গোপালজী মন্দির, সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দিরের কাছে, অম্বিকা কালনা, বর্ধমান
শ্যামল কুমার ঘোষ
অম্বিকা কালনায় সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরের মোড়ের কাছে গোপালজীর সুদৃশ্য পঁচিশচূড়া মন্দির অবস্থিত। এটি কালনার তিনটি পঁচিশচূড়া মন্দিরের একটি। মন্দিরের গর্ভগৃহের সামনের দেওয়ালের উপরে পাথরের ফলকে সাত সারির একটি সংস্কৃত লিপি আছে। কিন্তু লিপিটির উপর রঙের প্রলেপ দেওয়াতে লিপিটির পাঠ সহজসাধ্য হলেও অক্ষরের ছাঁদ ভিন্ন ধরনের হওয়ায় শুদ্ধ পাঠ সম্ভব নয়। উদ্ধারীকৃত লিপিটির পাঠ হল :
'শুভমস্তু শকাব্দাঃ ১৬৮৮
শাকাব্দে শরভাক্তি রাত্রিপকলা
কোটীর মৃক্তজভূসংখ্যে বাহুজ
বংশভুকোমলধীঃ শ্রীকৃষ্ণচন্দ্রঃ
সুধীঃ। প্রসাদম্ প্রদদৌ বিধিয়া পর
যা ভক্ত্যাপরব্রহ্মণে গোপালায় সমস্ত
বাঙময় পথাপ্রীতায় বিশ্বাত্মনে ।।'
অর্থাৎ, ১৬৮৮ শকাব্দে ( ১৭৬৬ খ্রীষ্টাব্দে ) বাহুজ বংশভূ ( ক্ষত্রিয় বংশজাত ) শুদ্ধবুদ্ধিসম্পন্ন শ্রীকৃষ্ণচন্দ্র নামক এক সুধী গোপালের নিমিত্ত এই মন্দির নির্মাণ করেন। এটি রাজা তিলকচন্দ্রের রাজত্বকালে প্রতিষ্ঠিত হয়।
মন্দিরটি পূর্বমুখী, উচ্চ ভিত্তিবেদির উপর প্রতিষ্ঠিত। মন্দিরের সামনে রয়েছে ত্রিখিলান অলিন্দ। তার সামনে সন্নিবদ্ধ রয়েছে একটি 'একবাংলা ' মণ্ডপ। মণ্ডপটির মাথায় লম্বা একটি মটকা বাঁধা যা গ্রাম বাংলার খোড়ো চালের কথা মনে করিয়ে দেয়।
মন্দিরটির প্রথম তলের ছাদের চার কোণে যে খাঁজের সৃষ্টি হয়েছে তাতে তিনটি করে, দুটি চূড়া সমমাপে এগোনো, মাঝেরটা একটু পিছানো, মোট ১২ টি চূড়া স্থাপিত। তারপর বেড় কমিয়ে খানিকটা উপরে অষ্টকোণাকৃতি ২য় তল সৃষ্টি করা হয়েছে। তার ছাদে আটকোণে মোট ৮ টি চূড়া। এরপর বেড়ের উচ্চতা কমিয়ে ২য় তলের চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম উচ্চতায় ৩য় তল সৃষ্টি করা হয়েছে। তার চার কোণে ৪ টি এবং মাঝে একটি বড় চূড়া। অর্থাৎ চূড়াগুলির সজ্জা হচ্ছে ১২+৮+৪+১ । মোট চূড়ার সংখ্যা পঁচিশ এবং উপরের তলের চূড়া ধরে মোট চারতলা। এই চূড়াগুলি চারকোণা এবং তাদের ছাদ উঁচু-নিচু কার্নিসের বিন্যাসে কিছুটা পীড়া শিখরের অনুরূপ।
মন্দিরের যে খাঁজ থেকে 'একবাংলা ' মণ্ডপ আরাম্ভ তার বাইরের দু পাশে টেরাকোটার কাজ একতলার কার্নিস পর্যন্ত উঠে গেছে। দেওয়ালের গায়ে রয়েছে টেরাকোটার ফুলকারি কাজও। ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে 'কল্পলতা' বা 'মৃত্যুলতা'কে দেওয়ালের কোণে বা গায়ে খাড়াভাবে লাগানোই প্রচলিত রীতি। এখানেও তা একতলার কার্নিস পর্যন্ত উঠে গেছে। মন্দিরের চারটি দেওয়ালেই টেরাকোটার কাজ আছে। 'কল্পলতা' বা 'মৃত্যুলতা' সম্বন্ধে জানতে ক্লিক করুন :
স্থাপত্যের ক্ষেত্রে এই গোপালজীর পঁচিশচূড়া মন্দির এক অনবদ্ধ পুরাকীর্তি। এর সুচারু খাঁজকাটা রত্নগুলির মধ্যে এক অপরূপ সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে। মন্দিরের দেওয়ালে যেসব টেরাকোটা ফলক আছে তা খুবই আকর্ষণীয়। অবশ্য সেই টেরাকোটার বেশিরভাগই নষ্ট হয়ে গেছে বা নষ্ট হতে চলেছে। দেবদেবী লীলা তো আছেই। সামাজিক দৃশ্যের মধ্যে আছে যুদ্ধদৃশ্য, ইউরোপীয়দের শ্বাপদ শিকার, ঢোলবাদক, ঢাকবাদক, দণ্ডায়মান অবস্থায় সাহেব ও এদেশীয় স্ত্রীলোকের মিথুনদৃশ্য, হাতির উপর মিথুনদৃশ্য প্রভৃতি।
গর্ভগৃহে রয়েছে ১ ফুট ৬ ইঞ্চির ( ৪৬ সেমি ) গোপাল, দুটি কৃষ্ণ ও দুটি রাধার মূর্তি। সদর দ্বারের ঢোকার মুখের দুপাশে রয়েছে দুটি পশ্চিমমুখী আটচালা শিবমন্দির।
এখানে যে রথের টান হতো তার নিদর্শন স্বরূপ রয়েছে একটি ভাঙা রথ। তাছাড়া মন্দিরের বাইরে রয়েছে রাসমঞ্চ। মন্দিরে বিগ্রহের নিত্যপূজা ছাড়াও অন্যান্য উৎসবও হয়ে থাকে।
|
গোপালজী মন্দির, কালনা |
|
মন্দিরের প্রতিষ্ঠালিপি |
|
মন্দিরের দুটি ইমারতি থাম |
|
মন্দিরে একটি খিলানের কাজ |
|
মন্দিরের দেওয়ালে টেরাকোটা বিন্যাস- ১ |
|
মন্দিরের দেওয়ালে টেরাকোটা বিন্যাস- ২ |
|
মন্দিরের দেওয়ালে টেরাকোটা বিন্যাস- ৩ |
|
কুলুঙ্গির মধ্যে নিবদ্ধ টেরাকোটা মূর্তি - ১ |
|
কুলুঙ্গির মধ্যে নিবদ্ধ টেরাকোটা মূর্তি - ২ |
|
কুলুঙ্গির মধ্যে নিবদ্ধ টেরাকোটা মূর্তি - ৩ |
|
কুলুঙ্গির মধ্যে নিবদ্ধ টেরাকোটা মূর্তি - ৪ |
|
কুলুঙ্গির মধ্যে নিবদ্ধ টেরাকোটা মূর্তি - ৫ |
|
কুলুঙ্গির মধ্যে নিবদ্ধ টেরাকোটা মূর্তি - ৬ |
|
কুলুঙ্গির মধ্যে নিবদ্ধ টেরাকোটা মূর্তি - ৭ |
|
মন্দিরের কোণে মৃত্যুলতা |
|
মৃত্যুলতার টেরাকোটা মূর্তি - ১ |
|
মৃত্যুলতার টেরাকোটা মূর্তি - ২ |
|
মৃত্যুলতার টেরাকোটা মূর্তি - ৩ |
|
মৃত্যুলতার টেরাকোটা মূর্তি - ৪ |
|
মিথুন মূর্তি - ১ |
|
মিথুন মূর্তি - ১ |
|
মন্দিরে টেরাকোটার ফলক - ১ |
|
মন্দিরে টেরাকোটার ফলক - ২ |
|
মন্দিরে টেরাকোটার ফলক - ৩ ( কৃষ্ণ লীলা )
|
|
মন্দিরে টেরাকোটার ফলক - ৪ |
|
মন্দিরে টেরাকোটার ফলক - ৫ |
|
মন্দিরে টেরাকোটার ফলক - ৬ ( কৃষ্ণ লীলা ) |
|
মন্দিরে টেরাকোটার ফলক - ১ ( কৃষ্ণ লীলা )
|
|
গোপালজী ও অন্যান্য বিগ্রহ |
অম্বিকা কালনার এই মন্দিরে যেতে হলে শিয়ালদহ থেকে সকাল ৮ টা ৬ মিনিটের কাটোয়া লোকাল বা হাওড়া থেকে কাটোয়া লোকাল ধরুন। ব্যাণ্ডেল থেকেও অম্বিকা কালনা যাওয়ার গাড়ি পাবেন। স্টেশন থেকে রিকশা বা টোটোতে মন্দিরে পৌঁছে যান। নদিয়া জেলার শান্তিপুর থেকেও গঙ্গা পেরিয়ে কালনায় যেতে পারেন।
মন্দিরটি পরিদর্শনের তারিখ : ০৩.০৭.২০১৬
সহায়ক গ্রন্থাবলি :
১) কালনা মহকুমার প্রত্নতত্ত্ব ও ধর্মীয় সংস্কৃতির ইতিবৃত্ত : বিবেকানন্দ দাস
২) বাংলার মন্দির স্থাপত্য ও ভাস্কর্য : প্রণব রায়
**********
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন