শ্রীধর মন্দির, সোনামুখী, বাঁকুড়া
শ্যামল কুমার ঘোষ
বাঁকুড়া জেলার সোনামুখী ব্লক ও থানার অন্তর্গত সোনামুখী পৌর-শহর। তন্তুবায় ও সুবর্ণবণিক সম্প্রদায়ই অতীতে এখানে সামাজিক নেতৃত্ব করেছেন। স্থানীয় পুরাকীর্তিগুলির অধিকাংশ তাঁদেরই স্থাপিত। জনশ্রুতি, প্রাচীন গ্রাম্যদেবী স্বর্ণময়ীর ( স্বর্ণমুখী ) নামানুসারে এ জনপদের নাম। কালাপাহাড় তাঁর নাক ভেঙে দিলেও বর্গী অধিনায়ক ভাস্কর রাও ষোড়শোপচারে তাঁর পূজা দিয়েছিলেন। এখানে যেতে হলে বর্ধমানের আলিশা বাসস্ট্যান্ড থেকে বাঁকুড়ার বাসে উঠুন। আরামবাগ, বাঁকুড়া বা বিষ্ণুপুর থেকেও এখানে যেতে পারেন। থাকার জন্য সোনামুখী পৌর আবাসিক ভবন ও অন্য অনেক লজ আছে।
এখানকার শ্রেষ্ঠ পুরাকীর্তি, বাজারের মোড়ের কাছে অবস্থিত, তন্তুবায়-পরিবারের ইটের শ্রীধর ( শালগ্রাম শিলা ) মন্দির। উঁচু ভিত্তিবেদির স্থাপিত মন্দিরটি পশ্চিমমুখী ও পঁচিশরত্ন শৈলীর। চারদিকে ত্রিখিলান দালানযুক্ত। গর্ভগৃহে একটি মাত্র দরজা, পশ্চিম দিকে। বাকি তিন দিকে ভরাট করা দরজা। পঁচিশরত্ন মন্দির পশ্চিমবঙ্গে মাত্র পাঁচটি আছে। সোনামুখী ছাড়া অম্বিকা কালনায় আছে তিনটি ও সুখাড়িয়ায় একটি। শ্রীধর মন্দিরে তল না বাড়িয়ে দুটি তলে পঁচিশটি চূড়া স্থাপন করায় শ্রীহানি হয়েছে। স্থাপত্য গরিমায় আলোচ্য মন্দিরটি স্মরণীয় না হলেও এর আসল বৈশিষ্ট তার 'টেরাকোটা'-অলংকরণের প্রাচুর্য ও বৈচিত্র। এ মন্দিরের মত চারদিকের দেওয়ালে, এমন কি ঢাকা অলিন্দেও পোড়ামাটির সজ্জা বাঁকুড়া জেলার অল্প কয়েকটি মাত্র মন্দিরে দেখা যায়। টেরাকোটার বিষয় : রামায়ণ-মহাভারতের বিভিন্ন আলেখ্য, কৃষ্ণলীলা, দশাবতার মূর্তি, পৌরাণিক ( শৈব, শাক্ত, বৈষ্ণব উপাসনানির্বিশেষে ), সামাজিক, পশুপক্ষীচিত্র ও ফুলকারি নকশা। মন্দিরে একাধিক কালীমূর্তি আছে। যদিও এই 'টেরাকোটা'-অলংকরণ প্রথম শ্রেণীর নয়। পূর্ব দিকের দেওয়ালে নিবদ্ধ শ্লেটপাথরের ক্ষয়িত লিপিটির পাঠ নিম্নরূপ : "সকাব্দা ১৭৬৭ বাং ১২৫২ সাল ... শ্রীধর মন্দিরং ... পঞ্চবিংশতিচূড়ঙ্কং কানাঞি রুদ্রদাসেন তন্তুবায়েন যত্নতঃ নির্মায়িতং বরং সৌধং নানাচিত্রসমন্বিতং ... হরি সূত্রধরেণ বিনির্মিতং।" অর্থাৎ মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা কানাই রুদ্র দাস এবং স্থপতিকার হরি সূত্রধর। মন্দিরের নির্মাণ কাল ১৭৬৭ শকাব্দ বা ১৮৪৫ খ্রীষ্টাব্দ।
এমন একটা সুন্দর ও বৈচিত্রেভরা 'টেরাকোটা'-অলংকরণযুক্ত মন্দির ভালো ভাবে দেখার উপায় নেই। ডঃ রবীন্দ্রনাথ সামন্ত তাঁর 'বাঁকুড়া সংস্কৃতি পরিক্রমা' গ্রন্থে লিখেছেন, "বাজারপাড়ায় জমির প্রয়োজন ও মূল্য বড্ড বেশি। তাই মন্দিরের গাত্রসংলগ্ন ঘরবাড়ি উঠেছে, দালানকোঠা দোকান-পসরা তৈরী হয়েছে। ... মন্দিরের সামনে দাঁড়াবার অপ্রশস্ত অঙ্গন, পিছনে ও পাশে যাবার উপায় নেই। পিছনে আধকাঠা জায়গায় বাগান - বাগানের দরজায় তালাবন্ধ। মন্দিরের উত্তরভাগ উঁকি দিয়ে আড়চোখে দেখতে হয় - সেদিকে কারা বাড়ি করেছেন, আধ হাত জায়গাও ফেলে রাখতে পারেন নি। ..."
উত্তর দিকের দেওয়ালের ছবি তোলা খুব কষ্টকর হলেও আমি কয়েকটি ছবি তুলেছি। তার দুটি ছবি এখানে দিলাম।
মন্দিরটি পরিদর্শনের তারিখ : ২৪.০৩.২০১৯
খুব সুন্দর একটি সচিত্র প্রতিবেদন 👌🙏
উত্তরমুছুন