'র  রাধাবিনোদ  বিগ্রহ  বা  মন্দিরের  সঙ্গে  জয়দেবের  কোন  সম্পর্ক  নেই।  জনশ্রুতি  অনুযায়ী  জয়দেব  তাঁর  বিগ্রহ  'রাধাবিনোদ'  বৃন্দাবনে  নিয়ে  যান।  বর্তমান  বিগ্রহ  বা  মন্দির  পরবর্তী  কালের।  কথিত  আছে  যে  রাধাবিনোদ  প্রতিষ্ঠিত  ছিলেন  অজয়  নদের  অপর  পাড়ে,  শ্যামরূপার  গড়ে।  কালক্রমে  শ্যামরূপার  গড়  জঙ্গলাকীর্ণ  হয়ে  পড়লে  কেন্দুলী  থেকে  অজয়  পেরিয়ে  নিত্য  পূজার  জন্য  শ্যামরূপার  গড়ে  যেতে  সেবায়েতগণ  অসুবিধা  বোধ  করতে  থাকলে  বর্ধমানের  রাজ-পরিবার  রাধাবিনোদ  বিগ্রহ  শ্যামরূপার  গড়  থেকে  নিয়ে  এসে  কেন্দুলীতে  প্রতিষ্ঠা  করেন।  প্রসঙ্গত  উল্লেখ্য,  একটি  জনশ্রুতি  অনুসারে  বিনোদ  নামে  এক  রাজা  আদিতে  শ্যামরূপার  গড়ে  ঐ  বিগ্রহ  প্রতিষ্ঠা  করেছিলেন।  তাঁর  নামানুসারে  বিগ্রহের  নাম  হয়  'রাধাবিনোদ'। 

               মন্দিরটির  প্রতিষ্ঠাকাল  নিয়ে  মতভেদ  আছে।  বিভিন্ন  পণ্ডিত  বিভিন্ন  সিদ্ধান্তে  আসায়  প্রতিষ্ঠার  বৎসররূপে  ১৬৮৩,  ১৬৮৪,  ১৬৯২,  ১৬৯৪  প্রভৃতি  বিভিন্ন  খ্ৰীষ্ট-বৎসর  মেলে।  তাই  বলা  যায়,  ১৬৮৩  থেকে  ১৬৯৪  খ্রীষ্টাব্দের  মধ্যে  মন্দিরটি  প্রতিষ্ঠিত  হয়।  মন্দির  প্রাঙ্গণে  ভারতীয়  পুরাতত্ত্ব-সর্বেক্ষণ,  কলকাতা  মণ্ডল  কর্তৃক  যে  ফলক  লাগান  আছে  তাতে  লেখা  আছে,  বর্ধমানের  মহারাজা  কীর্তিচাঁদ  বাহাদুর  ১৬৮৩  খ্রীষ্টাব্দে  ইহা  নির্মাণ  করেন।  নির্মাণকাল  ( ১৬৮৩ - ১৬৯৪ )  হলে  মন্দিরটি  কৃষ্ণরাম  রায়ের  ( ১৬৭৫ - ১৬৯৬ )  আমলে  নির্মিত হয়েছে  বলা  যায়। 

            ১৯১৫  সাল  থেকেমন্দিরটি  ভারতীয়  পুরাতত্ত্ব-সর্বেক্ষণ  কর্তৃক  সংরক্ষিত।  তাদের  ১৯২৩-'২৪  এর  ব্যৎসরিক প্রতিবেদনে  বলা  হয়েছে  যে  জনশ্রুতি  অনুসারে  মন্দিরটি  জয়দেবের  বাস্তুভিটের  উপর  নির্মিত  এবং  ঐতিহাসিক  মূল্য  ছাড়াও  স্থাপত্যগত  ও  টেরাকোটা  অলংকরণের  দিক  থেকেও  মন্দিরটি  বিশেষ  উল্লেখের  দাবি  রাখে।

            প্রায়  ভূমি  সমতলে  অবস্থিত  ভিত্তিবেদির  উপর  স্থাপিত,  ত্রিখিলান  প্রবেশপথবিশিষ্ট,  দক্ষিণমুখী  মন্দিরটি  নবরত্ন  শৈলীর।  গর্ভগৃহে  ঢোকার  দুটি  দরজা।  একটি  দক্ষিণ  দিকে,  অপরটি  পূর্ব  দিকে।  মন্দিরের  সামনের  দেওয়াল  অপূর্ব  'টেরাকোটা'  অলংকরণে  অলংকৃত।  যদিও  কালের  প্রকোপে  অনেক  'টেরাকোটা'  আজ  ভগ্ন।  বাঁ  দিকের  খিলানের  উপর  ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর,  বায়ু,  যম,  ইন্দ্র  ইত্যাদি  দেবতা  এবং  দশাবতারগণের  মূর্তি  উৎকীর্ণ  আছে।  মাঝের  খিলানের  উপর  রামরাবণের  যুদ্ধ  ও  ডান  দিকের  খিলানের  উপর  সুপার্শ্ব  কর্তৃক  সীতা  উদ্ধারের  প্রচেষ্টা  প্রাধান্য  পেয়েছে।  এ  ছাড়া  সাধু-সন্ত,  দ্বারপাল  ইত্যাদি  প্রতিকৃতি  ও  কৃষ্ণলীলার  ঘটনাবলী  উৎকীর্ণ  আছে।  মন্দিরটি  একটি  ঘেরাক্ষেত্রে  অবস্থিত।  গর্ভগৃহে  রাধাবিনোদ  ও  রাধিকা  বিগ্রহ  নিত্য  পূজিত।
   

রাধাবিনোদ মন্দির 


মন্দিরের সামনের বিন্যাস 

বাঁ দিকের হিলানের উপরের কাজ 

 ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর, বায়ু, যম, ইন্দ্র ইত্যাদি দেবতা 

দশাবতারগণ

মাঝের খিলানের উপরের কাজ
( রামরাবণের 
 যুদ্ধ )

রামরাবণের  যুদ্ধ ( বড় করে )

ডান দিকের হিলানের উপরের কাজ 

সুপার্শ্ব "রথের সহিত রাবণ গিলিবারে আইসে " 
                            - কীর্তিবাসী রামায়ণ 
কুলুঙ্গির মধ্যের কাজ - ১

কুলুঙ্গির মধ্যের কাজ - ২

কুলুঙ্গির মধ্যের কাজ - ৩

কুলুঙ্গির মধ্যের কাজ - ৪

কুলুঙ্গির মধ্যের কাজ - ৫

কুলুঙ্গির মধ্যের কাজ - ৬

মহিষাসুরমর্দিনী 

মৃত্যুলতা - ১

মৃত্যুলতা - ২

Add caption

নকশা 

রাধাবিনোদ ও রাধিকা বিগ্রহ


            মন্দিরটি  পরিদর্শনের  তারিখ :  ৩১.১০.২০১৯

       সহায়ক  গ্রন্থ :
                     ১)  পশ্চিমবঙ্গের  সংস্কৃতি :  বিনয়  ঘোষ 
                    ২)  পশ্চিমবঙ্গের  মন্দির :  শম্ভু  ভট্টাচার্য 
                    ৩)  বীরভূম  জেলার  পুরাকীর্তি  :দেবকুমার  চক্রবর্তী 
                                                                        

 ----------------------------

            আমার  ইমেল :  shyamalfpb@gmail.com   প্রয়োজনে  যোগাযোগ  করতে  পারেন।                                

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন