শ্রীশ্রী রাধাগোবিন্দ ও অন্যান্য মন্দির, আঁটপুর, হুগলি
শ্যামল কুমার ঘোষ
শ্রীরামপুর মহকুমার অন্তর্গত জাঙ্গিপাড়া থানা ও ব্লকের অন্তর্গত একটি গ্রাম আঁটপুর। প্রাচীনকালে এই স্থান ভুরিশ্রেষ্ঠ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং তাঁতের কাপড়ের জন্য খুবই খ্যাতি ছিল। এই গ্রামের দক্ষিণে আনারবাটি নামে একটি গ্রাম আছে। আগে আঁটপুরের নাম ছিল বিষখালি। এই অঞ্চলে ভুরিশ্রেষ্ঠ রাজার আট সেনাপতি বাস করতেন বলে গ্রামটির আঁটপুর নামকরণ হয়। অন্য মতে, মুসলমান রাজত্বকালে এই স্থানে আনোর খাঁ ও আঁটোর খাঁ নামে দুই জমিদার বাস করতেন। তাঁদের নামানুসারে আনোরবাটি ( বর্তমানে আনারবাটি ) ও আঁটপুর নামকরণ হয়েছে।
আঁটপুরের মিত্রবাড়ির আদি পুরুষ কন্দর্প মিত্র। আদিশূরের সময় কান্যকুব্জ থেকে যে পাঁচজন ব্রাহ্মণ ও পাঁচজন কুলীন কায়স্থ গৌড়দেশে এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে কালীদাস মিত্র এই মিত্র বংশের প্রতিষ্ঠাতা। এ পরিবারের তিনটি অংশ বিভিন্ন সময়ে ২৪ পরগণা জেলার বড়িশা, হুগলি জেলার কোন্নগর ও আঁটপুরে এসে বসতি স্থাপন করেন। কন্দর্প মিত্রের পৌত্র কৃষ্ণরাম মিত্র বর্ধমানের মহারাজা তিলকচন্দ্র বাহাদুরের দেওয়ান হিসাবে প্রচুর ভূসম্পত্তি অর্জন করেন। তিনি আঁটপুরে অনেকগুলি দেবালয় নির্মাণ ও জলাশয় খনন করান। এই দেবালয়গুলির মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য শ্রীশ্রী রাধাগোবিন্দের মন্দির। শোনা যায় যে তিনি বৈদ্যবাটি থেকে গঙ্গাজল ও গঙ্গামাটি আনিয়ে সেই গঙ্গামাটিতে ইঁট তৈরী করে রাধাগোবিন্দের মন্দির নির্মাণ করান।
মন্দিরটির আকার বিশাল। আটচালা শৈলীর মন্দিরটি উচ্চ ভিত্তিবেদির নির্মিত, পূর্বমুখী ও সামনে ত্রিখিলান প্রবেশপথ। গর্ভগৃহের সামনে সন্নিবদ্ধ রয়েছে দোচালা বা একবাংলা মণ্ডপ। এটি জগমোহন বা পরিদর্শন কক্ষ রূপে ব্যবহৃত হয়। দোচালা জগমোহনযুক্ত আটচালা স্থাপত্য পশ্চিমবাংলায় বিরল। বর্ধমানের কালনায় দুটি দেবালয়ে এ রকম অতিরিক্ত একবাংলা মণ্ডপের সমাবেশ হয়েছে বটে কিন্তু সেগুলি ২৫-চূড়া রত্ন মন্দির। এই মন্দিরটি 'টেরাকোটা'র ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য। স্থাপত্য ও টেরাকোটা ভাস্কর্যের বিচারে পশ্চিমবঙ্গের এ জাতীয় দেবালয়গুলির মধ্যে এর স্থান সর্বোচ্চ শ্রেণীতে বললে অত্যুক্তি হবে না। মন্দিরের প্রতিষ্ঠাফলক থেকে জানা যায়, মন্দিরটি ১৭০৮ শকাব্দে ( ১৭৮৬ খ্রীষ্টাব্দে ) প্রতিষ্ঠিত হয়। সামনে ত্রিখিলান প্রবেশপথের উপরের তিনটি প্রস্থে কার্নিশের নিচে এবং দেওয়ালের দু'পাশে বামে ও ডাইনে ছোট ছোট খোপে অজস্র টেরাকোটা মূর্তি স্থাপিত। তাছাড়া মন্দিরের উত্তর ও দক্ষিণদিকের দেওয়ালেও বহু টেরাকোটা মূর্তি স্থাপিত। ভিত্তিবেদির ঠিক উপরের প্যানেলগুলিতে সামাজিক দৃশ্যও আছে। টেরাকোটা ফলকগুলির মধ্যে কৃষ্ণলীলা, ভীষ্মের শরশয্যা, রাসলীলা, রামরাবণের যুদ্ধ, পুতনাবধ, বহুবাহু কালীমূর্তি, ফিরিঙ্গি বণিক, মুসলমান ফকির, নানক, চিনা মানুষজন ইত্যাদি চিত্র দেখা যায়। মিত্রবাড়ির প্রবীণ ব্যক্তি অজিত মিত্রের কথায়, রাধাগোবিন্দ মন্দির সর্বধৰ্ম সমন্বয়ের এক দৃষ্টান্ত।
এই মন্দিরের দোচালা জগমোহনের ভেতরের ছাদে পঙ্খের ফুল-লতাপাতার নকশাচিত্র উৎকৃষ্ট দেওয়ালচিত্রের পরিচায়ক। এই দোচালার ভিতরের দেওয়ালে ফুল-লতাপাতার টেরাকোটা ফলকগুলিও সুন্দর। গর্ভগৃহে সিংহাসনে রাধাকান্ত ও রাধার বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত ও নিত্য পূজিত। মন্দিরটি পাঁচিল দিয়ে ঘেরা এবং বর্তমানে পশ্চিম বঙ্গ সরকারের প্রত্নতত্ব অধিকার কর্তৃক সংরক্ষিত।
 |
রাধাগোবিন্দ মন্দির, আঁটপুর মিত্রবাড়ি |
 |
মন্দিরের শিখর |
 |
মন্দিরের সামনের ত্রিখিলান বিন্যাস |
 |
মন্দিরের প্রতিষ্ঠাফলক |
 |
মাঝের খিলানের উপরের কাজ |
 |
বড় করে দেখা |
 |
পাশের খিলানের উপরের কাজ |
 |
বড় করে দেখা |
 |
দক্ষিণ দিকের খিলানের উপরের কাজ |
 |
বড় করে দেখা |
রাধাগোবিন্দ মন্দির চত্বরে আরও পাঁচটি শিবমন্দির, একটি দোলমঞ্চ ও একটি রাসমঞ্চও দর্শনীয়। মন্দির চত্বরের দক্ষিণে প্রথম শিবমন্দিরটির নাম সীতারামেশ্বর। রাধাগোবিন্দ মন্দিরের পাঁচিলের বাইরে যে কটি মন্দির আছে তার মধ্যে এই মন্দিরের টেরাকোটা-অলংকরণ সর্বোত্তম এবং রাধাগোবিন্দ মন্দিরের টেরাকোটা-অলংকরণের তুল্য। এটি অল্প উঁচু ভিত্তিবেদির উপর প্রতিষ্ঠিত, পূর্বমুখী, আটচালা শৈলীর মন্দির। মন্দিরের সামনের দেওয়াল টেরাকোটা অলংকরণে অলংকৃত । দক্ষিণ দিকের দেওয়ালেও দু-একটা টেরাকোটা কাজ আছে। সম্ভবত এদিকের দেওয়ালেও আগে টেরাকোটা-অলংকরণ ছিল। মন্দিরের টেরাকোটার অনেক ফলক নষ্ট হয়ে গেছে। মন্দিরের সামনে তিনটি পত্রাকৃতি খিলানযুক্ত প্রবেশদ্বার। মাঝের খিলানটির উপরে বারোটি প্রতীক শিবমন্দির ও তার মধ্যে শিবলিঙ্গ। পাশের খিলানদুটির উপরে আটটি করে প্রতীক শিবমন্দির ও তার মধ্যে শিবলিঙ্গ। মন্দিরের প্রতিষ্ঠাফলক থেকে জানা যায় যে মন্দিরটি ১৬৯৫ শকাব্দে ( ১৭৭৩ খ্রীষ্টাব্দে ) নির্মিত হয়। প্রতিষ্ঠা করেন সীতারাম মিত্র।
 |
সীতারামেশ্বর শিবমন্দির |
 |
মন্দিরের প্রতিষ্ঠা-ফলক |
 |
মন্দিরের ত্রিখিলান বিন্যাস |
 |
এক পাশের খিলানের উপরের কাজ |
 |
মাঝের খিলানের উপরের কাজ |
 |
অন্য পাশের খিলানের উপরের কাজ |
 |
মন্দিরের টেরাকোটার কাজ |
 |
কুলুঙ্গির মধ্যের কাজ - ১ |
 |
কুলুঙ্গির মধ্যের কাজ - ২ |
 |
কুলুঙ্গির মধ্যের কাজ - ৩ |
 |
মন্দিরের চালের কোনাচ |
 |
দক্ষিণ দিকের দেওয়ালের কাজ |
এই শিবমন্দিরের সামনে, অল্প একটু দূরে বাণেশ্বর শিবমন্দির। অল্প উঁচু ভিত্তিবেদির উপর প্রতিষ্ঠিত, দক্ষিণমুখী, এক দ্বার বিশিষ্ট মন্দিরটি আটচালা শৈলীর। মন্দিরের সামনের দেওয়াল টেরাকোটা অলংকরণে অলংকৃত । এই টেরাকোটার কিছু ফলক নষ্ট হয়ে গেছে। মন্দিরের সামনে পত্রাকৃতি খিলানযুক্ত প্রবেশদ্বার। খিলানটির উপরে দশটি প্রতীক শিবমন্দির ও তার মধ্যে শিবলিঙ্গ। এ ছাড়া কিছু সাধারণ ফুল-নকশা ছাড়া অন্য অলংকরণ নেই। মন্দিরটির কোন প্রতিষ্ঠাফলক নেই।
 |
বাণেশ্বর শিবমন্দির |
 |
মন্দিরের সামনের বিন্যাস |
 |
খিলানের উপরের কাজ |
 |
টেরাকোটার নকশা |
 |
টেরাকোটার ফুল |
দুটি শিবমন্দিরের মধ্যস্থলে রাধাগোবিন্দের দোলমঞ্চ। উঁচু ভিত্তি বেদির উপর প্রতিষ্ঠিত দোলমঞ্চটি পঞ্চরত্ন ধরণের। কেদ্রীয় চূড়াটি উঁচু। প্রতিটি শিখরের উপরিভাগ রেখদেউল ধরণের আড়াআড়িভাবে খাঁজকাটা। চারটি স্তম্ভের উপর দোলমঞ্চটি দণ্ডায়মান। স্তম্ভগুলি পরস্পর ধনুরাকৃতি খিলানের দ্বারা সংযুক্ত।
 |
পঞ্চরত্ন দোলমঞ্চ |
 |
দোলমঞ্চের শিখর |
দোলমঞ্চটির দক্ষিণে রাস্তার বিপরীতে জলেশ্বর ও ফুলেশ্বর নামে দুটি মুখমুখি শিবমন্দির অবস্থিত। মন্দিরদুটি উঁচু ভিত্তিবেদীর প্রতিষ্ঠিত, একদ্বার বিশিষ্ট, প্রথাগত আটচালা শ্রেণীর। একটি পূর্বমুখী ও অপরটি পশ্চিমমুখী। বাঁকানো কার্নিশের নিচে টেরাকোটার কাজ আছে। অন্য কোথাও নেই। পশ্চিমমুখী মন্দিরের প্রতিষ্ঠাফলক থেকে জানা যায় মন্দিরটি ১১৭৬ সালে নির্মিত। অপর মন্দিরটির কোন প্রতিষ্ঠাফলক নেই। এই দুটি মন্দিরের পরেই একটা দীঘি। দীঘির পশ্চিম পাড়েই ছিল মার্টিন রেলের আঁটপুর স্টেশন।
 |
পূর্বমুখী শিবমন্দির |
 |
পশ্চিমমুখী শিবমন্দির |
 |
পশ্চিমমুখী শিবমন্দিরের প্রতিষ্ঠা-ফলক |
 |
মন্দিরের কোনাচ |
মন্দির চত্বরের উত্তর দিকে গঙ্গাধর নামে আর একটি শিবমন্দির অবস্থিত। মন্দিরটি উঁচু ভিত্তিবেদীর প্রতিষ্ঠিত, পশ্চিমমুখী, একদ্বার বিশিষ্ট, প্রথাগত আটচালা শ্রেণীর। মন্দিরের সামনের দেওয়াল টেরাকোটা অলংকরণে অলংকৃত । তবে মন্দিরের খিলানের নিচের টেরাকোটা নষ্ট হয়ে গেছে। মন্দিরের সামনে একটি পত্রাকৃতি খিলানযুক্ত প্রবেশদ্বার। খিলানটির উপরে বারটি প্রতীক শিবমন্দির ও তার মধ্যে শিবলিঙ্গ। ভিত্তিবেদি সংলগ্ন টেরাকোটার নকশি ফলকগুলির মধ্যে পশু-পাখির মূর্তি বিন্যাস মুঘল অলংকরণরীতির কথা মনে করিয়ে দেয়। মন্দিরটিতে কোন প্রতিষ্ঠাফলক নেই।
 |
গঙ্গাধর শিবমন্দির |
 |
মন্দিরের সামনের বিন্যাস |
 |
মন্দিরের খিলানের উপরের কাজ |
 |
মন্দিরের টেরাকোটার নকশা - ১ |
 |
মন্দিরের টেরাকোটার নকশা - ২ |
মন্দির চত্বরের পূর্ব দিকে রাসমঞ্চ। অষ্টকোণযুক্ত রাসমঞ্চটি উঁচু ভিত্তিবেদির উপর স্থাপিত। আট দিকেই খিলান, দুই খিলানের মধ্যবর্তী অংশে, খিলানের উপরে, স্তম্ভে, কাজ আছে।
 |
আটকোনা রাসমেঞ্চ |
 |
রাসমঞ্চের শিখর |
আঁটপুরের মিত্রবাড়ির আরও একটি দর্শনীয় বস্তু কৃষ্ণরাম মিত্র নির্মিত চণ্ডীমণ্ডপ। এটি কাঠের তৈরি। দোচালা, খড়ের চাল। বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি, পৌরাণিক ঘটনা, সামাজিক চিত্র, নকশা ইত্যাদি স্তম্ভের গায়ে, কড়িকাঠে ও ফ্রেমের উপর অজানা শিল্পীদের হাতের ছোঁয়ায় জীবন্ত রূপ পেয়েছে। এটি কন্দর্প মিত্র ১৬৮৩ খ্রীষ্টাব্দে নির্মাণ করান।
 |
মিত্র বাড়ির চণ্ডীমণ্ডপ |
এরকম আরেকটি চণ্ডীমণ্ডপ আছে হুগলির শ্রীপুর, বলাগড়ের মিত্রমুস্তাফি বাড়ি। শ্রীপুরের চণ্ডীমণ্ডপ সম্বন্ধে জানতে ও ছবি দেখতে ক্লিক করুন : চণ্ডীমণ্ডপ, মিত্র মুস্তাফি বাড়ি, শ্রীপুর, বলাগড়
আঁটপুরের মিত্রবাড়ির চণ্ডীমণ্ডপের সামনে ইঁটের তৈরি একটি নাটমন্দির আছে। আগে এখানেও কাঠের তৈরি একটি আটচালা ছিল। কোন সময়ে প্রবল ঝড়ে তা পড়ে যায়। শ্রীরামকৃষ্ণ একবার মিত্রবাড়িতে এসেছিলেন। তখন তিনি 'গদাধর'।
কী ভাবে যাবেন ?
আঁটপুরের মন্দিরে যেতে হলে হাওড়া থেকে তারকেশ্বর লোকালে উঠুন। নামুন হরিপাল স্টেশনে। স্টেশনের পাশ থেকে বাসে উঠে আঁটপুরের 'মিত্রবাড়ি' স্টপেজে নামুন।
মন্দিরগুলি পরিদর্শনের তারিখ : ০৪.১২.২০১৬
সহায়ক গ্রন্থাবলী :
১) হুগলি জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ ( ৩ য় খণ্ড ) : সুধীর কুমার মিত্র
২) হুগলি জেলার পুরাকীর্তি : নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য
৩) বাংলার মন্দির স্থাপত্য ও ভাস্কর্য : প্রণব রায়
৪) দেখা হয় নাই : অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
----------------------------------------------------------
রামায়ণের ৭টি খণ্ডের ৬৪ টি উপাখ্যান ও ১৮৫ টি টেরাকোটা ফলকের আলোকচিত্র সংবলিত আমার লেখা এবং 'রা প্রকাশন' কর্তৃক প্রকাশিত বই 'বাংলার টেরাকোটা মন্দিরে রামায়ণ' প্রকাশিত হয়েছে।
বইটি ডাক যোগে সংগ্রহ করতে হলে যোগাযোগ করুন : 9038130757 এই নম্বরে।
কলকাতার কলেজস্ট্রিটের মোড়ে দুই মোহিনীমোহন কাঞ্জিলালের কাপড়ের দোকানের মাঝের রাস্তা ১৫, শ্যামাচরণ দে স্ট্রিটের উপর অবস্থিত বিদ্যাসাগর টাওয়ারের দু'তলায় 'রা প্রকাশনে'র দোকান। ওখান থেকে বইটি সংগ্রহ করতে পারেন। কোনও অসুবিধা হলে উপরোক্ত নম্বরে ফোন করতে পারেন।
প্রকাশনীতে বইটি সেরা বইয়ের সম্মান স্বর্ণকলম ২০২৫ পেয়েছে ।
Darun !
উত্তরমুছুনI have visited those temples about ten years back, really very nice.
উত্তরমুছুন