অনন্ত বাসুদেব মন্দির, বাঁশবেড়িয়া, হুগলি
শ্যামল কুমার ঘোষ
ব্যাণ্ডেল-কাটোয়া রেলপথে বাঁশবেড়িয়া একটি রেলস্টেশন। প্রাচীন সপ্তগ্রামের অন্যতম বংশবাটির বর্তমান নাম বাঁশবেড়িয়া। ব্যাণ্ডেল থেকে দূরত্ব ৪ কিমি। এখানে আছে দুটি বিখ্যাত মন্দির, অনন্ত বাসুদেব ও হংসেশ্বরী। এখানে অনন্ত বাসুদেব মন্দির সম্পর্কে আলোচনা করব। ( হংসেশ্বরী মন্দির সম্পর্কে এই ব্লগের অন্যত্র আলোচনা করেছি। )
রামেশ্বর দ্বারাই বংশবাটী রাজবংশের উদ্ভব ও শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। তিনি বঙ্গের বিভিন্ন স্থান থেকে ৩৬০ ঘর কায়স্থ, ব্রাহ্মণ, বৈদ্য ও অন্যান্য জলাচরণীয় হিন্দু ও যুদ্ধে পারদর্শী পাঠানদের এনে বংশবাটীতে বাস করানোর ব্যবস্থা করেন। বারাণসী থেকে ন্যায়, সাংখ্য ও দর্শন শাস্ত্রে পারদর্শী বহু পণ্ডিত কে এনে তাঁদের সাহায্যে বংশবাটীতে ৬০ টি চতুষ্পাঠী স্থাপন করেন।
মুসলমান রাজত্বকালে বঙ্গে নানা কারণে বিশৃঙ্খলা ছিল। সেইজন্য জমিদারগণ সুযোগ বুঝে প্রাপ্য রাজস্ব যথা সময়ে রাজ দরবারে জমা দিতেন না। রামেশ্বর অন্যান্য জমিদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে তাদের জমিদারী হস্তগত করেন এবং যথাসময়ে রাজ সরকারে রাজস্ব প্রেরণ করেন। সম্রাট আওরঙ্গজেব হিন্দু বিদ্বেষী হলেও রামেশ্বরের এই কাজে খুবই খুশি হন এবং ১৬৭৩ খৃষ্টাব্দে " পঞ্চপর্চা খিলাত সহ রাজা-মহাশয় " উপাধিতে তাঁকে ভূষিত করেন এবং এই রাজোপাধি পুরুষানুক্রমে ব্যবহার করার জন্য আর একখানি সনদ দ্বারা বংশবাটী গ্রামে ৪০১ বিঘা নিষ্কর ভূমি জায়গীর ও ১২ টি পরগণা তিনি জমিদারী স্বরূপ তাঁকে দান করেন।
রাজা রামেশ্বর দত্ত পরম ভাগবত ছিলেন এবং ১৬০১ শকাব্দে ( ১৬৭৯ খৃষ্টাব্দে ) বংশবাটীতে একটি বিষ্ণুমন্দির স্থাপন করেন। উঁচু ভিত্তিবেদির উপর প্রতিষ্ঠিত ইঁটের তৈরী মন্দিরটি একরত্ন শ্রেণীর। মন্দিরের পূর্ব, দক্ষিণ ও উত্তর দিকে তিনটি করে খিলান আছে । মন্দিরের শিখর রত্নটি আটকোণা। চারকোণা মন্দিরের গর্ভগৃহের তিনদিকে অলিন্দ। মন্দিরটির পূর্ব দিকে প্রবেশদ্বার। দক্ষিণ দিকে আর একটি প্রবেশদ্বার আছে। উত্তর দিকের প্রবেশদ্বারটি ভরাট করা। মন্দিরটির গঠনশৈলী ও বাইরের তিন দিকের ( পূর্ব, দক্ষিণ ও উত্তর ) দেওয়ালে, বিশেষ করে পূর্ব দিকের দেওয়ালে অজানা শিল্পীদের মূল্যবান টেরাকোটা-অলংকরণে-সমৃদ্ধ ভাস্কর্য সহজেই দর্শককে মুগ্ধ করে। মন্দিরের গায়ে টেরাকোটায় দক্ষযজ্ঞ, যজ্ঞের অনুষ্ঠান, নৌযুদ্ধ, হরধনু ভঙ্গ, দশাবতার, নৃত্যরতা নর্তকীর নৃত্যের মুদ্রা, মৃদঙ্গ বাদকের বাদন-ভঙ্গিমা প্রভৃটি সুন্দর ভাবে ফুটে উঠেছে। মন্দিরের সামনের দিকের ভিত্তিবেদির গায়ে একটি প্রস্তর-ফলকে খোদিত প্রতিষ্ঠা-লিপির পাঠ নিম্নরূপ :
" মহীব্যোমাঙ্গশীতাংশুগণিতেশকবৎসরে ।
শ্রীরামেশ্বরদত্তেন নির্মমে বিষ্ণুমন্দিরং।। ১৬০১ । "
মহী = ১, ব্যোম = ০, অঙ্গ = ৬, শীতাংশু= চন্দ্র = ১ ধরে অঙ্কের বামাগতি নিয়মানুসারে প্রতিষ্ঠাকাল ১৬০১ শকাব্দ। ইং ১৬৭৯ খ্রীষ্টাব্দ, বাংলা ১০৮৬ সন।
১৯০২ খৃষ্টাব্দে বঙ্গের ছোটলাট স্যার জন উডবার্ন মন্দিরের ইঁট গুলিতে নানা রকম কারুকার্য দেখে বলেছিলেন, অঙ্কিত ইঁটগুলি এত সুন্দর যে প্রত্যেকটির চিত্র সংগ্রহ করে দেওয়ালে টাঙালে গৃহের শোভা নিঃসন্দেহে বৃদ্ধি পাবে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের নির্দেশে শিল্পী নন্দলাল বসু এখানে একমাস থেকে মন্দিরের প্রতিটি দৃশ্য এঁকে নেন। ৩৩৭ বছর আগের তৈরী এই মন্দিরের পোড়া মাটির ভাস্কর্য অযত্নে অনেকটা ক্ষতি হলেও এখনও আপনাকে তা বিহ্বল-দৃষ্টি নিয়ে দেখতে হবে। সাবেক কষ্টিপাথরের বাসুদেব মূর্তিটি অনেক দিন আগে চুরি যায়। মন্দিরটি বর্তমানে ভারতীয় পুরতত্ব সর্বেক্ষণ, কলকাতা মণ্ডল দ্বারা সংরক্ষিত ও পরিরক্ষিত।
মন্দিরটি পরিদর্শনের তারিখ : ০৯.০৯.২০১৫
|
অনন্ত বাসুদেব মন্দির |
|
পূর্বদিকের ত্রিখিলান বিন্যাস |
|
পূর্বদিকের একটি খিলানের উপরের কাজ |
|
দক্ষিণদিকের একটি খিলানের উপরের কাজ |
|
মন্দিরের আটকোণা রত্ন |
|
উপরে, যশোদার দধিমন্থন, অশোকবনে সীতা ও হনুমান । নিচে, জমিদারের অন্যত্র গমন
|
|
|
হরধনু বৃতান্ত (উপরে ), জলদস্যুদের যুদ্ধ (নিচে ) |
|
ঋষ্যশৃঙ্গের যজ্ঞ ইত্যাদি |
|
উপরে কৃষ্ণলীলা, নিচে নাচের দৃশ্য |
|
উপরে, কৃষ্ণের গিরিগোবর্ধন ধারণ
নিচে,দেবাসুরযুদ্ধ ও যুদ্ধের মধ্যে নারায়ণের আবির্ভাব |
|
একটি স্তম্ভ |
|
নৃত্যের ভঙ্গিমা |
|
টেরাকোটার একটি কাজ |
|
কৃষ্ণের কংস বধ, পিছনে বলরাম |
|
নৃত্য |
|
সংকীর্তনদৃশ্য |
|
কৃষ্ণ ও গোপিনীরা |
|
দধিভান্ডসহ গোপিনীরা |
|
বিষ্ণু মূর্তি |
|
হংস সারি |
|
টেরাকোটার প্যানেল |
|
কুলুঙ্গির মধ্যে টেরাকোটা মূর্তি |
|
পাথরের লিপি-ফলক |
|
বাসুদেব মূর্তি |
বাঁশবেড়িয়াতে যেতে হলে শিয়ালদহ থেকে সকালে ৮ টা ৬ মিনিটে কাটোয়া লোকাল বা হাওড়া থেকে কাটোয়া লোকাল ধরুন। ব্যাণ্ডেল থেকেও বাঁশবেড়িয়া যাওয়ার গাড়ি পাবেন। স্টেশন থেকে মন্দির যেতে রিকশা বা টোটো পাবেন। হেঁটেও যেতে পারেন।
সহায়ক গ্রন্থাবলি :
১. হুগলী জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ ( ২ য় খণ্ড ) : সুধীর কুমার মিত্র
২. পশ্চিমবঙ্গের পূজা-পার্বণ ও মেলা ( ২ য় খণ্ড ) : অশোক মিত্র সম্পাদিত
এই মন্দিরের পাশে আর একটি মন্দির আছে। মন্দিরটি সম্বন্ধে জানতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুন :
হংসেশ্বরী মন্দির
-------------------------------------------
আমার ইমেল : shyamalfpb@gmail.com প্রয়োজনে যোগাযোগ করতে পারেন।
--------------------------------------------
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন