শ্রীশ্রী নন্দদুলাল মন্দির, চন্দননগর, হুগলি
শ্যামল কুমার ঘোষ
হাওড়া-ব্যাণ্ডেল রেলপথে চন্দননগর ত্রয়োদশতম রেলস্টেশন। রেলপথে হাওড়া থেকে দূরত্ব ৩২.৬ কিমি। চন্দননগরের লালবাগান অঞ্চলে শ্রীদুর্গা ছবিঘরের কাছে নন্দদুলাল মন্দির বিখ্যাত। মন্দিরটি ১১৪৬ বঙ্গাব্দে ( ১৭৩৯ খ্রীষ্টাব্দে ) চন্দননগরের তদানীন্তন ফরাসি সরকারের দেওয়ান ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী প্রতিষ্ঠা করেন।
খ্রিস্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে তিনি ও তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা রাজারাম যশোহরের সর্বরাজপুর গ্রাম থেকে তাঁদের বিধবা মায়ের সঙ্গে দশ/ বার বছর বয়েসে চন্দননগরে আসেন। লেখাপড়া শিখে ফরাসি কম্পানির অধীনে হিসাবরক্ষকের চাকরি নেন। পরে ব্যবসা শুরু করেন। ফরাসিদের তিনি খাদ্য ও বস্ত্র সরবরাহ করে বিপুল সম্পদের অধিকারী হন। ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি মারা যান। তিনি কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের বন্ধু ছিলেন এবং প্রয়োজনে কৃষ্ণচন্দ্রকে টাকা ধার দিতেন। তাঁরই সুপারিশে কৃষ্ণচন্দ্র রায় গুনাকর ভারতচন্দ্রকে তাঁর সভায় স্থান দেন। ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যাণ্ড ও ফ্রান্সের মধ্যে সপ্তবর্ষের যুদ্ধ শুরু হলে ক্লাইভ জলপথে ও স্থলপথে চন্দননগর আক্রমণ করেন এবং ধ্বংস করেন। চন্দননগর অবরোধের সময় ইংরেজ সৈন্য ইন্দ্রনারায়ণের বাসভবন লুণ্ঠন করে তখনকার দিনে ৬৫ লক্ষ টাকা মূল্যের নগদ সোনার টাকা ও অলংকার নিয়ে যায়। ক্লাইভের গোলায় ইন্দ্রনারায়ণের প্রাসাদসম বাসভবন চূর্ণ হয়। ইন্দ্রনারায়ণের বাসভবন নন্দদুলাল মন্দিরের কিছুটা উত্তরে ছিল। একটি গোলা ছিটকে নন্দদুলাল মন্দিরের পিছনে এসে লাগে। মন্দিরের নিচে একটি গুপ্তকক্ষ আছে। কথিত আছে, ওখানেও ধন-দৌলত মজুত ছিল। ক্লাইভের সৈন্য তাও লুট করে। নন্দদুলাল বিগ্রহের ভেতর সোনা লুকানো আছে ভেবে বিগ্রহ ভেঙে ফেলে মন্দিরের পাশের পুকুরে ফেলে দেয়। ( অন্য মতে, বর্গীর হাঙ্গামার সময় বিগ্রহটি ভাঙে। ) আসল মূর্তিটির পায়ের ভাঙা অংশ চন্দননগরের ফ্রেঞ্চ ইনস্টিটিউট বা চন্দননগর মিউজিয়াম -এ রক্ষিত আছে।
নন্দদুলালের মন্দিরটি মাঝারি উঁচু ভিত্তি বেদির উপর স্থাপিত সমতল ছাদবিশিষ্ট, দক্ষিণমুখী দালান। দৈর্ঘ্যে ৫১ ফুট ৯ ইঞ্চি এবং প্রস্থে ১১ ফুট। মন্দিরের সামনে এক বাংলা ধরনের জগমোহন, দৈর্ঘ্যে মন্দিরের দৈর্ঘ্যের সমান, প্রস্থে ১৪ ফুট ২ ইঞ্চি। একবাংলার সংলগ্ন দালান থাকায় মন্দিরের স্থায়িত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। একবাংলাটির ( দোচালা ) উচ্চতা মূল মন্দিরের চেয়ে বেশি। একবাংলাটি পাঁচ খিলান বিশিষ্ট, দুটি খিলান ভরাটকরা। একবাংলা জগমোহন দালানরীতির গর্ভগৃহকে এমন ভাবে ঢেকে রেখেছে যে সামনে দাঁড়ালে মন্দিরটি এক বাংলা-ই মনে হয়। মন্দিরটির সামনে ও পশ্চিমদিকের দেওয়ালে পোড়ামাটির কয়েকটি ছোট ছোট ফুল ছাড়া অন্য কোন কাজ নেই। মন্দিরে একটি পোড়ামাটির প্রতিষ্ঠাফলক আছে। পরে আরো একটি শ্বেতপাথরের ফলক লাগানো হয়েছে। সুধীর কুমার মিত্র তাঁর 'হুগলি জেলার দেব দেউল' গ্রন্থে লিখেছেন যে আগে এই মন্দির পোড়ামাটির অলংকরণে অলংকৃত ছিল। সংস্কারের সময় বহু লোনা লাগা ফলক খসিয়ে ফেলা হয়েছে। কিন্তু সংস্কারের আগের মন্দিরের যে ছবিটি আমি তপন কুমার চ্যাটার্জীর কাছ থেকে পেয়েছি তাতে দেখছি সংস্কারের আগের ও পরের টেরাকোটা অলংকরণের কোন পার্থক্য নেই। আগে মন্দিরে ওঠার সিঁড়ি এক পাশে ছিল। এখন মাঝখানে হয়েছে।
মন্দিরে শ্রীশ্রী নন্দদুলাল জিউর বিগ্রহ নিত্য পূজিত। মন্দির সংস্কারের পরেও বহুদিন মন্দিরে কোন বিগ্রহ ছিল না। মন্দিরে পুরানো বিগ্রহের ছবিকেই পূজা করা হত। পরে ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে ( ১০ ই ভাদ্র, ১৪১২, জন্মাষ্টমী ) শঙ্কর সেবক বড়ালের স্মৃতিতে তাঁর স্ত্রী দুর্গারানী বড়াল ও তাঁর পুত্রকন্যাগণ প্রদত্ত নন্দদুলালের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করা হয়। পুরানো বিগ্রহের ছবিটি বর্তমান বিগ্রহের পাশে রাখা আছে। ( মন্দিরটির সম্বন্ধে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন নন্দদুলাল মন্দির কমিটির বর্তমান ( ২০১৬) সভাপতি তপনকুমার চ্যাটার্জী। তাঁকে অসংখ্য ধন্যবাদ। )
মন্দিরটি পরিদর্শনের তারিখ : ২৬.১০.২০১৬
|
নন্দদুলালের বর্তমান মন্দির |
|
সংস্কারের আগের মন্দির ( তপন কুমার চ্যাটার্জী' র কাছ থেকে প্রাপ্ত ) |
|
নন্দদুলাল মন্দির ( পশ্চিম দিক থেকে তোলা ) |
|
মন্দিরের সামনের বিন্যাস |
|
গর্ভগৃহের সামনের বিন্যাস |
|
টেরাকোটার ফুল ও প্রতিষ্ঠাফলক |
|
প্রতিষ্ঠাফলক |
|
শ্রীশ্রী নন্দদুলাল বিগ্রহ |
|
উপরে নন্দদুলালের বিছানা, নিচে গুপ্তঘরের দরজা |
|
গুপ্তঘরের দরজা |
উপরোক্ত মন্দিরে যেতে হলে হাওড়া থেকে পূর্বরেলের মেন লাইনের লোকালে উঠুন। নামুন চন্দননগর স্টেশনে। স্টেশনের পূর্ব দিক থেকে অটো বা টোটোতে উঠে পৌঁছে যান মন্দিরে। জি. টি. রোড দিয়ে গাড়িতেও যেতে পারেন।
সহায়ক গ্রন্থ :
১) হুগলি জেলার পুরাকীর্তি : নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য
------------------------------------------------------------- আমার ইমেল : shyamalfpb@gmail.com প্রয়োজনে যোগাযোগ করতে পারেন।
--------------------------------------------------------------
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন