রাজরাজেশ্বর শিব ও অন্যান্য মন্দির, শিবনিবাস, নদিয়া
শ্যামল কুমার ঘোষ
নদিয়া জেলার মাজদিয়ার ৩ কিমি দূরে শিবনিবাস গ্রাম। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র বাংলায় বর্গী আক্রমণের সময় তাঁর রাজধানী কৃষ্ণনগর থেকে এখানে সরিয়ে আনেন এবং শিবের নামে নামকরণ করেন শিবনিবাস। এখানে তিনি এক সুন্দর রাজপ্রাসাদ ও কয়েকটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। তার মধ্যে এখন মাত্র তিনটি মন্দির অবশিষ্ট আছে। প্রতিটি মন্দিরের উচ্চতা ৬০ ফুট। এই শিবনিবাসে তাঁর রাজধানী প্রতিষ্ঠার একটি কাহিনী আছে। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র নসরত খাঁ নামক এক দুর্ধর্ষ ডাকাতকে দমন করতে মাজদিয়ার কাছে এক গহন অরণ্যে উপস্থিত হন। ডাকাতকে দমন করে সেখানে তিনি একরাত অবস্থান করেন। পরদিন সকালবেলায় তিনি যখন নদীতীরে মুখ ধুচ্ছিলেন তখন একটি রুইমাছ জল থেকে লাফিয়ে মহারাজের সামনে এসে পড়ে। আনুলিয়া নিবাসী কৃষ্ণরাম নামক মহারাজের এক আত্মীয় তখন মহারাজকে বলেন, 'এ স্থান অতি রমণীয়, উপরন্তু রাজভোগ্য সামগ্রী নিজে থেকেই মহারাজের সামনে এসে হাজির হয়। তাই এই স্থানে মহারাজ বাস করলে মহারাজের নিশ্চয়ই ভাল হবে'। মহারাজও তখন বর্গীর অত্যাচার থেকে বাঁচতে এই রকমই একটা নিরাপদ জায়গা খুঁজছিলেন। স্থানটি মনোনীত হলে তিনি কঙ্কনাকারে নদীবেষ্টিত করে স্থানটি সুরক্ষিত করেন। এই শিবনিবাসেই মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র মহাসমারোহে অগ্নিহোত্র বাজপেয় যজ্ঞ সম্পন্ন করেন। এই উপলক্ষ্যে কাশী, কাঞ্চি প্রভৃতি স্থান থেকে সমাগত পণ্ডিত মণ্ডলী তাঁকে 'অগ্নিহোত্রী বাজপেয়ী' আখ্যা প্রদান করেন। সেই সময়ে শিবনিবাস কাশীতুল্য বলে পরিগণিত হত।
কৃষ্ণচন্দ্র প্রতিষ্ঠিত শিবনিবাসের মন্দিরগুলি বাংলা মন্দিররীতিতে উল্লেখযোগ্য সংযোজন। এখানকার প্রথম দেবালয়টি 'রাজরাজেশ্বর' শিবমন্দির নামে পরিচিত। সাধারণের কাছে যা 'বুড়োশিবের মন্দির' নামে অভিহিত। এই মন্দিরটি বাংলার প্রচলিত মন্দিররীতির কোন শ্রেণীতে পড়ে না। উঁচু ভিত্তিবেদির উপর স্থাপিত, অষ্টকোণ প্রস্থচ্ছেদের এই মন্দিরের শীর্ষদেশ ছত্রাকার। খাড়া দেওয়ালের প্রতিটি কোণে মিনার আকৃতির আটটি সরু থাম। প্রবেশদ্বারের খিলান ও অবশিষ্ট দেওয়ালে একই আকৃতির ভরাটকরা নকল খিলানগুলি 'গথিক' রীতি অনুযায়ী নির্মিত। প্রতিষ্ঠাকাল ১৭৫৪ খ্রিষ্টাব্দ। একটি বড় ( ৯ ফুট ) কষ্টিপাথরের শিবলিঙ্গ এখানে নিত্যপূজিত। শিবলিঙ্গের বেশি উচ্চতার জন্য শিবলিঙ্গের মাথায় জল, দুধ ইত্যাদি ঢালবার জন্য সিঁড়ি আছে। সিঁড়িটি একদিক থেকে কয়েক ধাপ উঠে আর একদিকে নেমে গেছে যাতে পুণ্যার্থীরা একদিক দিয়ে উঠে বাবার মাথায় জাল ঢেলে অপর দিক দিয়ে নেমে যেতে পারেন এবং শিবলিঙ্গের পূর্ণ প্রদক্ষিণ করতে পারেন। বর্তমানে বিশেষ কারণে শিবলিঙ্গের পূর্ণ প্রদক্ষিণ বন্ধ আছে।
![]() |
রাজরাজেশ্বর শিবমন্দির |
মন্দিরের মাঝের অংশ |
![]() |
মন্দিরের শিখরদেশ |
![]() |
মন্দিরের শিবলিঙ্গ |
পাশেই 'রাজ্ঞীশ্বর' শিবমন্দির উঁচু ভিত্তিবেদির উপর স্থাপিত বর্গাকার প্রস্থচ্ছেদের চারচালাযুক্ত মন্দির। প্রতিষ্ঠাকাল ১৬৮৪ শকাব্দ অর্থাৎ ১৭৬২ খ্রিষ্টাব্দ। মন্দিরে একটি প্রতিষ্ঠাফলক আছে। প্রতিষ্ঠাফলকে উৎকীর্ণ লিপি থেকে জানা যায় যে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের দ্বিতীয়া মহিষী স্বয়ং যেন মূর্তিমতী লক্ষ্মী ছিলেন। সম্ভবত এই মন্দিরটি মহারাজা তাঁর দ্বিতীয়া মহিষীর জন্য নির্মাণ করেছিলেন এবং প্রথমটি প্রথম মহিষীর জন্য। এই মন্দিরের শিবলিঙ্গ প্রথম মন্দিরের চেয়ে কিছুটা ছোট ( উচ্চতা সাড়ে সাত ফুট ) এবং পূর্বোক্ত মন্দিরের মত এখানেও শিবলিঙ্গের মাথায় জল ঢালবার জন্য সিঁড়ি আছে।
![]() |
'রাজ্ঞীশ্বর' শিবমন্দির |
![]() |
মন্দিরের শিবলিঙ্গ |
![]() |
মন্দিরের প্রতিষ্ঠাফলক |
এর পাশেই রামসীতার মন্দির। মন্দিরটি উঁচু ভিত্তিবেদির উপর স্থাপিত। আংশিক দালান আকারের কোঠার উপর একটি শিখর স্থাপিত যা অনেকটা বর্গক্ষেত্রাকার। দালানের প্রতিটি ছাদ সমদ্বিবাহু ট্রাপিজিয়াম আকৃতির এবং গর্ভগৃহের প্রতিটি ছাদ ত্রিভুজাকার না হয়ে অনেকটা ঘন্টার লম্বচ্ছেদের মতো বিরল আকৃতির। দালান ও শিখরের খিলানগুলি গথিক রীতি অনুযায়ী নির্মিত। প্রতিষ্ঠাকাল ১৭৬২ খ্রিষ্টাব্দ। বলা বাহুল্য, শিবনিবাসের এই মন্দিরগুলিতে 'টেরাকোটা'র কোন কাজ নেই। ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে বিশপ হেয়ার সাহেব নৌকা করে ঢাকা যাওয়ার পথে এখানে নেমে মন্দিরগুলি দেখেন এবং মুগ্ধ হন। মন্দিরগুলির বিবরণ ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে লন্ডন থেকে প্রকাশিত জার্নালে প্রকাশ করেন।
শিবনিবাস যেতে হলে শিয়ালদহ থেকে সকাল ৭ টা ৪০ মিনিটের গেদে লোকালে উঠুন। নামুন মাজদিয়া। মাজদিয়া স্টেশন থেকে ২/৩ কিমি দূরে শিবনিবাস। ভ্যান বা অটো রিকশায় চুর্নি নদীর ঘাটে নামুন। বাঁশের সাঁকোয় নদী পেরিয়ে পৌঁছে যান মন্দিরে। মাজদিয়ার আগের স্টেশন তারকনগরেও নামতে পারেন। তবে মাজদিয়া থেকে গাড়ি বেশি পাবেন। কৃষ্ণনগর থেকে বাসেও যেতে পারেন। মন্দির দেখে, পুজো দিয়ে, গ্রামটা ঘুরে দেখে কলকাতা যাওয়ার ট্রেন ধরুন। খাবার সঙ্গে নেওয়াই ভাল।
![]() |
মন্দিরের পাশে চুর্নি নদী |
![]() |
চুর্নি নদীর উপর বাঁশের সাঁকো |
সহায়ক গ্রন্থাবলী / প্রবন্ধ :
১) ইতিহাসের রূপরেখায় নদিয়া ও নদিয়ার পুরাকীর্তি : মোহিত রায় ( পশ্চিমবঙ্গ, নদিয়া জেলা সংখ্যা, ১৯৯৭
২) বাংলার মন্দির স্থাপত্য ও ভাস্কর্য : প্রণব রায়
৩) নদীয়া কাহিনী : কুমুদনাথ মল্লিক
৪) ১৯১০ সালে প্রকাশিত District Gazetteer ( Nadia ) Chapter 16 ( পৃষ্ঠা ২৪৭ )
---------------------------------------------
রামায়ণের ৭টি খণ্ডের ৬৪ টি উপাখ্যান ও ১৮৫ টি টেরাকোটা ফলকের আলোকচিত্র সংবলিত আমার লেখা এবং 'রা প্রকাশন' কর্তৃক প্রকাশিত বই 'বাংলার টেরাকোটা মন্দিরে রামায়ণ' প্রকাশিত হয়েছে। বইটির মুদ্রিত মূল্য - ৫৯৯ টাকা।
বইটি ডাক যোগে সংগ্রহ করতে হলে যোগাযোগ করুন : 9038130757 এই নম্বরে।
কলকাতার কলেজস্ট্রিটের মোড়ে দুই মোহিনীমোহন কাঞ্জিলালের কাপড়ের দোকানের মাঝের রাস্তা ১৫, শ্যামাচরণ দে স্ট্রিটের উপর অবস্থিত বিদ্যাসাগর টাওয়ারের দু'তলায় 'রা প্রকাশনে'র দোকান। ওখান থেকে বইটি সংগ্রহ করতে পারেন। কোনও অসুবিধা হলে উপরোক্ত নম্বরে ফোন করতে পারেন।
প্রকাশনীতে বইটি সেরা বইয়ের সম্মান স্বর্ণকলম ২০২৫ পেয়েছে ।
Darun...
উত্তরমুছুনধন্যবাদ। অনেক কিছু জানতে পারলাম
উত্তরমুছুন।
আপনাকেও ধন্যবাদ
মুছুনআজ আরও একবার গিয়েছিলাম।
উত্তরমুছুনমন্দিরগুলি কতক্ষণ খোলা থাকে পূজো দেওয়ার জন্য?
উত্তরমুছুনসকাল 10টা থেকে 12টা
মুছুনবিকেল 4তে থেকে 6টা
ভালো লিখেছেন
উত্তরমুছুন