Pages

শনিবার, ২৩ মে, ২০১৫

Shivshakti Annapurna Temple, Talpukur,Barrackpur,North 24 Parganas


শিবশক্তি  অন্নপূর্ণা  মন্দির, তালপুকুর, ব্যারাকপুর, উত্তর ২৪ পরগনা  

                      শ্যামল  কুমার  ঘোষ 

            উত্তর  ২৪  পরগনার  ব্যারাকপুরের  কাছে  তালপুকুরের  অন্নপূর্ণার  'নবরত্ন' মন্দিরটি  বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তালপুকুরের  আগের  নাম  ছিল চানক।  মন্দিরটি  প্রতিষ্ঠা  করেন  রানি  রাসমনির  ছোট  মেয়ে  জগদম্বা  দেবী।  রানি  রাসমনির  জামাই  মথুর  বিশ্বাস  তাঁর  প্রথমা  স্ত্রী  করুণাময়ীর ( রানি  রাসমনির  সেজ  মেয়ে )  মৃত্যুর  পর  জগদম্বা  দেবীকে  বিবাহ  করেন।  ঠাকুর  শ্রী  রামকৃষ্ণ  পরমহংস  দেব  ইং  ১৮৭৫ সালের  ১২ ই  এপ্রিল ( ৩০ শে  চৈত্র,  ১২৮১  বঙ্গাব্দ )  এই  মন্দির  উদ্বোধন  করেন।  অন্নপূর্ণার  এই  মন্দিরের  সঙ্গে  দক্ষিণেশ্বরের  ভবতারিণীর  'নবরত্ন'  মন্দিরের  খুবই  সাদৃশ্য  আছে।  দুটি  মন্দিরই  একই  স্থপতির  পরিকল্পনায়  তৈরী।  অন্নপূর্ণার মন্দিরটির  উচ্চতা ভবতারিণীর  মন্দিরের  উচ্চতার  চেয়ে  কিছুটা  বেশি। পূর্বদিকের  একটি  সিংহমূর্তিযুক্ত  লোহার  ফটক  দিয়ে  মন্দির  প্রাঙ্গণে  প্রবেশ  করলে  পাশাপাশি  নাটমন্দির  ও  অন্নপূর্ণার  মন্দির  চোখে  পড়বে।  পশ্চিম  সীমান্তে  উত্তর-দক্ষিণে  বিস্তৃত  পাশাপাশি  ছয়টি  উঁচু  আটচালা  শিবমন্দিরের  প্রত্যেকটিতে  প্রায়  তিন ফুট  উঁচু  কালো  পাথরের  শিবলিঙ্গ  প্রতিষ্ঠিত।  উক্ত  ছয়টি  শিবমন্দিরের  মাঝখানের  একটি  লোহার  ফটক  থেকে  একটি  রাস্তা  সোজা  গঙ্গার  ঘাট পর্যন্ত  গিয়েছে।  গঙ্গার  ঘাটে  উপরে  ছাদ  বিশিষ্ট  চাঁদনি  থেকে  ইঁটের  তৈরী  সিঁড়ি  গঙ্গার  গর্ভ  পর্যন্ত  নেমে গেছে।

           ইঁটের  তৈরী  অন্নপূর্ণার মন্দিরটি  একটি  উচ্চ  বেদির  উপর  স্থাপিত। মন্দিরে ওঠবার  জন্য  দক্ষিণ, পশ্চিম ও  উত্তর  দিকে  সিঁড়ি  আছে।  চারিদিকের  ঘোরানো  রক্  ও  মন্দিরাভ্যন্তরের  মেঝে  যথাক্রমে  বেলে  পাথর ও  শ্বেত  পাথর দিয়ে তৈরী। মন্দিরে  প্রতিদিকে পাঁচটি  করে  খিলান-প্রবেশপথ  বা  ভরাটকরা নকল খিলান-প্রবেশপথ  আছে।  খিলান  প্রবেশপথের  উপরের  দেওয়াল  'পঙ্খ'  দ্বারা  অলংকৃত। স্তম্ভগুলিও  সুদৃশ্য।  দ্বিতলেও  এই  মন্দিরে  তিনটি  করে  'খিলান' আছে।  প্রতিদিকে  দুটি করে  বাঁকানো  কার্নিস  ছাদের  কার্নিসযুক্ত  চালার ন্যায়  বাঁকা।  তার  ঠিক  উপরে  দ্বিতল  ও  ত্রিতলে  রেলিং  দেওয়া  অনুচ্চ  দেওয়াল।  মাঝের  অংশ  ফাঁকা।  ওপর  ও  নিচের  মাঝখানের  অংশে  যেসব  ছোট  ছোট  কুলুঙ্গি  আছে,  সেগুলি  খালি।  অন্নপূর্ণার এই  মন্দিরে  দ্বিতল  ও  ত্রিতলে  যে  নয়টি  'রত্ন'  আছে,  সেগুলি  খাঁজকাটা  দেউলাকৃতি।  প্রতিটির  শীর্ষে  চক্র  স্থাপিত।  অন্নপূর্ণার  এই  মন্দিরের  দক্ষিণদিকের  ঢাকা  বারান্দা  কিছুটা  অপ্রশস্ত,  দক্ষিণেশ্বরের  মতো  অত  চওড়া  নয়।  গর্ভগৃহে শ্বেতপাথরের  বেদীর  উপর রুপোর  তৈরী  সিংহাসনে আসীনা  অষ্টধাতুর  তৈরী  দেবী  অন্নপুর্ণা, অলঙ্কার-ভূষিতা  ও  অন্নদানে  রতা  মাতৃমূর্তি  তাঁর  ডান  হাতে  অন্নদান  করার  হাতা  এবং  বাঁ  হাতে অন্নপাত্র।  দেবীর  ডানপাশে  দণ্ডায়মান  রুপোর  তৈরী  মহাদেব,  হাতে ত্রিশূল  ও  ভিক্ষাপাত্র।

          অন্নপূর্ণার  প্রতিদিন  সকালে  মঙ্গলারতি,  দুপুরে  অন্নভোগ  এবং  সন্ধ্যায়  আরতি  ও  দুধ-লুচি  সহযোগে  শীতল  পুজো  হয়।  অন্নপূর্ণা  পূজায়  এখানে  জাঁকজমক  সহকারে  পুজো  হয়। 

          মন্দিরের  সামনে  প্রশস্ত  নাটমন্দির।  নাটমন্দিরের  উত্তর  ও  দক্ষিণদিকে  পাঁচটি  করে  এবং  পূর্ব  ও  পশ্চিমদিকে  সাতটি করে  খিলান-প্রবেশপথ। খুবই  চাকচিক্যময়  এই  নাটমন্দির।  উঁচু  গোল  গোল  থাম  নাটমন্দিরের  চারদিকে  সুবিন্যস্ত।

          মন্দির  চত্বর  পাঁচিল  দিয়ে  ঘেরা।  পূর্বদিকে  প্রধান  প্রবেশদ্বারের  উপর একটি  সিংহের  মূর্তি  আছে।  সেই  সময়  স্থানীয়  ইংরেজ  সরকার  এই  সিংহের  মূর্তিকে  সরিয়ে  নেওয়ার  জন্য  মন্দির  কর্তৃপক্ষকে  চাপ  দিয়েছিল।  তাঁদের  বক্তব্য  ছিল  যে  এটা  ব্রিটিশ  সাম্রাজ্যের  প্রতীক।  তাই  মন্দির  কর্তৃপক্ষের  কোন  এক্তিয়ার  নেই  এটা  ব্যবহার  করার।  এ ব্যাপারে  মামলাও  হয়।  অনেক  বছর  আইন-যুদ্ধের  পর  কোর্ট  রায়  দেন, "Art  is  art, let  the  art  prevail "।  সেই  থেকে  সিংহের  মূর্তি  এখনও  রয়ে  গেছে।

        মন্দির  দর্শণের  সময়  :
                 গ্রীষ্মকাল  :  সকাল  ৫ টা  ৩০ মি.  থেকে  দুপুর  ১২ টা ৩০ মি  এবং  বিকাল   টা  থেকে  রাত্রি  ৮ টা।
                 শীতকাল  : সকাল  ৬ টা  থেকে  দুপুর  ১  টা  এবং  বিকাল   টা  ৩০ মি. থেকে  রাত্রি  ৮ টা।

          অন্নপূর্ণার  এই  মন্দিরে  যেতে  হলে  শ্যামবাজার  থেকে  ব্যারাকপুর  গামী  যেকোন  বাসে  উঠুন,  নামুন তালপুকুর।  ট্রেনে  যেতে  হলে  শিয়ালদহ  থেকে  ব্যারাকপুর  গামী  যেকোন  লোকাল  ট্রেনে  উঠুন,  নামুন  ব্যারাকপুর।  তারপর  বি.টি. রোডে এসে  টিটাগড়  গামী  যে  কোন  অটো  বা  বাসে  উঠুন,  নামুন  তালপুকুর।  সেখান  থেকে  রিকশায়  পৌঁছে  যান  মন্দির। 

            মন্দিরটি  পরিদর্শনের  তারিখ : ১৭.০৫.২০১৫


অন্নপূর্ণা মন্দিরে পূর্ব দিকের প্রধান প্রবেশ-দ্বার

প্রধান প্রবেশ-দ্বারের ওপরে সিংহ মূর্তি 

মন্দির চত্বর

শিবশক্তি অন্নপূর্ণার মন্দির

মন্দিরের মাঝের অংশ

মন্দিরের শিখর দেশ

খিলান' প্রবেশপথের উপরে 'পঙ্খ'-এর কাজ
শিবমন্দিরের সারি

নাটমন্দির

অন্নপূর্ণা ও মহাদেব মূর্তি 


  সহায়ক গ্রন্থাবলি   :

                    ১) বাংলার  মন্দির  স্থাপত্য  ও  ভাস্কর্য :  প্রণব  রায় 
                   ২) পশ্চিম  বঙ্গের  পূজা-পার্বণ  ও  মেলা ( ৩ য়  খণ্ড )  :   অশোক  মিত্র সম্পাদিত

                                                               *******

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন